Satidaha

সতীদাহের মর্মান্তিক ঘটনাঃ পুত্র দ্বারা মাতৃহত্যা

মাতৃহন্তার মাতৃভূমি? সোনার পাথর বাটি

অতুলকৃষ্ণ বিশ্বাস, পি এইচ. ডি.

          অন্ততঃ ত্রিশ বছর পূর্বে উইলিয়াম ওয়ার্ডেরবিখ্যাত গবেষনাগ্রন্থ A View of the History, Literature and Mythology of the Hindoosপড়েছিলাম। বাঙ্গালী সমাজ চেনার পক্ষে দুইখন্ডের ১২৬৬ পৃষ্ঠারবইখানিকেবল অসাধারণই নয়, অবশ্যপাঠ্যও মনে করি। বাঙলায় জন্মদাত্রী জননীরপ্রতি পুত্রের হাতে হৃদয়হীনতার নানা হৃদয়বিদারী ঘটনা লিপিবদ্ধ করে লেখক উত্তরপুরুষের জন্য  ইতিহাসের এক অন্ধকার যুগের রূপরেখা গ্রন্থিত করে গেছেন। নীচের ঘটনাটি সম্ভবতঃওয়ার্ড অতিপরিচিত বা বিশ্বস্ত সূত্র থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁর বিশ্বস্তদের মধ্যে তৎকালের ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সংস্কৃত বিভাগের প্রথম ও দ্বিতীয় পন্ডিতদ্বয় অন্তর্ভুক্ত। তাঁরা সমকালের বিখ্যাত কুলীনবংশোদ্ভূতব্রাহ্মণ পন্ডিত ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন। তাঁদের সততা ও চারিত্রিক ঋজুতা নিয়ে তাঁরা সুকীর্তিত; ঘটনার সত্যতা নিয়ে কারো মনে আদৌ কোন সন্দেহ উঁকি মারার কোন সম্ভাবনা নেই।

আজকের দিনে সতীদাহ সম্পর্কে ইতিহাস নাম মাত্র উল্লেখ করে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। ঐ নৃশংস অধ্যায়ের সম্যক ধারনা ছাত্রছাত্রী বা পাঠকের মূর্ত হবার সুযোগ থাকেনা। এই ভাবে ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়ের উপর ঐতিহাসিক ও বুদ্ধিজীবীগণনিশ্ছিদ্রযবনিকা টেনে দৃষ্টির আড়ালে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এ কেবল নারীর প্রতি ইতিহাসের অবজ্ঞাই নয়, মায়ের প্রতি নৃসংশতম নির্মমতাকে ঢাকা দেওয়ার এক আপাত হৃদয়হীন কৌশল। তাই আজকাল সতীদাহের তুলনাহীন ক্রুরতার প্রকাশ্য আলোচনায়চোখে পড়েই না।

উইলিয়াম ওয়ার্ড বর্ণিত একটি সতীর ঘটনা এখানে আমাদের উপজীব্য, যা আজকের  সাধারণ মানুষকে বেদনাহত, করে দিতে সক্ষম বলে মনে করি। ঘটনার সময় ১৭৯৬ সাল; স্থান মজিলপুর, জেলা ২৪-পরগনা (বর্তমান দক্ষিণ ২৪-পরগনা) পূর্ব রেলের শিয়ালদা ডিভিশনের শিয়ালদা-লক্ষীকান্তপুর লাইনে জয়নগরের পাশে অবস্থিত। ওয়ার্ড জানাচ্ছেন, দক্ষিণ কলিকাতা থেকে মজিলপুর পায়ে হেঁটে একদিনের পথ। তখনও ট্রেন চালু হয়নি। এদেশে সর্ব প্রথম ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দে বোম্বে থেকে ট্রেনথানা পর্যন্তচালানো হয়েছিল। এক বছর পরে, হাওড়া থেকে চন্দননগর পর্যন্ত ১৮৫৪ সালে ট্রেনের যাত্রা শুরু হয়েছিল।

         মজিলপুরের বাঞ্ছারামের জীবনাবসান হলে তার পত্নী সহমরণের সংকল্প ঘোষনা করেন। এই মজিলপুরবাসী মধ্যাহ্নে পরলোক গমন করেন। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেসন্ধ্যার প্রক্কালেমৃতদেহ নিয়ে শ্মশান অভিমুখে শবযাত্রা শুরু হয়। ওয়ার্ড জানিয়েছেন, বাঞ্ছারাম ব্রাহ্মণ। শ্মশানে পৌঁছে মৃতের পত্নী সতীর হবার শাস্ত্রানির্দেশিত সব বিধিবিধান শান্তচিত্তে সম্পন্ন করলেন। চিতায় তুলে দিয়ে শায়িত শবের সাথে দড়ি দিয়ে তাঁকে বাঁধা হলেবিহিত উপায়ে মৃতের পুত্র চিতায় আগুন সংযোগ করলো। ততক্ষণে রাত্রি নেমেছিল। বর্ষাকাল, অন্ধকারাচ্ছন্ন সেই রাত্রি। প্রকৃতি যেন শোকসন্তপ্ত, অশ্রুসিক্ত— চিতায় অগ্নিসংযোগের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হল ঝর ঝর বৃষ্টি।

বাঞ্ছারামের পুত্র এবং অন্যান্য শ্মশানযাত্রীগণ কিছু দূরের এক কুঁড়ে ঘরে আশ্রয় নিল।এদিকে অল্পক্ষণে বৃষ্টির জলে চিতার আগুন গেল নিভে। আগুনে দড়ি পুড়ে গেলে,বাঁধন মুক্ত বিধবা চিতা থেকে বেরিয়ে এলেন। শ্মশানের আশে পাশের এক ঝোপঝাড়ের আড়ালে  তিনি প্রাণ ভয়ে অন্ধকারে গা ঢাকা দিলেন। কিছুক্ষণ পরে বৃষ্টি থেমে গেলে, বাঞ্ছারামের পুত্র, আত্মীয় পরিজন ও শবযাত্রীগণআবিষ্কার করলেন যে, চিতায় শব মাত্র একটি রয়েছে। বিদ্যুৎচকিতের ন্যায় তাদের বুঝে নিতে দেরী হয়নি, যেদাউ দাউ আগুনে সতী হবার সংকল্পে ভুলে অসহনীয় পরিস্থিতিতে বাঞ্ছারামের বিধবা চিতা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। সুতরাং সঙ্গে সঙ্গে শ্মশানযাত্রিদের চতুর্দিক বিধবা উদ্ধার অভিযান শুরু হল। অল্প সময়ের মধ্যে বিধবাকে ঝোপের মধ্য থেকে খুঁজে বের করা হল। মৃতের পুত্র হিড় হিড় করে জন্মদাত্রীকে টেনে আবার শ্মশানের নির্বাপিত চিতার পাশে এনে হাজির করলো।

যথাযথ নির্মমতায় পুত্র তার জননীর প্রতি নির্দেশ জারিকরলো, হয় তাকে স্বেচ্ছায় পুনরায় চিতা আরোহন করতে হবে; অন্যথায় গলায় দড়ি দিয়ে নতুবা  নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হবে।

         আতঙ্কিতা মা সোজাসুজি জানিয়ে দিলেনতাঁর পক্ষে এমন ভয়াবহ মরণ বরণ কিছুতেই সম্ভব নয়—তিনি বাঁচতে চান। ও দিকে পুত্র সিদ্ধান্তে অবিচল—যে ভাবে হোক মাকে চিতার আগুনে পুড়ে বা গলায় দড়ি দিয়ে অন্যথা নদীরজলে ডুবে মরতেই হবে। কিছুতে বেঁচে তাঁর থাকা চলবেনা। প্রমাদ গুনে এবার নিজের সন্তানের কাছে আতঙ্কিত গর্ভধারিণী জীবন ভিক্ষা করলেন। “বাবা আমাকে বাঁচা; আমি সতী হতে চাইনা। আমি বাঁচতে চাই।”

অকরুণ দৃঢ়তায় সন্তান আর্ত আবেদনপ্রত্যাখান করে নিস্পৃহ কন্ঠে যে জানিয়ে দিলঃ “মা, মৃত্যু বরণ তোমাকে করতেই হবে। নইলে আমি জাতিচ্যুত হব।”

পুত্র  জাতিচ্যুৎ হবার ভয়ঙ্করদূর্দৈব কিছুতে মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। তার জাত রক্ষার স্বার্থে মাকে চিতার আগুনে আত্মাহুতি দিতে তার মনে এতটুকু দ্বিধাদ্বন্দ নেই।এবার জন্মদাত্রীকেইপুত্র ভয় দেখালো, সে নিজেই জীবন বিসর্জন দেবে। মা কিছুতেই ছেলের কথা মেনে নিতে প্রস্তুত নন। অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে বললেন, “বাবা, আমি দেশ ছেড়ে চলে যাব। তোর আশ্রয়ে, বাড়ীতে বা  গ্রামে থাকবো না। আমি তোর কাছে জীবন ভিক্ষা চাইছি। প্রাণের জন্য আমার তোর পায়ে পড়ি।” নির্দয় পুত্র নিজ প্রতিজ্ঞায় অবিচল, অকম্পিত। মাকে প্রাণ ভিক্ষা দিতে পুত্র অক্ষম। সহমরনে তিনি বিশ্বাস সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছেন।

অবশেষে অবাধ্য মাকে আত্মহত্যায় রাজী করাতে না পেরে শবযাত্রীদের সাহায্য নিয়েশক্ত করে মায়ের হাতপা বেঁধে ছেলে অমানবিক বীভৎসতায় চিতার আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দিল। দেখতে দেখতে চিতার জলন্ত আগুনে তার নশ্বর দেহ ভষ্মীভূত হয়ে গেল।

         পাঠকের কৌতুহল বা অনুসন্ধিৎসা মনে রেখে এই হৃদয়স্পর্শী ঘটনাটিউইলিয়াম ওয়ার্ডের ভাষায় উদ্ধৃত করি। নামের বানান আমি অপরিবর্তিত রাখছিঃ

“About the year 1796, the following most shocking and atrocious murder, under the name of suhumurunu*, was perpetrated at Mujilpooru*, about a day’s journey south from Calcutta.  Bancha-ramu*, a brahmun* of the above place, dying, his wife at a late hour went to be burnt with the body: all the previous ceremonies were performed; she was fastened on the pile, and the fire was kindled but the night was dark and rainy. When the fire began to scorch this poor woman, she contrived to disentangle herself from the body, and creeping from under the pile, hid herself among some brushwood. In a little time, it was discovered that there was only one body on the pile. The relations immediately took the alarm and searched for the poor wretch; the son soon dragged her forth, and insisted that she should throw herself on the pile again, or drown or hang herself. She pleaded for her life at the hands of her own son, and declared that she could not embrace so horrid a death—but she pleaded in vain: the son urged that he should lose his caste, and that, therefore, he would die or she should. Unable to persuade her to hang or drown herself, the son and others present there tied her hands and feet and threw her on the funeral pile, where she quickly perished.”[1]

          অতি সংক্ষেপে  উইলিয়াম ওয়ার্ড বিষাদময় অধ্যায়ের এই ঘটনা উত্তরপুরুষের জন্য লিপিবদ্ধ করে গেছেন। ঘটনাটি নাট্যরস ও উপাদানে ভরপুর। বঙ্গজীবনে পুত্রের হাতে মায়ের এমন করুণ পরিনতির দ্বিতীয় নজীর আমার নজরে এখনো পড়েনি। শ্মশান ভূমিতে মজিলপুরের বাঞ্ছারাম পরিবারে মাতা-পুত্র সম্পর্ক এক লহমায় বিলীন হয়ে গেছে। দুই নারীপুরুষ—মাতাপুত্র হলেও—সেখানে সামনা সামনি দাঁড়িয়ে যেন একেবারেই  অচেনা, অপরিচিত—ভিন্ন গ্রহের প্রাণী। পুত্র ঘাতকের ভূমিকায়, প্রাণভয়ে জননী ভীত, ত্রাস্ত, দিশাহারা। বাঘ বা সিংহের সামনে যেন হরিনী প্রাণ ভয়েআতঙ্কিত, ত্রস্ত। পুত্রের কাছে মা আশ্রয় চান না, তার থেকে দূরে, বহুদূরে চলে গিয়ে অভাগিনী বেঁচে থাকতে চান। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই বিশ্বসংসারের অপরূপলীলা মাধুর্য দু চোখে দেখতে চান।শাস্ত্রবাক্যের প্রতিশ্রুত অনন্ত স্বর্গে মায়ের বিশ্বাস নেই। বিধবার বেঁচে থাকার আকুল আকুতিস্মৃতি-শাস্ত্র-সংহিতা যে-সম্পূর্ণ মিথ্যা এমন ধারনা তিনি স্পষ্ট ক’রে দিয়েছেন। পুত্রের নির্মমতা কী কঠোর, মমতাহীন,মজিলপুরের বাঞ্ছারামের বিধবা জ্বলন্ত নিদর্শন রেখে গেছেন। ওয়ার্ড এক ছোট্ট উদ্ধতি দিয়ে আমাদের সে কথা বুঝিয়ে দিয়েছেন।

“Unable to persuade her to hang or drown herself, the son and others present there tied her hands and feet and threw her on the funeral pile, where she quickly perished.”

হাত পা বেঁধে গর্ভধারিনী জননীকে যে-হৃদয়হীনতায় পুত্র আগুনে ছুঁড়ে দিয়ে পুড়িয়েছিল তুলনায় জল্লাদকে মৃয়মাণ মনে হবে। এই বর্ণনা না পেলে সতীদাহের সম্যক ধারণা আমাদের হয়ত হত না। এ যুগে স্কুল, কলেজের পাঠ্যপুস্তক সতীদাহের কথা ভাসা ভাসা ছুঁয়ে যায়। জন্মদাত্রী জননীর প্রতি বিভীষিকার এই চিত্র বুদ্ধিজীবী সমাজ পেশ করতে এড়িয়ে যান কেন? তাঁদের সভ্যতার শ্রেষ্টত্ব নিয়ে গলাবাজির পূর্বে ভাবা উচিত, এই হৃদয়হীনতার পাশে এমন দাবী কত নিখাদ।

         নৃশংসতার জন্য প্রাণীজগতে  হায়না, চিতা, বাঘ, সিংহ  কুমিরদের কুখ্যাতি সর্ববিদিত। তারা নিরীহ জীবদের অতর্কিতে আক্রমণ ও হত্যা করে। কিন্তু অরণ্যের জন্তু জানোয়ারের নৃশংসতার পাশেগর্ভধারিনীর প্রতি মজিলপুরের বাঞ্ছারামের পুত্র হবহুগুণে বীভৎস, তুলনাহীন পীড়াদায়ক;তার আচরণ মানবমনকে চিরতরে বিবশ করে রাখতে সক্ষম। অতি সুস্থ, শান্ত এবং অকম্পিত মন ও মস্তিষ্কে শ্মশানে বাঞ্ছারামের শক্তিশালী যুবক পুত্রের মায়ের প্রতি ব্যবহার ব্যাঘ্র হায়েনাদের সঙ্গে তুলনা করলে অরণ্যবাসী চতুষ্পদ প্রাণীদের প্রতি অপমান করা হবে। বাঞ্ছারামের পুত্রের হীনতা ও ক্রুরতার শত যোজনের মধ্যেওতারাআসেনা।

         জলন্ত চিতার আগুনের মধ্যে ছুঁড়ে দিতে পুত্রের হাত কাঁপেনি। শক্তিতে পেরে উঠবে না ভেবে সে অন্যের সাহায্য নিয়ে গর্ভধারিনী, নিরাপরাধ, নিরীহ বিধবাকে চিতার জলন্ত আগুনে ছুঁড়ে দিয়েছে।

তার গর্ভস্থ সন্তান অনিশ্চিত ভাবে এই পদক্ষেপ করতে অগ্রসর হয় নি। মায়ের উপরে অন্তিম পর্দা নিশ্চিত করে টেনে দিতে হাতপা বেঁধে আগুনে ফেলেছিল। কল্পনা করতে শিউরে উঠতে হয় যে, সতীদাহনের পরেও এই সন্তান  সমাজে ঘুরে ফিরে বেড়িয়েছে, স্বভাবসুলভ দৈনন্দিন জীবন অনুতাপহীন কাটিয়ে দিয়েছে। এদের অনেকের মুখেই হয়ত মাতৃবন্দনা ধ্বনিত হয়েছে। এমন ঘটনার পরে তাদের কল্পনাকে “বন্দে মাতারম” স্তোত্র রচনায় প্রেরণা দিয়েছে।

         শুধু বঙ্গবাসী প্রশ্ন করেনি,—-কল্পনা করেছে কিনা তাও অজানা—“জননীজন্মভূমিশ্চঃ স্বর্গাদপি গরিয়সি”র মত শ্লোক কিপাপ ঢাকার চেষ্টা? এই হলসোনার পাথর বাটি; উৎকৃষ্টতর উদাহরণ সম্ভবতঃ হতে পারেনা।

মায়ের চেয়ে পুত্রের কাছে জাত বড়, মহান, অপরিহার্য। বাঞ্ছারামের পুত্রের কাছে মাসর্বোচ্চে নন। বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয়স্থল মা নন—পুত্রের জাত—মায়ের চেয়ে জাত গরিয়সি। হিন্দুর ধর্মের উর্দ্ধে তাঁর জাত। তাই পুত্রের হাতে মায়ের মৃত্যু অপরিহার্য ছিল। মায়ের জন্য পুত্র জাত বিসর্জন দিতে পারেনি।

মায়ের জন্য জাত হারানোর মত দুর্দৈব পুত্র কিছুতে মেনে নিতে পারেনি—জাতভক্ত সন্তান সেই সম্ভাবনা মেনে নিতে পারেন। 

এক অপরিহার্য প্রশ্নআমার মনকে তাড়িত করছে—মাতৃহত্যার পাপ, অনুতাপদগ্ধ মন  আর গ্লানির উপর উপশমের প্রলেপ লেপন করতেই কি এমন শ্লোক রচিত, প্রচারিত ও উচ্চকন্ঠ প্রশংসিত? বা এমন বীভৎস অমানবিকতা, বর্বরতার উপর সুদৃশ্য পর্দা ঢাকা দিতে “জননীজন্মভূমিশ্চ……” তুল্য শ্লোক রচিত? এই শ্লোক কি ১৮২৯ খ্রীষ্টাব্দে সতী নিষিদ্ধ হবার উত্তরকালে রচিত? আমার জানা নেই, সুধী পাঠক ক্ষমা করবেন।

তা হলে প্রশ্ন আবারঃ যারা ঠান্ডা, সুস্থমস্তিষ্কে গর্ভধারিনী জননীর এমন অকল্পনীয় হত্যার অপরাধে অপরাধী, তাদের কি আদৌ মাতৃভূমি হতে পারে?  না, মাতৃহন্তার মাতৃভূমি থাকতে পারে? এ ত এক অকল্পনীয় ভাবনা, দাবী। বাঞ্ছারামের পুত্র ত মাতৃগর্ভের অনপনীয় অপমান। তাঁদের জন্মভূমির দাবী মেনে নেওয়া যেতে পারেনা। তাদের মাতৃভূমি কিছুতেই হয় না, হতে পারেনা। মাতৃভূমির স্তোস্ত্র উচ্চারণ করে তারা মাতৃগর্ভের অপমান করে চলেছে। তারা জন্মভূমির দাবী করলে মেনে নিতে পারা যায়; মাতৃভূমির হুঙ্কার তাদের মুখে শোভা পায়না। তাদের মাতৃভূমি হতে পারেনা, কিছুতেই না, কখনোই নয়।  

         বাস্তবের হিন্দুপুত্র ত কল্পনার জীবন্ত ও বাস্তব ফ্রাঙ্কেন্টাইন। প্রতিটি হিন্দুপুত্র মায়ের গর্ভ থেকে মৃত্যু পরোয়ানা হাতে নিয়ে ভুমিষ্ট হত। মায়ের বৈধব্য তাদের সেই পরোয়ানা তামিল করার সুযোগ দান করত। পৃথিবীর সব দেশে পুত্রের কাছে মা অতি শ্রদ্ধা, সম্মান এবং প্রাণের তুল্য। দেশও তাঁদের অতি সম্মানের। কিন্তু কোনও দেশ মাতৃহত্যাকারীকে ক্ষমা করেনি।

ব্যাতিক্রম কেবল ভারত।

গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক না হলে গঙ্গাতীরে নির্মম নৃসংশতায় হিন্দুপুত্র শাস্ত্রবচন ও অনুশাসন মেনে একই নৈর্ব্যক্তিক মানসিকতায় জন্মদাত্রীকে আগুনে বিসর্জন দিয়েহয়ত আজো সভ্যতার জয় জয়কার করে আকাশ বিদীর্ণ করতো।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ঘোর স্বার্থতাড়িত একশ্রেণীর মানুষ “পৌশাচিক কল্পনা” বশে নানা শ্লোক রচনা করেছেন। 

শাস্ত্র হিন্দুর মৃত্যু ফাঁদ বিছিয়ে দিয়েছিল।সপ্তঋষিদের অন্যতম অঙ্গিরার মতে,মানবশরীরে ৩,৫০.০০০,০০লোম আছে। স্বামীর চিতায় সহমরনে যে-স্ত্রী মৃত্যুবরন করবেন, সাড়ে তিন কোটি বছর তিনি স্বর্গে বসবাস করবেন।

সাপকে যেমন গর্ত থেকেসাপুড়ে টেনে বের করে, তেমন মৃত স্বামীকে নরক থেকে উদ্ধার করে স্ত্রী তাঁর সঙ্গে মিলিত হন।

স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় যে-পত্নী আত্মবিসর্জন দেন, এমন স্ত্রী নিজের মাতা, পিতা, এবং স্বামীর পরিবারকে পাপ মুক্ত করেন।

পৈচাশিক কল্পনা ঋষি অঙ্গিরার। এই ঋষি বেদ সঙ্কলন করেছিলেন বলে বিদগ্ধজনের বিশ্বাস। তিনিই সপ্তর্ষিদের অন্যতম। দেখা যাচ্ছে, লোভের দড়ি যত লম্বা করা যায় লোলুপদের ফেঁসে পড়ার সম্ভাবনা তত ব্যাপক।

এমন লম্বা জাল কোনও সপ্তর্ষি বিস্তার করুণ আর কোনওমহামুনি, ঘোর সন্দেহের চোখে দেখা উচিত। বেদ হোক আর গীতা“পৈচাশিক কল্পনা”র ফসল।

লেখক অবসরপ্রাপ্ত আই এ এস অফিসার এবং প্রাক্তন উপাচার্য, বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর বিহার বিশ্ববিদ্যালয়, মুজফরপুর, বিহার। 

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলা দলিত সাহিত্য সংস্থার মুখপত্র ‘চতুর্থ দুনিয়া’য়। সেপ্টেম্বর ২০২১ সংখ্যায়।

সূত্রঃ-

Patriotism and Matricide by A. K. Biswas, Outlook, New Delhi, June 7, 2016.নীচের লিঙ্কে উৎসুক পাঠক পড়তে পারেন। 

https://www.outlookindia.com/website/story/patriotism-and-matricide/296947


[1]     William Ward,A View of the History, Literature and Mythology of the Hindoos, Mission Press, Serampore, 1818,  p. 304.

  • suhumurunu, সহমরন; Mujilpooru, মজিলপুর; Bancha-ramu, বাঞ্ছারাম; brahmun, ব্রাহ্মণ।

আপনার কেমন লাগলো?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *