নমিতা দাসঃ নারী মুক্তির দিশারী হিন্দু কোড বিল (ছোট নাটক)

নারী মুক্তির দিশারী হিন্দু কোড বিল (ছোট নাটক)

নমিতা দাস

রচনা :-  ১২-০৫-২০২৩

একটি সাদামাটা সভামঞ্চে চারটি চেয়ারের সামনে চাদরে ঢাকা একটি টেবিল। তার পেছনে একটু উঁচুতে “মহামানব ড:ভীমরাও আম্বেদকরের ১৩২ তম জন্ম জয়ন্তী উদযাপন” লেখা ফ্লেক্স টাঙানো। টেবিলের পাশে সাদা কাপড়ে আচ্ছাদিত উঁচু চেয়ারে আম্বেদকরের বেশ বড় ফ্রেমে বাঁধানো ছবি রাখতে হবে । তার  গলায় ছবি ও ফটোর নীচে ছেঁড়া ফুল ছড়ানো ।

মঞ্চে দুটি চেয়ারে সভাপতি স্বপন কুমার মধু এবং শেষ বক্তা রমা রায় দাস বসে থাকবেন। বাকি দুটি চেয়ারে যে কেউ মধ্য বয়সী বসে থাকলে ভালো হয় ।

স্বপন মধু : বন্ধুগণ,  আপনারা সেই বিকেল চারটে থেকে ধৈর্য সহকারে বসে থেকে বাবাসাহেব ড: আম্বেদকরের প্রতিষ্ঠিত তফসিলী ফেডারেশনের  সভাপতি তরুণ তুর্কি চিরকুমার মৃত্যুঞ্জয় মল্লিক, জনদরদী ডাক্তার ও কবি শ্যামল কুমার বালা, পথসংকেত পত্রিকা সম্পাদক নারায়ন বিশ্বাস, রোডম্যাপ পত্রিকার সম্পাদক আব্দুর রহমান , সোজাকথা ও আসলকথা পত্রিকা সম্পাদক হরষিত সরকার , ভোরের আলো পত্রিকার সম্পাদক সুব্রত মন্ডল, সুরেশ্বর সরকার, গোপাল হালদার, নট-নাট্যকার সুবল দাস, নবীন দাস, সন্তোষ সরকার, অভিনেতা বাবুলাল দে মহাশয়দের মুখে দলিত বহুজনের মুক্তির জাগরণী ভাষন শুনেছেন । সেই সঙ্গে রাজু দাস রচিত ও নটসূর্য প্রানগোবিন্দ বিশ্বাস অভিনীত “আম্বেদকরের দিনলিপি” নাটকের জন্য এবং এই সুভাষ নগর কলোনির অধিবাসীদেরকে আজকের সভার সভাপতি হিসেবে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে আজকের সভার  মুখ্যবক্তার বক্তব্য শোনার জন্য আপনারা এখনো অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন সেই স্বনামধন্য বক্তা অভিনেত্রী, লেখক, নাটককার শ্রীমতী রমা রায় দস এবার তার সুললিত কন্ঠে বক্তব্য রাখবেন ।

আসুন ম্যাডাম ।

অনেকটা সময় আপনাকে বসিয়ে রেখেছি সে জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন ।

রমা রায়: ছিঃ ছিঃ এভাবে বলবেন না। আমি অন্যসব নামি দামি বক্তাদের মতো নই। যারা নিজেদের বক্তব্য পেশ করেই কেটে পড়েন । অন্যদের বক্তব্য শোনার প্রয়োজন বোধ করেন না। এমনকি তাঁরা কোনোদিন তাদের বৌ ছেলে মেয়েদের নিয়ে দলিত বহুজনের সভায় যান না। একমাত্র আমি এখনও পরিবারের সবাইকে নিয়ে প্রত্যেক সভায় আসি যাই। এর কারণ ওরাও যাতে সমৃদ্ধ হতে পারে।(মাইকে মুখ রেখে)

আজকের এই মহতী সভায় যারা আমার সামনে বসে অথবা দাঁড়িয়ে আছেন আপনারা সবাই আমার স্বশ্রদ্ধ প্রনাম গ্ৰহণ করুন।

আপনারা আমার পূর্ববর্তী বক্তাদের মুখে ড: আম্বেদকরের জীবনের অনেক কর্মকান্ডের কথা শুনেছেন। কিন্তু কেউ আম্বেদকরের জীবনে তাঁর মা দিদি পিসি এবং প্রথম স্ত্রী রমা বাই , তিনি মারা যাবার তের বছর পরে স্ব-ইচ্ছায় ব্রাহ্মন কন্যা বিয়ে করেছিলেন আম্বেদকর।  সেই ডাক্তার সারদা কবিরের অবদানের কথা কেউ বলেননি। আসলে পশ্চিমবঙ্গে “পুনাপ্যাক্ট” নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে। অথচ “হিন্দুকোড বিল” নিয়ে তেমন আলোচনা বা লেখালেখি হয়নি । কেন হয়নি!

তবে কি ভেবে নেব এখনো বঙ্গদেশের নারীরা অবহেলিত?  কেন নারীরা সুরক্ষিত নয়, ধর্ষণকারীর হাত থেকে?

সেই কারনেই ড: আম্বেদকর  নারীকে শাস্ত্রের নামে তার ন্যয্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা বা নারীকে পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ করে রাখার বিরুদ্ধে “হিন্দুকোড বিল” নিয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন।

আপনারা শুনলে অবাক হবেন  বর্ণহিন্দুদের অনেকেই বলেন – ড: আম্বেদকর নাকি পিছিয়ে রাখা সমাজের মানুষের জন্য আন্দোলন করেছেন।

ওদের এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। কারন ভারতের আইন-কানুন তথা রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হয় সংবিধানের মতাদর্শে।  যে সংবিধান রচনার মূল কারিগর ছিলেন ড:আম্বেদকর।

ড: আম্বেদকর তথাকথিত হিন্দু ধর্মের জাত-পাত, ছুয়া-ছুতের বৈষম্যক মুছে দিয়ে বিশ্ববরেণ্য দার্শনিক গৌতম বুদ্ধের সাম্য-মৈত্রী-ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে সমস্ত ভারতবাসীকে নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ রাখতে চেয়েছিলেন সংবিধানের মাধ্যমে।

তাছাড়া অনাদিকাল থেকে অন্তজ শ্রেণীর বিধবা নারীদের পুনরায় বিবাহের প্রচলন ছিল। ছিল পিতা মাতা ও স্বামীর সম্পত্তিতে অধিকার। ছিলনা বর্ণহিন্দু বিধবা নারীদের মতো সহমরণে যাবার কুপ্রথা। এসব জানা সত্ত্বেও ড: আম্বেদকর সকল বর্ণের নারীদের সুরক্ষা ও মঙ্গলের জন্য হিন্দু কোড বিল তৈরি করেছিলেন।

এবার আমি সেই বিতর্কিত হিন্দু কোড বিল নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।

কি ছিল এই হিন্দু কোড বিলে?

ছিল- হিন্দু নারীদের স্বামী বা পিতার সম্পত্তিতে অধিকার।

বিবাহ বিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহের অধিকার। ইন্টারকাষ্ট বিবাহের অধিকার। সন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকার। এবং পুরুষের বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করন।

মাত্র এই কটি নারীর অধিকারকে সুনিশ্চিত করতে বা আইনে পরিণত করার জন্য ড: আম্বেদকর ১১ই এপ্রিল ১৯৪৭ তারিখে এই বিলটি পাসের জন্য সংসদে পেশ করেছিলেন। তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলালজী এই বিলকে প্রথমে স্বাগত জানালেও কিছুদিন পরে বিক্ষুব্ধদের চাপে সমর্থন তুলে নেন। অন্যদিকে গোঁড়া এবং মনুবাদী সদস্যদের কাছে এই বিলটি ছিল হিন্দু ধর্মের উপর কুঠারাঘাত। যে হিন্দু সমাজে শূদ্র পুরুষের মতো নারীরও বেদপাঠ ও শিক্ষা গ্ৰহন করা ছিল নিষিদ্ধ। সেখানে হিন্দু কোড বিল আইনে পরিণত করা মানেতো হিন্দু নারীদের ব্যভিচারী হতে দেওয়া। তাই এই বিলের বিরোধিতায় নেতৃত্ব দিলেন স্বয়ং রাষ্ট্রপতি ড: রাজেন্দ্র প্রসাদ,  সরদার প্যাটেল,  সরদার ভুপেন্দ্র সিং, পন্ডিত মালব্য, এবং অখিল ভারত হিন্দু মহাসভার প্রধান ড: শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি। এই শ্যামা প্রসাদ মুখার্জিবাবুকে পরবর্তীতে দেখতে পাবো বাংলা ভাগের পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তখন তার ভাবনা ছিল মুসলিম ও অন্তজ মানুষদের দেশভাগের বলি হিসেবে পূর্ববঙ্গে ঢুকাতে পারলেই তিনি পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন। কিন্তু তার সে স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেছে। তো এই সময়ে ড:শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি বললেন- হিন্দু কোড বিল পাশ হলে স্বামী স্ত্রীর অচ্ছেদ্য বন্ধন ধংস করা হবে। তাই আইন মন্ত্রী হিসেবে ড: আম্বেদকরের এই বিল তুলে নেওয়া উচিত।

ড: আম্বেদকর বিল বিরোধীদেরকে শাস্ত্রীয় গ্ৰন্থের উদ্ধৃতি সহকারে বোঝানোর চেষ্টা করলেন –

(মঞ্চের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা আম্বেদকরের চরিত্রকে দিয়ে বলাতে পারলে ভালো। তাই সম্ভব না হলে নেপথ্য থেকে কেউ বলে দিলেও চলবে। সে সময় টুকু রমা ফ্রিজমুডে থাকবে)

আম্বেদকর: তথাকথিত হিন্দু নারীদের বিবাহ বিচ্ছেদ এবং নারীদের বহুবিবাহের বিষয়ে কৌটিল্য ও পরাশর স্মৃতি গ্ৰন্থে এবং নারীদের সম্পত্তির অধিকারকে বৃহস্পতি স্মৃতি গ্ৰন্থে সমর্থন জানিয়েছে। এমনকি কৌটিল্যের সময়কালে নারীর উপর পুরুষ কর্তৃক দৈহিক পীড়ন এবং মর্যাদাহানির জন্য বিচারালয়ে যেতে পারতেন। আসলে মনুসংহিতা সৃষ্টির পূর্ববর্তী যুগে নারীরা ছিলেন মুক্ত ও পুরুষের সমমর্যাদার সঙ্গী।

রমা রায় : এতে গোঁড়া মনুবাদী নেতাদের মন গলানো গেল না। তাঁরা কুতর্ক- বিতর্কের মাধ্যমে তিনটি বছর পার করে দিলো। যাতে হিন্দু কোড বিলটি পাস না হয়।

অন্যদিকে ১৯৪৯ সালের ১১ই ডিসেম্বর, দিল্লির রামলীলা ময়দানে আর এস এস, হিন্দু কোড বিলের বিরুদ্ধে সমাবেশ করে বলা হলো- অস্পৃশ্য মাহারের সন্তান আম্বেদকর বিদেশে নাস্তিক্যবাদের উচ্চশিক্ষা গ্ৰহন করে হিন্দু শাস্ত্রের অবমাননা করছেন হিন্দু কোড বিলের মাধ্যমে। আপনারা ভেবে দেখুন,  নারীদের সম্পত্তি ও বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার আসলেই হিন্দু ধর্মের ওপর পরমানু বোমার মতো আঘাত নয় কী?  তাই এই হিন্দু কোড বিলের বিরুদ্ধে সমস্ত হিন্দুদের রুখে দাঁড়াতে হবে।

বাবাসাহেব আম্বেদকর দৃঢ়চেতা লড়াকু মানুষ। সেই শৈশব থেকে তিনি একের পর এক বাঁধা বিপত্তির দূরলঙ্ঘ পাহাড় পেরিয়ে বিশ্ববরেণ্য হয়ে উঠেছেন। তাঁকে রোধ করা কি এতই সোজা!

তাই তিনি আবার বললেন- আম্বেদকর: মাননীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ , ভারতের সংবিধান রচনার যে গুরুদায়িত্ব আপনারা আমাকে দিয়ে সম্মানিত করেছেন। সেই সংবিধান রচনা করাটা আমার কাছে যতট গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ এই হিন্দু কোড বিল । কেননা আর্থিক সামাজিক প্রভৃতি বিষয়ে নারীকে তার মানবধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তাই এই হিন্দু কোড বিল আইনে পর্যবসিত করার আপ্রাণ চেষ্টা আমার। তাছাড়া এটি হিন্দু কোড বিল হলেও এতে হিন্দু বৌদ্ধ শিখ সম্প্রদায়ের নারীরাও উপকৃত হবেন ।

রমা রায়: জানেন, বাংলা ভাষায় একটি প্রবাদ আছে “চোরেরা না শোনে সাধুর কথা” মাফ করবেন, আমি কিন্তু বিজিমূলের নেতা আমলা মন্ত্রী চোরদের কথা বলিনি।

যাহোক বিরোধীরা আবার যখন হিন্দু শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে প্রতিবাদ জানাল,  তখন বাবাসাহেব পুনরায় শাস্ত্রগ্ৰন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বললেন –

আম্বেদকর : মাননীয় সংসদগণ,  আপনারা জেনে খুশি হবেন অথর্ববেদে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা আছে – নারীদের উপনয়নের অধিকার আছে। এমনকি ব্রহ্মচর্যের পরে কিশোরীরা বিবাহযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবর।

সৌতসূত্র গ্ৰন্থ থেকে জানা যায়, ততকালে নারীরা বেদমন্ত্র উচ্চারণ করতে এবং তাদের গুরুগৃহে বেদ পাঠৈর শিক্ষা দান করা হতো। ঠিক এই কথাটি লেখা আছে পানিনির অষ্টাধ্যায়ে। যোগাচার্য্য পতঞ্জলির মহাভাষ্যে লেখা আছে নারীরা শিক্ষকতার মাধ্যমে অন্য সকল ছাত্রীদের বেদ শিক্ষা দিতেন। এছাড়া ধর্ম, দর্শন এবং আধ্যাত্মবিদ্যার মতো বিষয়গুলো নিয়ে নারী পুরুষের মধ্যে আলোচনা,  বিতর্কের বহু কাহিনী পুরাণগ্ৰন্থে লেখা আছে। তবুও দু’ একটি উদাহরণ আমি দিচ্ছি যেমন,  একাধিক সভায় জনক এবং সুলতার বিতর্ক হয়েছে।

যাজ্ঞবল্ক এবং গার্গীর মধ্যে বিতর্ক হয়েছে। এমনকি শংকরাচার্য এবং বিদ্যাধরীর মধ্যে বিতর্কের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। মনুসংহিতার পূর্ববর্তী যুগে বেশ কিছু নারী ঞ্জান-বিঞ্জানের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছিলেন। এই সকল দৃষ্টান্ত আছে গ্ৰন্থে।

রমা রায়: অথচ সুমিত ভার্গব মনুসংহিতা নামক একটি সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক অনৈতিক বিভেদকামি গ্ৰন্থে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর শূদ্র পুরুষদের হেয় প্রতিপন্ন করেই ক্ষান্ত হননি,  শিক্ষা ও মন্দির অঙ্গনের দ্বার বন্ধ করেছে। এমনকি ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র সমস্ত মহিলাদের জন্য ফতোয়া জারি করেছে, – নারী নরকের দ্বার,  নারীকে স্বাধীনতা দেওয়া চলবে না। বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার থাকবে না,  নারীর সম্পত্তির অধিকার থাকবে না, শিক্ষার অধিকার থাকবে না, পুজো অর্চনা করতে পারবে না। মোদ্দাকথা নারীর বুদ্ধিবৃত্তি, স্বাধীন ইচ্ছা বা চিন্তাধারাকে রোধ করতে হবে। এই বিষয়ে বলতে গিয়ে আমার মনে পড়লো, ১৯৪৩ সালের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে পুনা শহরে মি: রাজভোজ আয়োজিত জনসভায় ড: আম্বেদকর বলেছিলেন – পুরাকালে লেখা সমস্ত ধর্মীয় গ্ৰন্থগুলি এক একটি রাজনৈতিক বই। আর গীতা অবশ্যই রাজনৈতিক গ্ৰন্থ। এসব গ্ৰন্থের মূল উদ্দেশ্য হলো বেদ বর্ণিত শিক্ষাকে উর্ধ্বে তুলে ধরে ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা।

আপনারা শুনলে অবাক হবেন, গীতা নামক রাজনৈতিক গ্ৰন্থের নবম অধ্যায়ে লেখা আছে, পাপ যোনি থেকে নারীদের সৃষ্টি। তাই নারী মাত্রই শূদ্রানী অসুচি অপবিত্র । আপনারা ভাবতে পারেন এভাবে নারীদের অপমান করেছে গীতার পুরুষ রচয়িতা ! যা হোক,

বাবাসাহেব আম্বেদকর হিন্দুদের সমস্ত শাস্ত্রগ্ৰন্থ পাঠ করেছেন বলেই তিনি তাঁর ” হিন্দু ধর্মের হেঁয়ালি ” গ্ৰন্থে লিখেছেন মনুসংহিতা প্রসঙ্গে  –

আম্বেদকর:-  মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতা হলো আইন ও নীতিশাস্ত্র বিষয়ক একটি গ্ৰন্থ । এতে ধর্ম, নীতিকথা, জাতপাত, ছুয়া-ছুত সম্পর্কে লেখা আছে। তাই হিন্দু ধর্মের বিভেদমূলক মনুস্মৃতি গ্ৰন্থকে আমি ১৯২৭ সালের ২৫ শেষ ডিসেম্বর সর্ব সম্মুখে দাহন করার পরে বলেছিলাম – হিন্দু ধর্মের চতু্বর্ণ ব্যবস্থাকে নির্মূল করার জন্য আমি এই মনুস্মৃতি গ্ৰন্থটি পুড়িয়েছিলাম ।

প্রসঙ্গত বলি, পূর্বে অনুমতি নেওয়া সত্ত্বেও মনুবাদীরা পূর্ব নির্ধারিত জায়গায় সভা করতে দেয়নি। তখন ফত্তেখান নামক একজন হৃদয়বান মুসলমানভাই তার জমিতে আমাদেরকে মনুস্মৃতি দাহণ সভা করতে দিয়েছিলেন ।

আজকে বেশ মনে পরছে আমার রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু জ্যোতিরাও ফুলে ও গুরুমাতা সাবিত্রীবাই ফুলেকে যখন বর্ণ হিন্দুরা পাঠশালা করার জন্য বাড়িভাড়া দেয়নি তখন রহিম শেখ নামের মুসলিমভাই বিনা ভাড়ায় তার বাড়িতে ১৮৪৮ সালে পাঠশালা করতে দিয়েছিলেন । এমনকি তাঁর বোন ফাতিমা শেখকে সাবিত্রীবাই এর মতো শিক্ষকতা করার অনুমতি দিয়েছিলেন।

সেদিনের মনুসংহিতা দাহন সভাতে উপস্থিত সকলে শপথ নিয়েছেন –

১, মনুসংহিতা চার বর্ণ প্রথায় আমি বিশ্বাস করবো না

২, আমি জাতিভেদ প্রথার বিশ্বাস করবো না

৩, অস্পৃশ্যতাকে নির্মূল করবো

৪, পরিশুদ্ধ জল , বাসস্থান, রোজগার, শিক্ষা পাবার অধিকার আমি অর্জন করব

রমা রায়: মোটকথা, বারবার আম্বেদকর হিন্দু কোড বিল আইন সভায় আলোচনার জন্য পেশ করেন আর বিরোধীরা বানচাল করেন। সে সময় একমাত্র তেজস্বী স্পষ্ট বক্তা শ্রীমতী পদ্মজা নাইডু হিন্দু কোড বিলের মাধ্যমে ভারতীয় সমাজ পরিবর্তনের প্রয়াসের জন্য ড:আম্বেদকরের ভুয়সী প্রশংসা করে বলেন –

পদ্মজা : (নেপথ্য কন্ঠ ) আমি পদ্মজা নাইডু, আম্বেদকর সাহেবের প্রস্তাবিত হিন্দু কোড বিলটির প্রতি আমার দ্বিধাহীন সমর্থন ব্যক্ত করছি । তার কারন দীর্ঘ দিনের মহিলাদের প্রতি অসাম্যের আইনের হাত থেকে অনেকটা মুক্তির স্বাদ মিলবে । যে মুক্তি অনেক আগেই পাওয়া উচিত ছিল। যেহেতু হাজার হাজার হিন্দু নারী তাদের গৃহস্হালী ছেড়ে এসে জীবনে প্রথমবার ভারতের স্বাধীনতা লড়াইতে বীরোচিত লড়াই করতে গিয়ে তাঁরা লাঠির আঘাত সহ্য করে জেলে গেছেন । এমনকি মৃত্যুর চাইতেও অধিক বিড়ম্বনা ও অপমান সহ্য করেছেন ।  অনেকে শহীদ হয়েছেন । কাজেই নারীর ন্যয্য অধিকার এই সরকার ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হওয়া উচিত।

আজ যদি ড:আম্বেদকরের তৈরি করা হিন্দু কোড বিলের মাধ্যমে মহিলাদের ন্যায্য দাবি না মানা হয়, তাহলে তা হবে স্বাধীনতার কলংক।

রমা রায়: পদ্মজা নাইডুর বিবৃতি শোনার পরেও সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী।

মাননীয় জহরলাল নেহরু বিরোধীদের চাপে , নারী মুক্তির এই হিন্দু কোড বিলটি ধামাচাপা দিয়ে রাখলেন।

অগত্যা – সুদীর্ঘ চার চারটি বছর যাবত অনেক যুক্তি তর্ক বিতর্কের পরেও যখন হিন্দু কোড বিল পাশ করাতে পারলেন না, তখন ক্ষোভে দু:খে আইন মন্ত্রীর পদত্যাগ পত্রটি ১৯৫১ সালের ২৭ শে সেপ্টেম্বর দাখিল করে বাবাসাহেব বললেন – হিন্দু ধর্মের বর্ণ ব্যবস্থাকে নির্মূল করার জন্য আমি মাত্র একটি মনুস্মৃতি দাহণ করার এতো বছর পরেও বেশ বুঝতে পারছি আজও স্বধীন ভারতে জাতবিরোধী আন্দোলন অসম্পূর্ণ । তাই ব্রাহ্মণ্যবাদী, নারী বিদ্বেষী জননেতা মন্ত্রীদের মন থেকে মনুবাদী ধ্যান ধারণার এক বিন্দুও পরিবর্তন করাতে পারিনি । পারিনি মনুস্মৃতিকে ধংস করতে ।

রমা রায় : যদিও উদারমনা জনসাধারণের চাপে ১৯৫৫ – ৫৬ সালে হিন্দু কোড বিলের চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তত্কালীন ভারত সরকার ।এই হলো হিন্দু কোড বিলের সারমর্ম ।

এবার  বাবাসাহেব মহিলাদের জন্য আর কি কি করেছেন সেই বিষয়ে দু চারটে কথা বলেই আমি আমার বক্তব্য শেষ করব ।

আজকে যে সকল মেয়েরা সরকারি অফিসে প্রসবকালীন সবেতন ছুটি পাচ্ছেন, এমনকি পুরুষের সমহারে বেতন ও আট ঘণ্টা ডিউটি করতে পারছেন, এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে চাকরি পাচ্ছেন, এ সবই বাবাসাহেবের বদান্যতায়।

যদিও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অনুপ্রেরণাদেবী এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের সবকটি ঘরে তালা লাগিয়েছেন । যাতে সরকারি চাকুরির পদগুলো  লক্ষ লক্ষ টাকায় বিক্রি করে আমলা নেতা মন্ত্রীরা কোটিপতি হতে পারবেন। এবং অল্পকিছু চাকুরী নিজেদের পার্টি কর্মীদের দিতে পারবেন ।

যাই হোক, এবার আপনারাই ভেবে দেখুন, এই সকল সাংবিধানিক অধিকার গুলো শুধু দলিত বহুজন নারীদের জন্য নাকি সকল বর্ণের নারী পুরুষের জন্য ?

এবার সর্বশেষ একটি কথা বলেই শেষ করব ।

আজকে বিশ্বব্যাপি যে মহামানব বিশ্ববরেণ্য আম্বেদকরের জন্মজয়ন্তী পালিত হচ্ছে, সেই আম্বেদকর হয়ে ওঠার পেছনে তার স্ত্রী রমা বাইয়ের অবদানকে ভুলে গেলে চলবে না। ভুলে গেলে চলবে না, এ বিশ্বের প্রত্যেকটি সফল পুরুষের জীবনে সহযোদ্ধা হিসেবেও নারীর ভূমিকা অপরিসীম। তাই দলিতমুক্তি আন্দোলনে পুরুষের সাথে নারীদেরকেও সামিল হতে হবে। যেহেতু নারী পুরুষের সংখ্যা সমান সমান ।

আজকে গুমা সুভাষ নগরের এই সুশৃঙ্খল সভাকে পরিচালনা করার জন্য যেমন স্বপনকুমার মধু, সঞ্জয় কুমার মধু, শ্রম দিয়েছেন, তেমনি ঝর্ণা মধু ও মায়া মধুও শ্রম দিয়েছেন। এই সভার শেষ বক্তা হিসেবে বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই সভাতে পুরুষ দর্শকের চাইতে মহিলা দর্শকের উপস্থিতি ছিল অনেক বেশি। মা একমাত্র মতুয়া ধর্মানুষ্ঠানেই দেখা যায় । তাই আপনাদের সবাইকে আম্বেদকরবাদী অভিনন্দন জানাচ্ছি । নীল সেলাম। জয় ভীম , জয় ভারত ।

আপনার কেমন লাগলো?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 1

No votes so far! Be the first to rate this post.

1 Comment

  1. ইতিপূর্বে চতুর্থ দুনিয়া ও গণসংস্কৃতি পত্রিকায় নমিতা দাসের দলিত মুক্তির দিশারী হিন্দু কোড বিল, নাটকটি পড়েছি। এমনকি ইতিপূর্বে হৃদয়পুর আম্বেদকর মিশন সভাগৃহে ও পলতার কল্যানগড়ে অভিনীত শো দেখেছি । ভালো অবশ্যই লেগেছে তবে আর একটু সম্পাদনা করা উচিৎ ছিল ।
    এই সাইটে পোস্ট করার জন্য ডা: স্বপন কুমার বিশ্বাস ও চতুর্থ দুনিয়ায় প্রকাশের জন্য ড: অসিত বিশ্বাসকে নীল সেলাম ।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *