রবীন্দ্রনাথ

ইতিহাসের উপেক্ষিত অধ্যায়:নমঃশূদ্র সম্মেলনে রবীন্দ্রনাথ

নমঃশূদ্র সম্মেলনে রবীন্দ্রনাথ

অতুলকৃষ্ণ বিশ্বাস,পিএইচ ডি

এক শতাব্দীর পূর্বে ১৯১৩ সালে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হন। এশিয়ার তিনিই প্রথম এই বিরল সম্মানে ভূষিত হন। সেই স্বীকৃতির ১৩ বছর পরে ১৯২৬ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে কবি[তৎকালীন]  পূর্ববঙ্গ বর্তমান বাংলাদেশসফরে যান; তাঁর বয়স তখন ৬৫ বছর। সম্ভবতঃ এই ছিল তাঁর শেষ পূর্ববঙ্গ ভ্রমণ। ঢাকা, ময়মনসিং জেলা হয়ে কুমিল্লায় গিয়ে কবি নমঃশূদ্র বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন।[1] ৯৬ বছর পূর্বের সেই ঐতিহাসিক ঘটনা বাঙালী কখনও স্মরণ করেনি।  পাছে কেউ স্মরণ করে এবং এই তথ্য সাধারণ ও অভাজনদের চমকিত এবং অবিভূত করে ফেলে, তাই বাঙালীর স্মৃতি থেকে একেবারে মুছে ফেলার পাকাপাকি ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই কুকর্মটি যারা করেছেন, তাঁরা সমাজের উচুতলার মানুষ, এদেশের সর্বাঙ্গীন প্রগতির কাঁটা। 

বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত, নানা জাতি সহ ব্রাহ্মণ, বৈদ্য এবং কায়স্থ সম্প্রদায় অনেক ধুমধাম করে স্বজাতি সম্মেলন আয়োজন করতেন। উঁচু জাতের গণ্যমান্য মানুষ তাঁদের স্বজাতি সম্মেলনে যোগদান করতেন। কিন্তু কবি অন্য কোনও জাতের সম্মেলনে কখনো যোগ দান করেছেন বলে জানা যায়না। প্রথম বাঙালী নবেল জয়ী অস্পৃশ্যদের সম্মেলনে গিয়ে তাঁদের সম্মেলন ও আয়োজকদের এক সম্পূর্ণ আলাদা মর্যাদা প্রদান করেছিলেন। সমাজ নমঃশূদ্রদের প্রতি কবির এই উদার ও অকপট মানবিক ব্যবহার, মনে হয়, ছিদ্রান্বেষী, গরল জিহ্বা বাঙালী বুদ্ধিজীবি সরল ও প্রসন্ন মনে গ্রহণ করেন নি। ১০ই ফেব্রুয়ারি ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দ, ২৮ মাঘ ১৩৩২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকার জগন্নাথ কলেজে ভাষণ দিয়েছিলেন। কলেজটি তখন ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত ছিল। এই উপলক্ষে সংবাদপত্রে নিম্নোক্ত সংবাদ পরিবেশিত হয়েছিলঃ – 

“গতকল্য রাত্রিতে জগন্নাথ ইন্টার মিডিয়েট কলেজ ভবনে রবীন্দ্রনাথ একটি সাধারণ সভায় বক্তৃতা প্রদান করেন। বক্তৃতার একস্থানে তিনি বলেন,

“…….গ্রামগুলি যেই সুগঠিত হইতে থাকিবে, অমনিই হিন্দু এবং মুসলমানের বিরোধ-বিদ্বেষ সব দূর হইবে। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে এই সমস্ত বিরোধ-বিদ্বেষের কারণ প্রধানতঃ অর্থনৈতিক। কোন বিশেষ প্রশ্নের সমাধানের দ্বারা এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নহে। দেশের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের দ্বারাই উহা সম্ভব।”

         এবার দেশ হিতের জন্য কী করণীয় এবং তাঁর পরিকল্পনায় দেশের হিন্দুদের কী করা উচিত সেই বিষয় জগন্নাথ কলেজে কবি সংবেদনশীল এবং দূরদর্শিতাপূর্ণ বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি জানতেন অস্পৃশ্যতা দিয়ে সমাজ নমঃশূদ্রের দূরে ঠেলে দিয়েছে। তাই কবির গুরুত্বপূর্ণ সংযোজনঃ –

“নমঃশূদ্রের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়া হিন্দুরা দুর্ব্বল হইতেছে। নমঃশূদ্র সমাজ হিন্দু-জাতির একটি প্রয়োজনীয় অংশ; এই কথা মনে করিয়া তাহাদের প্রতি সহানুভূতিপরায়ণ হওয়া হিন্দু সমাজের কর্তব্য। উপসংহারে কবি বলেন, আপনারা সকলেই দেশের প্রতি আপনাদের যে কর্তব্য রহিয়াছে, সাধুতা ও আন্তরিকতার সহিত সেই কর্তব্য উদযাপন করিতে চেষ্টিত হউন, তাহা হইলেই দেশের মুক্তির পথ প্রশস্ত হইবে।” [2]

         কি বললেন কবি? “নমঃশূদ্রের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়া হিন্দুরা দুর্ব্বল হইতেছে।” ১৯২১ সালে বাংলার মোট হিন্দুর সংখ্যা ২,০৮,০৯,১৪৮; [3] তাদের ২০,০৬,২৫৯ জন নমঃশূদ্র।[4]অস্পৃশ্য এই জাতিটি হিন্দুর ৯.৬%। তাদের উপেক্ষা করে হিন্দু সমাজ দুর্বল হয়ে পড়ছে? বাঙালির বিশ্বকবি কি সেদিন অন্ত্যজ তোষণে ব্রতী হয়েছিলেন? কিন্তু কথাটি শুধু বড় সত্য নয়, অতি গুরুত্বপূর্ণ। নমঃশূদ্র বাঙলার ৯.৬% মানুষ। তাঁদের শুধু উপেক্ষা করা হয়নি; জাতবর্ণ ব্যবস্থার কারণে তাঁরা নিরন্তর অত্যাচার, অপমান, বৈষম্য এবং নিগৃহের শিকার।  সবর্ণদের ভাষায় ও দৃষ্টিতে ছোটজাতের মানুষ “বাজেলোক” গণ্য হয়ে এসেছে। তাঁদেরই ৯.৬% নমঃশূদ্র। তাঁদের প্রতি রবীন্দ্রনাথের সহমর্মিতা ও উদ্বেগ অভিজাত সমাজ  সু-নজরে দেখেনি। ঐ সময় ব্রাহ্মণ, ১৩,০৯,৫৩৯; বৈদ্য, ১,০২,৯৩১ এবং কায়স্থ, ১২,৯৭,৭৩৬ জন। [5] অতএব ১৯২১ সালে তাদের ত্রয়ীর যৌথ সংখ্যা ২৭,১০,২০৬ জন—বাঙালী হিন্দুর ১৩%। জনগণনা অনুসারে নমঃশূদ্র বাঙলার অস্পৃশ্যদের সব চেয়ে বৃহত্তম সম্প্রদায়। রাজবংশীদের সংখ্যা তখন ১৭,২৭,১১১। [6]

১০ ফেব্রুয়ারি ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দে কবি জগন্নাথ কলেজে গিয়েছিলেন। অন্যান্য কাজকর্ম শেষে ঢাকা থেকে তিনি কুমিল্লা পৌঁছেছিলেন। ২২শে ফেব্রুয়ারি কুমিল্লায় তিনি  নমঃশূদ্র সন্মেলনে যোগ দেন। ১৯৪১ সালে কবির তিরোধানের পরে কলিকাতা কর্পোরেশন কর্তৃকপ্রকাশিত গেজেটের বিশেষ স্মারক সংখ্যা জানিয়েছেঃ

“Goes to Dacca on 7th February at the invitation of the University; receives addresses from the Dacca Municipality, the Peoples Association and other bodies; speaks at several meetings and functions; also at Mymensingh; at Comilla presides over the anniversary of Abhay Ashram of Dr Suresh-chandra Banerjee; attends the Namasudra (Depressed Classes) conference; is warmly received at Agartala by Maharaj Kumar Brajendra Kishore of Tippera; on return to Santiniketan, his 65th birth- day (May 7, 1926) is celebrated by a gathering representative of many nations…..” [7]

 ৭ আগস্ট, ১৯৪১ সালে কবি পরলোক গমণ করেন। কবির স্মৃতিতে তাঁর মৃত্যুর ২৭ দিন পরে ৩ সেপ্টেম্বর কলিকাতা কর্পোরেশন গেজেটের স্মারকসংখ্যারসম্পাদক ছিলেন কবির স্নেহভাজন এবং অনেক ভ্রমণসঙ্গী অমল হোম। গেজেটের সেই বিশেষ সংখ্যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দীর্ঘ, বিচিত্র ও বর্ণময় জীবনব্যাপী কর্মকাণ্ডের উপর আলোকপাত করেছে। সেখানে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে ১৯২৬ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে কবি পূর্ববঙ্গ ভ্রমণে গিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভাষণ দেন। ঢাকা পৌরসভা ও ঢাকায় তাঁকে গণসম্বর্ধনা দিয়েছিল। নানা নাগরিক সভা থেকেও কবির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়েছিল। ঢাকা থেকে তিনি ময়মনসিংহ গিয়েছিলেন। তারপর কবি কুমিল্লায় গিয়ে ডঃ সুরেশচন্দ্র ব্যানার্জীর অভয় আশ্রমে বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। এখানেই নবেল জয়ী নমঃশূদ্র সম্মেলনে যোগদান করেন। কলিকাতা কর্পোরেশন স্মারক গেজেটের ভাষায় কবি “attends the Namasudra (Depressed Classes) conference.”  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুমিল্লা নমঃশূদ্র সম্মেলনে যোগদানের কথা  নিয়ে বাঙলা সাহিত্যে কোন চর্চা, আলোচনা, বিশ্লেষণ তো দুরের কথা, সম্পর্কে সামান্যতম উল্লেখ খুঁজে পাইনি।  গবেষণা তো হয়ই নি।

এক মহান কবির জীবন থেকে সমাজজীবনের এমন এক অতি গুরুত্ব পর্ব বাংলাসাহিত্য থেকে একশ্রেণীর মানুষ হায়নার নৃংশতায় খুবলে, উপড়ে ফেলে দিয়ে বর্বরতার নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। অন্য দিকে সংবেদনশীল মনের যে জানালা করি বাঙলার অস্পৃশ্যদের সামনে উন্মোচিত করেছিলেন, সে কথা বিশ্ববাসী জানতেই পেলেন না। কেন তিনি বাঙলার এক বিশাল অভাজন, অনাদৃত শ্রেণীর ডাকে তাদের পাশে ছুটে গিয়েছিলেন? অনাবিল সরলতায় সব কিছু তিনি হয়ত ঐ তাদের সভায় বলেছিলেন। সেই কথার কোন সংকলিত ভাষ্য আমাদের পর্যন্ত পৌঁছায়নি। এ এক শিক্ষিত শ্রেণীর মানবিক দীনতার কারণে অপূরণীয় অভাব ও শূন্যতা ছেয়ে আছে। সভ্যতার প্রতি তথা কথিত ভদ্র সমাজের তুলনাহীন নৃশংসতা! 

    কে জানে কুমিল্লায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নমঃশূদ্র সম্মেলনে যোগদানের পর এই শ্রেণীর মানুষের এক সমবেত জিগীর ও ক্রুদ্ধ হুঙ্কার  আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলেছিল কিনাঃ “দেখ,  দেখ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চন্ডাল আরাধনায় মগ্ন।” কুমিল্লা নমঃশূদ্র সম্মেলনের ৪ বছর পূর্বে—১৯২২ সালে—মুকুন্দবিহারী মল্লিক কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পালি অধ্যাপক নিযুক্ত হন। স্বয়ং ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়  তাঁকে ডাকিয়ে এনে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ পদে নিযুক্ত করেছিলেন। তখন একদল কুৎসাকীর্তনে অবতীর্ন হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন মুখরিত করেছিলেন,“কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চণ্ডালের আরাধনা করা হচ্ছে।”[8]

পালিভাষার শিক্ষকের দিকে আঙ্গুল তুলে মুকুন্দ বিহারী মল্লিককে এই বলা হত। একই ভাবে বহু যোগ্য মানুষকে নিযুক্ত করে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়  বিশ্ববিদ্যালকে উচ্চস্তরের প্রতিষ্ঠা গড়ে তুলেছিলেন, যা বাঙালির গর্ব ও শ্লাঘার ঐতিহ্য। কিন্তু পালি শিক্ষক জাতে নমঃশূদ্র, অতঃ  ব্রাত্য, অস্পৃশ্য; তাঁর প্রতি বঙ্গবাসীর লালিত ঘৃণা এবং বিবমিষার উত্তাল প্রবাহ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালকে ধাপার মাঠের তুল্য করে ফেলেছিল বললে কি অত্যুক্তি হবে? ছোটখাটো, অজ্ঞ, অশিক্ষিত, অসংস্কৃত মানুষের চেষ্টায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালের প্রাঙ্গনে মুকুন্দ বিহারী মল্লিক এমন হেনস্থার শিকার হয়েছিলেন মনে করা আদৌ অসমীচীন নয়; উঁচুদরের কলাকুশলী, সহযোগী ও সংগতকারীদের কুশল ব্যবস্থাপনা, নির্দেশনা এবং সংযোজনায়  এমনটি ঘটেছিল বলেই অনুমান করি।

ঐ অন্ত্যজ সন্মেলনে কবি কি বলেছিলেন অথবা সম্মেলন আয়োজকদের পক্ষ থেকে তাঁর কাছে কী বক্তব্য পেশ করা হয়েছিল তা নিয়ে সংবাদদাতা আশ্চার্যজনক এবং মৃন্ময় মৌনতা অবলম্বন করেছেন। সংবাদ মাধ্য সেদিন  নীচের তথ্যটুকু মাত্র পরিবেশনক’রেছিল।

“গত ১৯শে ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রাত্রে রবীন্দ্রনাথ সদলবলে কুমিল্লা পৌঁছেন। তাঁহার শরীর অসুস্থ থাকায় ষ্টেশনে তাঁহাকে কোন বিপুল অভ্যর্থনা দেওয়া হয় নাই। …………কবিকে মোটরে করিয়া অভয় আশ্রমে আনা হয়। কবির সঙ্গে ছিলেন শ্রীযুক্ত রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁহার পত্নী ও কন্যা, শ্রীযুক্ত দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্রীযুক্ত কালীমোহন ঘোষ ও শ্রীযুক্ত মরিস।”

         অভয় আশ্রমে অনুষ্ঠিত বার্ষিক নমঃশূদ্র সম্মেলনের খবর পরিবেশন ক’রে সংবাদদাতা সংযোজন ক’রেছিলেনঃ-

“২২শে ফেব্রুয়ারি সোমবার বৈকালে আশ্রমে……নমঃশূদ্র সন্মিলনের অধিবেশন হইয়াছিল।………..শ্রীযুক্ত সুরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভয়াশ্রমে নমঃশূদ্র সম্মিলনী বসিয়াছিল। ঢাকা, ফরিদপুর, খুলনা, যশোহর, নোয়াখালি প্রভৃতি স্থান হইতে প্রতিনিধিগণ আসিয়াছিলেন। সভায় নমঃশূদ্র সমাজের হিতকর অনেক কথা আলোচনা হয়। কয়েকজন নমঃশূদ্র মহিলা ইহাতে যোগ দিয়াছিলেন। রাত্রিতে শ্রীযুক্ত সুরেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় মহাশয় ছায়াচিত্র সহযোগে অস্পৃশ্যতা সম্বন্ধে এক বক্তৃতা দেন।” [9]

               দীর্ঘ সময় ধরে রবীন্দ্র চর্চার বিশাল পরিধি আমাদের অপার আনন্দ ও বিষ্ময়ের কারণ। আনন্দের কথা, তিরোধানের ৭৯ বছর পরেও কবির সৃষ্টির প্রতি  আপামর বাঙালীর আকর্ষণের তীব্রতা মোটেই হ্রাস পায়নি বা শিথিল হয়নি। অন্ত্যজ নমঃশূদ্র সমাজের প্রতি একটা অসামান্য উদার ভুমিকা কবি পালন করে গেছেন সে কথা কোনও বুদ্ধিজীবীর মন কেন স্পর্শ করেনি, এও এক বিষ্ময়কর ধাঁধা। নির্দ্বিধায় বলতে চাই, তাঁর ভক্তসাধকদের এই সজ্ঞান ঔদাসিন্য সদ্বুদ্ধি ও বিবেকবান মানুষকে ব্যথিত বা বিব্রত করা উচিত। এ তাঁদের ক্ষমাহীন হীনতা। “ওপাড়ার ধারে” নয়,  কবি একবার যখন তাঁদের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিলেন, তখন জাতপাতের টানাটানিতে জাত-মোড়লদের বুঝি হিসাবে লেনে নি? কিন্তু খবরের সেন্সর বলে দিচ্ছে যে, তাঁর ব্যবহার বাঙলার রক্ষচক্ষু মোড়লদের ভাল লাগেনি। দীর্ঘ, ক্লান্ত জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে তাই কি তাদের ব্যবহার আর আচারনে ব্যথিত মানুষটি জীবনের অন্তিম প্রান্তে দাঁড়িয়ে এক চিঠিতে লিখে গেছেন, “পুনর্জন্ম যদি হয়, আমি বাঙালায় জন্ম নিতে চাইনা।”

“And the last prayer of my tired life is that if there be rebirth may I not be born in Bengal again. [……..] I am an outcast, let my lot be cast among those whose conduct does not conform to the Shastras (scriptures)…….”[10]

আমি ব্রাত্য, অস্পৃশ্য, যাদের আচার-আচরণ শাস্ত্রসম্মত নয় তাঁদের মধ্যেই যেন আমাকে ঠাঁই দেওয়া হয়।  

অভিজাত বাঙালীর জন্য কবি রচিত এই প্রশস্তি তাঁদের মহামূল্যবান অভিজ্ঞান পত্র। পুনর্জন্ম  আমি বাঙালী হয়ে জন্ম নিতে চাই না। কী কষাঘাত! কী নির্মম ধ্বিক্কার! ভর্ৎসনায় কী স্ফুলিঙ্গ!!!

লর্ড টমাস ব্যাবিংটন মেকলে, কুমারী ক্যাথারিন মেয়ো, লর্ড কার্জন যারা বাঙালীর অশেষ নিন্দার শিকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাশে pigmy—বামন, অতিক্ষুদ্রকায় জীব।

দাম্ভিক, ছিদ্রান্বেষী, গর্বিত বাঙালী এত নির্মম চাবুক নীরবে হজম ক’রে গেছে? তাদের প্রতি নিবেদিত উৎকৃষ্টতর উপহারের উদাহরণ তো আর পড়িনি! কবি আজীবন যে- অফুরন্ত কাব্য, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, গান রচনা করে গেছেন তার কেন্দ্রস্থলে প্রোথিত আছে বাঙলা, বাঙালী, বাঙলাভাষা, বাঙলার আকাশ-বাতাস, নদী। বঙ্গজননী। সেই কবি বলছেন পুনর্জন্মে আমি যেন আর বাঙালী হয়ে জন্মগ্রহন না করি?

স্বাধীন ভারত এবং বাঙলাদেশ তাঁর রচিত কবিতা জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গ্রহণ করেছে।               

বঞ্চিত সমাজ থেকে উদ্যমী, প্রতিভাবান গবেষক এই বিষয়ের প্রতি কি মনোযোগ দেবেন? বিশেষ করে তাঁদের প্রতি  এই অনুরোধ কেন বলছিঃ কারণ কবির এই ভূমিকা আমাদের মুখ্য ধারার গবেষকদের পছন্দ নয়। এই জন্য আমি বলছি বঞ্চিত সমাজের গবেষক এগিয়ে আসুন। গবেষকের কাছে আমাদের প্রত্যাশাঃ –

১।  তারা খুঁজে বের করুন মনের কোন তন্ত্রীর টানে কবি কুমিল্লায় নমঃশূদ্র সম্মেলনে হাজির হলেন?

২। সেদিন সম্মেলনে কবি তাঁদের উদ্দেশ্যে  কী বলেছিলেন?

৩। সুদূর কলিকাতা থেকে আয়োজকগণই বা কেন, কী উদ্দেশ্যে তাঁকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যান?

৪। কবির কাছে আয়োজকদের কী প্রত্যাশা ছিল?

৫। তাঁর মত মহামানুষের সান্নিধ্যে কীভাবে আয়োজকগণ পৌঁছাতে সক্ষম হয়ে ছিলেন? এশিয়ার প্রথম নোবেল জয়ীর কাছে অস্পৃশ্য মানুষের পৌঁছানো সেদিন সহজ ব্যাপার ছিলনা, এ কথা কল্পনার নয়, সত্যি অসাধ্য ব্যাপার ছিল।

কবির আন্তর্জাতিক সম্মানের দ্যুতিতে একদল বঙ্গবাসী স্বয়ং গৌরবান্বিত হবার লালসায় সেদিন উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলেন। সেই বাঙালী ভক্তকুলের বেড়া ডিঙ্গিয়ে কী ভাবে নমঃশূদ্রদের পক্ষে  কবির কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছিল? এ কথা আমাদের জানাবার অসীম কৌতুহল।

মনে রাখা দরকার বাঙলার কুসংস্কারাচ্ছন্ন, ঘোর রক্ষণশীল সমাজপতিগণের চাপে এবং বাঙালী ব্রাহ্মণ পরামর্শদাতার কু-মন্ত্রণায় মন্ত্রণায় বিদেশী সরকার একদা কবির পরিবারকে চন্ডাল, ডোম, হাঁড়ি, বাগদি, চামার অস্পৃধ্যদের সমাবেশে একাসনে বসিয়ে দিয়েছিল। ১৮০৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আইন পাশ করে উপরোক্ত অস্পৃশ্য সহ পিরালীদের পুরী জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিল। সেই আইনের উল্লেখ পূর্বেই করেছি।

বাঙালী বুদ্ধিজীবী, গবেষক এবং শিক্ষিত সমাজ কবিজীবনের এমন এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় জল্লাদের দক্ষতা এবং নিপুন নৃশংসতায় ছেঁটে ফেলে দিয়েছেন। ইতিহাসের এ এক স্থায়ী লজ্জা। এ বাঙালীর অনপনীয় কলঙ্ক। জানিনা এ কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে হেয় করতে, না নমঃশূদ্রের প্রতি উচুজাতের হিন্দুর চির লালিত ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ? শেষের অনুমান  সঠিক হলে সে বড় ক্ষতি নয়, কারণ নমঃশূদ্র এখনো বাঙালী সমাজের প্রান্তিক মানুষ; কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রতি বিদ্বেষ বশে করে থাকলে সে অপরাধের প্রতিকারের উপায় নেই, যে-লজ্জা ও বিড়ম্বনা বুদ্ধিজীবীদের অনন্ত কালের স্তম্ভ হয়ে থাকবে। রবীন্দ্রনাথ এখনো বাঙালী সত্তার কেন্দ্র দখল করে আছেন। তাঁকে সেই অবস্থান থেকে অপসারিত করা সহজ নয়।  সেই সঙ্গে তাঁর প্রতি বাঙালীর ঘৃণা অবিনশ্বর হয়ে রইল।

লেখকঃ

 সেবানিবৃত আই এ এস অফিসার এবং প্রাক্তন উপাচার্য, বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর বিহার বিশ্ববিদ্যালয়, মুজাফরপুর, বিহার।

****


[1]A K, Biswas, Two Events in Tagore’s Life, Mainstream, Vol XLVIII, New Delhi, No 20, May 8, 2010.

[2]১১ ফেব্রুয়ারি ১৯২৬/২৮ মাঘ ১৩৩২, গ্রাম সংগঠনেই জাতির মুক্তি, নমঃশূদ্র সমাজের প্রতি কর্তব্য, ঢাকায়   রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা।২০১০ সালে Mainstream পত্রিকায় আমার উপরোক্ত প্রবন্ধ Emeritus Fellow, UGC, New Delhi, ডঃ রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের নজরে পড়েছিল। এই উদ্ধৃতিটি পাঠিয়ে তিনি আমাকে বাধিত করেছেন।

[3]Census of India, 1921, Vol. V, Bengaland Sikkim, Part I Report, by W. H. Thompson, ICS, Calcutta, Bengal Secretariat Press, p. 172.

[4]Ibid., p. 357.

[5]Ibid, p. 374.

[6]Ibid.

[7]The Calcutta Municipal Gazette Tagore Memorial, Special Supplement, Saturday, September 3, 1941, editor Amal Home, p. 90 quoted by A K Biswas, in article,Two Events in Tagore’s Life, Mainstream, Vol XLVIII, No 20, May 8, 2010.

[8]কিরণ তালুকদার, জননায়ক মুকুন্দ বিহারী মল্লিক, quoted by N. B. Roy, A People in Distress, B. Sarkar & Co., Calcutta, Volume 2, 1987, Chapter XII, endnote 24, p. ii.

6. ২ মার্চ ১৯২৬/১৮ ফাল্গুন ১৩৩২, অভয় আশ্রমে রবীন্দ্রনাথ, (সংবাদদাতার প্রেরিত) । দিল্লী থেকে প্রকাশিত ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা Two Events in Tagore’s Life, Mainstream, Vol XLVIII, New Delhi, No 20, May 8, 2010পড়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের Professor Emeritus ডঃ রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য এই তথ্য দিয়ে বর্তমান লেখককে বাধিত করেছিলেন।  

[10]Rabindranath Tagore in a letter dated October 29, 1931, quoted by. Nirode C. Chaudhuri, “Tagore Nobel Prize,” Illustrated Weekly, Bombay, Vol. XCV 10, Sunday, March 11, 1973, pp. 9-10.

আপনার কেমন লাগলো?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 2

No votes so far! Be the first to rate this post.

10 Comments

  1. তথ্য নির্ভর লেখা, অনেক অজানা বিষয় জানতে পারলাম। লেখকের সঙ্গে একমত যে দলিত দের অনালোচিত দিক গুলি সামনে আসা খুব দরকার। আর এর দায়িত্ব নিতে হবে দলিত গবেষকদের।

  2. This article is not only a great read but full of unknown informations. We are enlightend with new piece of delightful information that Rabindranath also meant a compassionate poet who understood the pain and showed empathy to our forefathers-mothers. Dr. Biswas made us to think how the socalled Gentlemen of Bengal had taken away one of the most important event from Namasudra history by completely ignoring the importance of the event.

    1. ডঃ বি আর আম্বেদকর এক অবিষ্মরণীয় উক্তি করেছেন –“Political tyranny is nothing compared to the social tyranny and a reformer who defies society is a more courageous man than a politician who defies Government.”
      Dr B.R. Ambedkar
      রাজনৈতিক আক্রোষ স্তিমিত হয়ে যায়; কিন্তু জাতব্যবস্থার কারণে সামাজিক বিদ্বেষ , নিগ্রহ, পীড়ন শেষ হয়না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নমঃশূদ্র উভয়ই জাতবর্ণ ব্যবস্থার কারণে উচুজাতের ঘৃণার কারণ। কবির কথা হয়ত পরে লিখবো।

  3. As a member of Namoshudra caste I am very greatful to the writer and publisher of this valuable information.Thanks a lot.

  4. বহু প্রতীক্ষিত এই তথ্য জানতে পারলাম। অতুলবাবুকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই।

    1. ভাল লাগলো পড়ে । অজানা ইতিহাস জানতে পেরে খুশি হলাম । কিন্তু কুমিল্লার সেই সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের হদিশ কি করে পাওয়া যাবে ?

  5. অতুল বাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় শিক্ষা সম্বন্ধে মেন্সট্রীম পত্রিকায় তাঁর এক দীর্ঘ লেখা পড়ে।তাঁর দরদিয়া মানবিক পাণ্ডিত্য আমাকে বিস্মিত করে।বঞ্চিত মানুষের প্রতি উচ্চ সমাজের যে অমানবিক ব্যাবহার তার জন্য তাঁর মর্ম বেদনা দেখে আমি কবি অরুণ মিত্রের নিচের কবিতার অর্থ খুঁজে পাই।
    ” বৃক্ষমূলে আমার গভীরতম কথা আমি রেখে দিয়েছি/আমার সমস্ত আত্মীয়তা তার সাথে/কেননা আকুল জল সেখানেই ঢালা হয়েছিল আর শীতগ্রীষ্মের মার পড়েছিল বুকে আর পিথে/ফুল ফলের সাজ আলো ছায়ার ঝিলিমিল বলে কি সুখ কি সুখ/কিন্তু চুরমার পাঁজরে যেখানে দুঃখ জমে থাকে তাকেত আমি দেখেছি তাই আমার প্রেম আমি পেতেছি মাটিতে আর ধুলোয়”

  6. স্যার আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এই প্রকৃত সত্যকে উন্মোচিত করার জন্য। ইতিহাসকে ওরা (কাবাবরা) বিকৃত করেছে, সত্যকে গোপন করে সামনে নিয়ে এসেছে মিথ্যার ফুলঝুরি। আজ আমাদেরই দায়িত্ব প্রকৃত সত্যকে তুলে ধরা আর সেই কাজে আপনি আমাদের অগ্রজ। ধন্যবাদ আপনাকে।

  7. আজানা প্রকৃত তথা জানতে পারলাম,

  8. ডঃ বি আর আম্বেদকর এক অবিষ্মরণীয় উক্তি করেছেন –“Political tyranny is nothing compared to the social tyranny and a reformer who defies society is a more courageous man than a politician who defies Government.”
    Dr B.R. Ambedkar
    রাজনৈতিক আক্রোষ স্তিমিত হয়ে যায়; কিন্তু জাতব্যবস্থার কারণে সামাজিক বিদ্বেষ , নিগ্রহ, পীড়ন শেষ হয়না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নমঃশূদ্র উভয়ই জাতবর্ণ ব্যবস্থার কারণে উচুজাতের ঘৃণিত। কবির কথা আলাদা করে হয়ত পরে লিখবো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *