Harshabardhan-Chowdhury

হর্ষবর্দ্ধন চৌধুরীর নাটকঃ ঠাকুর চুরি

ঠাকুর চুরিঃ হর্ষবর্দ্ধন চৌধুরী


পাটুলির কাছে সূ্ঁয়াগাছি গ্রামে এক ময়রার বাড়ী ধর্মঠাকুর আছেন শুনিয়া দেখিতে যাই। ঠাকুর খুব জাগ্রত , তাঁর কাছে মানত করলে সব রকম পেটের অসুখ আরাম হয়।–ঠাকুর এক খানি কালো পাথরের বলিয়া মনে হইল, তার উপর পেতলের চোখ।
মন্ত্র-
যস্যান্তো নাদিমধ্যে নচ করচরনং নাস্তিকায়নিদানং/ নাকারং নাদিরূপং নাস্তি জন্ম ঝ যস্য। / যোগীন্দ্রো জ্ঞানগম্যো সকলজনহিতং সর্বলৌকৈকনাথং /
তত্ত্ব তঞ্চ নিরঞ্জনং মরবরদ পাতু নঃ শূন্যমূর্তি

মুকসিমপাড়ার কাছে জামালপুরে এক ধর্ম ঠাকুর আছেন। তিনি বড় জাগ্রত, মে যা মানত করে সেই তাহা পায়। ঠাকুর বড় রাগী, কোনরূপ ত্রুটি হইলে হঠাৎ মন্দ করিয়া বসেন। তিনি চালা ঘরে থাকিতে ভালোবাসেন, কেহ কোঠা ঘর করিয়ে দিতে চাহিলে তার সর্বনাশ হইয়া যায়। তিনি যেখানে বসিয়া আছেন তাহার মাথার উপর চালে খড় কখনোই থাকেনা। বৈশাখ মাসে পূর্ণিমার দিন তাহার ওখানে মেলা হয়, সে মেলায় হাজার বারো পাঠা পড়ে, অনেক শূয়ার ও মুরগি পড়ে। আগে সামনেই শূয়ার মুরগি বলি হইত এখন মন্দিরে পিছন দিকে হয়। –সামনে দাওয়ার চালে অসংখ্য ঢিল ঝুলিতেছে; ন্যাকড়ার ফালি কাপড়ের পাড়, পাটের দড়ি, নারকেলের দড়ি প্রভৃতিতে ঢিল ঝোলানো আছে ।কেহ কিছু মানত করিলে, একটি ঢিল ঝুলাইয়া আসে এবং মনোরথ পূর্ন হইলে ঢিল গুলি খুলিয়া লয়।

ঠাকুর কে জাতে তোলা- শুনেছেন? শুনুন-
শুনিলাম ঠাকুর একজন গোয়ালার ছিলেন। সেই পূজা-অর্চা করিত, কিন্তু ঠাকুর যখন জাগ্রত হইয়া উঠিলেন তখন ব্রাহ্মণের গ্রাম, ব্রাহ্মণেরা গোয়ালার হাতে ঠাকুরের পূজা দিতে ইতস্ততঃ করে দেখিয়া, গোয়ালা একজন দুর্দশাপন্ন ব্রাহ্মণকে পুজারি নিযুক্ত করিলেন। সে প্রথম প্রথম ব্রাহ্মণেরই পূজা দিত, পরে অন্য জাতেরও পূজা দিতে লাগিল। কিন্তু শূয়ার ও মুর্গী বলির সময় সে আসিত না, মানতওয়ালারা ছোট জাতের পন্ডিত লইয়া আসিত । ক্রমে গোয়ালার বংশ লোপ হইয়া গেল। ব্রাহ্মণেরা প্রবল হইয়া উঠিল, এখন ঠাকুর তাঁদের-ই তাঁহারা সব হিন্দু আচার-ব্যবহার আরম্ভ করিয়াছেন। আমি যে সময়ের কথা বলিতেছি ইংরেজি ৯৩ কি ৯৪ সালে। ৯৮ কি ৯৯ সালে আর একবার যাই। সেবার দেখি ধর্ম ঠাকুর মাটির বেদিতে আর নাই। তাঁহার নীচে বেশ একটি পরিষ্কার বড় গৌরিপট্ট হইয়াছে ।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী: বৌদ্ধ ধর্ম: বুদ্ধ ও বৌদ্ধ: সঙ্কলন:ড. বারিদ বরণ দাস: করুণা প্রকাশনী
*দক্ষিণে বেহালা বঁড়শে, উত্তরে দক্ষিণেশ্বর। এরই মাঝে কালী ক্ষেত্র সাবর্ণ- চৌধুরীদের জমিদারের অন্তর্গত। মানসিংহ যখন বাংলার সুবাদার হয়ে আসেন তখন তারই সুপারিশে সাবর্ণ চৌধুরীদের পূর্বপুরুষ লক্ষীকান্ত গাঙ্গুলী, আকবর বাদশার কাছ থেকে এই জমিদারি পেয়েছিলেন আর তার সঙ্গে ছিলেন মজুমদার উপাধি। সাবর্ণ গোত্রীয় গাঙ্গুলী বংশের ব্রাহ্মণ এই জমিদারদের সাধারণ লোকের কথায় শুধু সাবর্ণ- চৌধুরী ব’লেই অভিহিত করত।(৬)

  • জিনিসপত্র আর নগদে ষোলো হাজার টাকা নবাব আজিমউশ্বানকে উপহার দিয়ে ইংরেজরা সুতোনুটি, কলকাতা আর গোবিন্দপুর এই তিনখানা গ্রাম কিনবার অনুমতি পেয়ে গেলেন।
    এর ক’মাস পরেই ১৬৯৮ সালের ১০ নভেম্বর তারিখে, এককেতা দলিলের দ্বারা ইংরেজরা সাবর্ণ চৌধুরীদের কাছ থেকে ওই তিন থানা গ্রাম কিনে নিলেন। চৌধুরীদের তখন পড়তি অবস্থা। তার উপরে অনেক শরিক। তেরো টাকায় ওই তিন খানা গ্রাম ইংরেজ দের হাতে ছেড়ে দিলেন। (পলাশি৩৩)
    *কলকাতার বিভিন্ন পাড়ার নাম আর আজও আদিম বাসীন্দাদের সাক্ষী হ’য়ে আছে। যেমন আহিরীটোলা, কলুটোলা, জেলে টোলা, কুমোরটুলি, শাঁখারীটোলা, ডোমটোলা, বেপারীটোলা , কপালি টোলা, চাষা ধোপাপাড়া, নিকাশিপাড়া, দর্জি পাড়া, ছুতোরপাড়া মুচিপাড়া হাড়িপাড়া দুলে পাড়া, শুড়িপাড়া, যুগিপাড়া, তাঁতিবাগান, নাথ বাগান, ইত্যাদি। বামুন পাড়া, কায়েতপাড়া, বদ্যি পাড়া এসব এ-অঞ্চলেশুনতে পাওয়া যায় না
    (পলাশির যুদ্ধ পৃষ্ঠা ৮)
    ঠাকুর চুরি
    হর্ষবর্দ্ধন চৌধুরী

১ম দৃশ্য –
একটা খাপড়ার ঘরের বারান্দা। দরজায় একটা নোংরা কাপড়ের পর্দা। কলসী নিয়ে গোয়ালিনীর প্রবেশ। হাঁক দেয়-
গোয়ালিনী: কই গো মা ঠাকুরন। দুধ নিয়ে যান।
পর্দা সরিয়ে ঠাকুরের প্রবেশ
ঠাকুরাণী: না, গোয়ালী, আজ তুমি দুধ নিয়ে যাও।
গোয়ালিনী: কেন ঠাকুরানী? দুধ কি খারাপ? আমি দুধে একটুকুও জল দি না।
ঠাকুরাণী:না, না। আমি তোমার দুধ খারাপ বলি নি। আসলে কর্তার পেটটা ভালো না। তাই
গোয়ালিনী: পেট খারাপ? ভালো কথা নয়। এতো এখানে লেগেই আছে। সুয়াগাছিতে ধর্মঠাকুরের থান আছে, ওখানে মানত করলে পেটের রোগ ঠিক হয়ে যায়। আমরাতো তাই করি।
ঠাকুরাণী: সত্যি। আসলে আমরাতো বাইরে থেকে এসেছি। এখানকার ঠাকুরদেবতা সম্পর্কে কোন ধারনাই নাই। ঠাকুর দেবতার আশীর্বাদ না থাকলে কি মানুষের দিন ভালো যায়?
গোয়ালিনী: ঠিকইতো, কর্তাগিন্নী মিলে ওখানে গিয়ে মানত করে একটা পুজো দিয়ে আসবেন, দেখবেন কত ভালো থাকবেন। বড্ড জাগ্রত দেবতা উনি। তা, দুধ না খেতে চান, দৈ পেতে রাখেন। ঘোল করে খাওয়াবেন। ঘোল পেটটা এক্কেবারে ঠান্ডা করে দেবে।
ঠাকুরাণী: বলছিস, তা দে এক বাটি।
(গোয়ালিনী দুধ দিয়ে বলে যায়- সুয়াগাছি ধর্মঠাকুরের থান, যাবেন কিন্তু।)
ঠাকুরাণী: আচ্ছা।(ঘর থেকে কর্তা(বৃন্দাবন) বেরিয়ে আসে।)
বৃন্দাবন: কি এত বকর বকর করছিলে ওই গোয়ালা বৌ এর সাথে?
ঠাকুরাণী: এইযে শোনছেন, এই খানে এক দেবতা আছে। সুয়াগাছিতে , খুব জাগ্রত দেবতা। চলেন না, একদিন সুয়াগাছিতে। একটা পূজা দিয়া আসি।
বৃন্দাবন: সুয়াগাছি? জানো সুয়াগাছিতে কারা থাকে?
ঠাকুরাণী: মানুষ থাকে?
বৃন্দাবন: ওরা মানুষ হলে আমরা কি?
ঠাকুরাণী: কেন ? ওরা মানুষ না?
বৃন্দাবন: না, ওরা হাঁড়ি সুড়ি বাগ্দী ডোম ( এমন সময় বৃন্দাবনের বন্ধু মৃত্যুঞ্জয়ের গলা শোনা যায়, বৃন্দাবন আছো নাকি? প্রবেশ)
মৃত্যুঞ্জয়: কি বৌদি ভালো আছেন তো?
বৃন্দাবন: না, তোমার বৌদির মাথা খারাপ হইছে।
মৃত্যুঞ্জয়: সক্কাল সক্কাল কি বাজে কথা বলেন?
বৃন্দাবন: আর কি বলি? আরে ওই ছোটলোক গুলা ওই সব ভুত পেত্নীর পূজা করে , সেই ঠাকুরকে বলে পূজা করতে। আরে ব্রাহ্মণ বলে কথা
মৃত্যুঞ্জয়: ব্রাহ্মণ? গলায় ক গাছা সুতা ঝুলালেই ব্রাহ্মণ হয় না। এই জায়গাতো সব ওদের ছিল তা জানো?
বৃন্দাবন: হ্যা, কি বলছো?
মৃত্যুঞ্জয়: কেন? পাড়া গুলার নাম শোন না- আহিরীটোলা, কলুটোলা, জেলে টোলা, কুমোরটুলি, শাঁখারীটোলা, ডোমটোলা, বেপারীটোলা , কপালি টোলা, চাষা- ধোপাপাড়া, নিকাশিপাড়া, দর্জি পাড়া, ছুতোরপাড়া মুচিপাড়া হাড়িপাড়া দুলে পাড়া, শুড়িপাড়া, যুগিপাড়া, তাঁতি-বাগান, নাথ বাগান,
বৃন্দাবন: তাইতো! ব্রাহ্মণ বৈদ্য কায়স্থর নাম দিয়া তো কোন পাড়ার নাম শুনি নাই।
মৃত্যুঞ্জয়: থাকবে কি করে? সমাজপতিরা বিধান দিল এই অঞ্চলে যারা থাকবে তাদের জাত যাবে।
বৃন্দাবন: কেন এমন বিধান কেন দিল?
মৃত্যুঞ্জয়: এই সব অঞ্চলে ওদের রাজত্ব ছিল। ওরা ব্রাহ্মণদের নরশ্রেষ্ঠ বলে মানলো না।
বৃন্দাবন: তা, ব্রাহ্মণরা এখানে এল কখন?
মৃত্যুঞ্জয়: তা হলেতো তোমাকে লম্বা ইতিহাস বলতে হয়। পাঠানরা যখন মোগলদের কাছে হেরে গেল তখন অনেক দেশিয় জমিদাররা নিজেরা স্বাধীন রাজ্য বসালো। এরকম এক রাজা যশোরের প্রতাপাদিত্য রায়। এই কলকাতা ছিল তার অধীনে। মোগলরা কম যায় না। মোগলদের সাহায্য করল
ভবানন্দ মজুমদার, লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার এবং বাঁশবেড়িয়ার রাজাদের পূর্বপুরুষ জয়ানন্দ মজুমদার। মোগলরা তিনজনের মধ্যে বাংলা ভাগ করে দিল। দক্ষিণে বেহালা বঁড়শে, উত্তরে দক্ষিণেশ্বর। এরই মাঝে কালীক্ষেত্র সাবর্ণ- চৌধুরীদের জমিদারের অন্তর্গত।
বৃন্দাবন: এরা ব্রাহ্মণ? এদের জাত গেল না?
মৃত্যুঞ্জয়: যে সে ব্রাহ্মণ নয়। সাবর্ণ গোত্রীয় গাঙ্গুলী বংশের ব্রাহ্মণ। আর জাত বোঝ না? যেখানে নিজের লাভ সেখানে সব ঠিক। জমিদারি আসলে কি? রাজস্ব উসুলের চাকরি। ব্রাহ্মণ হয়ে মুসলমান নবাবের চাকরি করলি, তোর ব্রাহ্মণত্ব থাকলো?
বৃন্দাবন: তা তাদের কাছ থিকা ইংরাজরা কি ভাবে কলকাতা দখল নিল?
মৃত্যুঞ্জয়: ইংরেজ তো আসলো ব্যবসা করতে। তাই থাকার জায়গা নিয়ে বড় সমস্যা। ঔরঙ্গজেব মারা গেলে কিছু দামী জিনিসপত্র আর ষোলো হাজার টাকা নগদ দিয়ে নবাব আজিমউশ্বানের কাছ থেকে ইংরেজরা সুতোনুটি, কলকাতা আর গোবিন্দপুর এই তিনখানা গ্রাম কেনবার অনুমতি পেয়ে গেল।
এর ক’মাস পরে ১৬৯৮ সালের ১০ নভেম্বর তারিখে, সাবর্ণ চৌধুরীদের কাছ থেকে তের হাজার টাকায় ওই তিন থানা গ্রাম কিনে নিল। (পলাশি৩৩)
বৃন্দাবন: ও, তা দলে দলে এই কায়েত, বৈদ্য বামুনরা আসা শুরু করলো কেন?
মৃত্যুঞ্জয়: অর্থ , অর্থের জন্যেই সব। সেই হাজার মাইল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে, কত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইংরেজরা এদেশের কাপড় কিনতে আসল। তারাতো এদেশের লোকের ভাষা বোঝে না। কিছু লোক ইংরেজের দু চারটে কথা লিখে দালালি শুরু করলো। কয়েস্থরা তাদের কাছাড়িতে কাজ করা শুরু করলো। টাকার লোভে জাতের জামা খুলে সবাই পয়সা কুড়াতে শুরু করল। তারপর বর্গি হামলা। বর্গীরা যার যা পেল লুট করল, বাড়ি ঘরে আগুন ধরিয়ে দিল, মেয়েদের ধর্ষণ করলো
ঠাকুরাণী: উমা, এতো নিষ্ঠুর!
মৃত্যুঞ্জয়: ওরাও কিন্তু ব্রাহ্মণ ছিল। আর সেদিন বাংলাকে রক্ষার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিল বৃদ্ধ আলীবর্দী খান, মুসলমান।
বৃন্দাবন: কিন্তু মুসলমানরা যে হিন্দুদের রক্ষা করতে পারবে ,সে বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেল।
মৃত্যুঞ্জয়: তাইতো, ধনীরা কলকাতায় এসে বসা শুরু করলো। ব্রাহ্মণরা এখানে এসে পূজাপাঠ ভুলে বেনিয়া বনে গেল।
বৃন্দাবন: তাই পূজা পাঠের ব্যাপারটা ছোটলোকেরাই চালিয়ে যেতে লাগল। ওই হাড়ি, ডোম, গোয়ালারা পূজা করে বলে ভদ্র লোকেরা যায় না ।
বৃন্দাবন: যাবে কেন? হাড়ি ডোম গোয়ালারা পুরোহিত হয়, কেউ শুনেছে?
মৃত্যুঞ্জয়: ডাকাতে কালীর পূজা ভদ্রলোকেরা করা শুরু করেছে। পূজা ছাড়া মানুষ থাকতে পারে না। সব ব্রাহ্মণতো আর কাছাড়িতে কাজ পাবে না। পুরোহিতগিরি করা আমাদের জাত ব্যবসা।
বৃন্দাবন: তাই বলে শালগ্রাম শীলা ছাড়া, অবৈদিক, অশাস্ত্রীয় পূজা।
মৃত্যুঞ্জয়: আরে ওদের মূর্তির সামনে তুমি একটা শালগ্রাম রেখে, শালগ্রামের পূজা করবে। ওরা ভাববে ওদের ঠাকুরের পুজো করছো। পূজা শেষে দক্ষিণা নিয়ে বাড়ি ফের।
বৃন্দাবন: মতলবটা খারাপ বলনি। তা যাবে নাকি একদিন।
মৃত্যুঞ্জয়: চলো। পূজারীর গলায় পৈতা দেখে দেখবে লোকে কেমন দৌড়ে আসবে। কলকাতাকে চাড়ালের হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে।

২ য় দৃশ্য-
ধর্মঠাকুরের থান। চারদিকে দড়ি সুতোর সাথে ইট ঝুলছে। ধূপের ধোঁয়ায় চারদিকে একাকার। পাঁঠা মুরগির চিৎকার। তাঁর মধ্যে’ জয়, ধর্ম ঠাকুরের জয়’ ধ্বনি উঠছে। বৃন্দাবন আর মৃত্যঞ্জয় দাঁড়িয়ে সব দেখে। এক খানি কালো পাথর, তার উপর পেতলের চোখ। পুজারি মন্ত্র পড়ছে –
যস্যান্তো নাদিমধ্যে নচ করচরনং নাস্তিকায়নিদানং/ নাকারং নাদিরূপং নাস্তি জন্ম ঝ যস্য। / যোগীন্দ্রো জ্ঞানগম্যো সকলজনহিতং সর্বলৌকৈকনাথং /
তত্ত্ব তঞ্চ নিরঞ্জনং মরবরদ পাতু নঃ শূন্যমূর্তি
(মন্ত্র শুনে দুজন দুজনের দিকে তাকায়।)
বৃন্দাবন : কিসের মন্ত্র।
মৃত্যুঞ্জয়: আমাদের অ-শাস্ত্র, কারো কাছে শাস্ত্র। দেখে যাও। ওই আসছেন-
বৃন্দাবন: নমষ্কার ঠাকুর মশায়।
শুদ্ধধন: নমষ্কার, ঠিক চিনতে পারলাম না।
মৃত্যুঞ্জয়: আমরা বেনিয়াদের গোলায় কাজ করি। দেখলাম সবাই পুজো করতে আসছে, তাই আমরাও এলাম।
বৃন্দাবন: তা কি ঠাকুর তোমাদের? এরকম চাল ছাওয়া নেই।
শুদ্ধধন: ধর্ম ঠাকুরগো, বড় জাগ্রত, যে যা মানত করে সেই তা পায়। কিন্তু ঠাকুর বড় রাগী, পূজায় কোনরকম ভূল হলে তাঁর সর্বনাশ করে ছাড়েন।
মৃত্যুঞ্জয়: তা তোমার ঠাকুর এই চালাঘরে কেন? একটা পাকা ঘর বানিয়ে দিতে পার।
শুদ্ধধন: তিনি চালা ঘরেই থাকতে ভালোবাসেন। গরিবের ঠাকুরতো। কেউ কোঠা ঘর করে দিতে চাইলে তার সর্বনাশ হয়ে যায়। আর দেখেন, তিনি যেখানে বসে আছেন, তার মাথার উপর চালে খড় নাই। কখনই থাকেনা।
বৃন্দাবন: তা, সারা বছরই কি এরকম পূজা হয়?
শুদ্ধোধন: না, বৈশাখ মাসে পূর্ণিমার দিন বিরাট মেলা হয়, সে মেলায় হাজার বারোশো পাঠা পড়ে, অনেক শূয়ার ও মুরগি পড়ে।
মৃত্যুঞ্জয়: বৈশাখী পূর্ণিমা, বুদ্ধের জন্ম তিথি।
বৃন্দাবন: সামনে দাওয়ার চালে অসংখ্য ঢিল ঝুলছে, ওগুলো কি?
শুদ্ধধন: কেউ কিছু মানত করলে, একটা ঢিল ঝুলায় আর ইচ্ছা পূর্ন হলে ঢিল গুলি খুলে নেয়।
মৃত্যুঞ্জয়: পূজা করে পান কেমন?
শুদ্ধধন: গরিব লোকেরা পুজো দিতে আসে। কতই বা দেয়। আর পুজোর দক্ষিণায় তো সংসার চলে না। দুধ বেঁচে ভালোই আয় হয়। সাহেব, ফিরিঙ্গি, ওরা ভালো দাম দেয়।
বৃন্দাবন: কিন্তু ভদ্র লোকেরাতো পূজো দিতে আসে না।
শুদ্ধধন: ওরা আমাদের ছোটলোক মনে করে। আমাদের ঠাকুরকে ওরা পূজা করবে কেন?
বৃন্দাবন: ভদ্রলোকেরা তোমাদের ঘৃণা করতে পারে কিন্তু তোমাদের ঠাকুরকে মানে। তাঁরাও পুজো করতে চায়।
শুদ্ধধন: তা করুক। আমরা তো বলি ঠাকুর সবার ভালো করুক।
মৃত্যুঞ্জয়: কিন্তু সমস্যা কি জানো? ওরা মনে করে পূজা করার অধিকার শুধু ব্রাহ্মণের।
শুদ্ধধন: এটা কি বললেন? তিনি দিন দুনিয়ার মালিক। তাঁর চোখে তো সবাই সমান। তিনি কি করে একটা জাতিকেই পূজার অধিকার দিতে পারেন?
মৃত্যুঞ্জয়: তোমরা পুজারি কি করে ঠিক করো?
শুদ্ধধন: ছোট থেকে পুজার কাজবাজ নিয়ম কানুন যারা পালন করে , তারাই পুজারি হয়।
বৃন্দাবন: ঠিক তাই। আমরাও বংশ পরম্পরায় পূজা করি।যাতে পূজার নিয়ম ঠিক করে মানা যায়।
শুদ্ধধন: কিন্তু, আপনারা পূজা শুরু করলে, লোকে তো আমাদের দিয়ে আর পূজা করাবে না।
মৃত্যুঞ্জয়: শোন, তোমাদের লোকদের পূজা তুমি করবে। আর আমাদের লোকদের পূজা আমি করবো।
শুদ্ধধন: কিন্তু, এটা আমার সমাজের লোক মানবে কেন? তোমরাতো আর আমাদের নিয়ম মেনে পূজা করবে না!
বৃন্দাবন: ঠিক, আরে ঠাকুর তো এক, তাকে যে যেভাবে ডাকে। এই কথা তোমার লোকদের বুঝাও। আর শোন আমি যত দক্ষিণা পাব তার অর্ধেক তোমার। কি এবার রাজী?
শুদ্ধধন: হ্যা, এতে আপত্তি করার কি আছে? আমরাতো আর সব সময় পূজা করি না। আমারা যখন পূজা করবো না তখন আপনারা পূজা করবেন। ঠাকুর বেশি বেশি সেবা পাবে। জয় ধর্মঠাকুরের জয়
বৃন্দাবন: জয় শিবের জয়।
৩য় দৃশ্য
রাত। পাকা ঘরে শিবলিঙ্গ। দরজা বন্ধ। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে শুদ্ধধন।
-একি আমার ধর্মঠাকুরকে শিবলিঙ্গ বানিয়ে দিল। শহর সংস্কারের নামে করে আমাদের জমি কিনে নিল। আমরা শহরথেকে দূরে চলে গেলাম। এই শহরের রাস্তা, বাড়ি তৈরি করলাম। ওই ব্রাহ্মণ দুটো বলেছিল, ওরা আমার ঠাকুর কে সসম্মানে পূজা করবে। এ কি সম্মান? আমার ঠাকুরকে ওরা কোথায় ফেলল? আমি লোভে পড়ে ঠাকুরকে বিক্রি করে দিয়েছিলাম তাই আমাদের এত কষ্ট। ঠাকুর আমি তোমায় খুঁজে বার করব। (চারিদিকে খুঁজতে থাকে। শেষে এক কোনে জঞ্জালের ঢিপের মধ্যে চোখ ওয়ালা পাথর খুঁজে পায়। জঞ্জাল সরিয়ে পাথরটাকে বুকে আঁকড়ে ধরে।) আমি আর তোমায় ছাড়ছি না। (এমন সময় দারোয়ানের আওয়াজ শোনা যায়-)

  • কোন হ্যায়?
  • আমি, শুদ্ধধন
  • কিয়া করনে ইহা আয়া?
  • ঠাকুর দেখতে।
  • দিনমে কিউ নাহি আয়া।
  • ঘুসনে নহি দেতা।
  • কিউ, কিয়া জাত হ্যায় তেরা?
  • ডোম।
  • ডোম হোকর মন্দির মে ঘুসনেকা হিম্মৎ কেইসে হুয়া?
  • হাম, এই মন্দিরের পুজারি থা।
  • হা হা ডোম আউর পুজারি ? হা হা
    (শুদ্ধ পাথরটা নিয়ে যাবার চেষ্টা করে।)
  • হেই, কিয়া লেকে যাতা?
  • কুছ নেহি, পত্থর। মেরা ভগবান।
  • ভগবান? পত্থর রাখ। ওর ভাগ ইহাসে।
  • নহী মেরা ভগবান কো ইহা নহি ছড়ুঙ্গা, (বলে পাথর বুকে আঁকড়ে দৌড় লাগায়।)
  • পাকড় পাকড় আরে ঠাকুর চোরি করে ভাতা হ্যায়। যা, শালা ভাগ।

তথ্য উত্স: হরপ্রসাদ শাস্ত্রী : বৌদ্ধ ধর্ম,
তপন মোহন চট্টোপাধ্যায়-পলাশির যুদ্ধ

আপনার কেমন লাগলো?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 1

No votes so far! Be the first to rate this post.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *