দলিত সাহিত্য আন্দোলন
কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর
সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে সাহিত্য আন্দোলনের কিছু গুণগত পার্থক্য আছে।সাহিত্যে ভাব ভাষা ও প্রকাশভঙ্গী পরিবর্তনের ধারাবাহিক প্রচেষ্টাকে সাধারণ ভাবে আন্দোলন হিসেবে গণ্য করে থাকেন অনেকে।তাতে সমস্যা কিছু নেই।কারণ, সাহিত্যের বাঁক বদলে এ সবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।কিন্তু, প্রশ্ন জাগে তখনই, যখন বাংলায় ‘হাংরি’ চেতনাকে বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা হয় এবং প্রগতি সাহিত্য আন্দোলন ও দলিত সাহিত্য আন্দোলনের মতো সমাজ পরিবর্তনকামী দুটি সাহি্ত্য আন্দোলনকে একেবারেই গুরুত্ব প্রদান করা হয় না। আন্দোলন শব্দটির সঙ্গে বন্ধনমুক্তি, প্রগতি ও মানবকল্যাণ তথা সমাজ কল্যাণের নিবিড় সম্পর্ক আছে। নারী হোক বা দলিত কিম্বা কৃষক ও শ্রমিক, তাদের উপরে ক্রমবর্ধমান শোষণ প্রক্রিয়াকে কেউ আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বলে শোনা যায় না। বরং, সেই শোষণ বঞ্চনা থেকে মুক্তির প্রচেষ্টাকেই আন্দোলন হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।‘হাংরি’র মতো সাহিত্য প্রয়াস যতই ভাষা ব্যবহার ও প্রকাশ ভঙ্গিতে তীব্রতা নিয়ে আসুক, তার মধ্য দিয়ে যে জৈব ক্ষুধা ও ধর্ষকামিতার পরিচয় মেলে, সমাজজীবনে তার বাস্তব অনুশীলন ধ্বংসাত্মক হতে বাধ্য। তাহলে তাকে একটি আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করা যায় কীভাবে?
বাংলা সাহিত্যে সবথেকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন হলো প্রগতি সাহিত্য আন্দোলন ও দলিত সাহিত্য আন্দোলন। যার লেখকেরা শিল্প-সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজ-অন্তর্গত মানুষের চিন্তা-চেতনার সংস্কার ঘটিয়ে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছেন।কেউ কেউ নিশ্চিত ভাবেই চোখ কপালে তুলে বলবেন, সাহিত্যর কি সেটা কাজ, না সাহিত্য দিয়ে তা কখনও সম্ভব? দৃঢ়তার সঙ্গে বলব, – আলবৎ সম্ভব। ভারতবর্ষে হাজার হাজার বছর ধরে সবার অজান্তে যান্ত্রিক নিয়মে সেই কাজটিই নিঃশব্দে ঘটে চলেছে।অন্তত দু’হাজার বছর ধরে ভারতীয় সমাজ নিয়ন্ত্রিত ও চালিত হচ্ছে মনুবাদী-ব্রাহ্মণ্যবাদী ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধের দ্বারা।এ কথা বলা মোটেই বাতুলতা হবে না যে সেকালের মনুবাদীরা এ কালের পণ্ডিতদের থেকে অনেক বেশি দূরদর্শী ও সচেতন ছিলেন।তারা তাদের অনুকূলে সমাজব্যবস্থাকে পরিচালনা করার জন্য সাহিত্য ও দর্শনের আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারা জানতেন, মানুষের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ধর্ম-দর্শনের কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু, গায়ের জোরে চাপিয়ে দিলেই তা স্থায়ী হবে না।তাকে স্থায়ী করতে হলে, মানুষের ভাবনা-চিন্তা, আচার-আচরণ এবং মূল্যবোধের গভীরে তার শিকড় ছড়িয়ে দিতে হবে।সে কাজে সাহিত্য ও সঙ্গীতের থেকে স্থায়ী এবং জনপ্রিয় কোনও মাধ্যম নেই। কিন্তু কাজটি করতে হবে সুকৌশলে।তাদের দৃষ্টি পড়লো রামায়ণ মহাভারতের মতো দুটি চিরন্তন সৃষ্টির উপরে। তার সংস্কারে প্রবৃত্ত হলেন তারা।তবে শুধু তাতেই তুষ্ট হলেন না, সংখ্যাধিক পুরাণ, উপপুরাণ রচনার আয়োজন চলল মনুবাদী ধ্যান-ধারণায় সমাজকে আষ্টপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলার জন্য।
দৃষ্টান্ত হিসেবে আদিকবি বাল্মীকি রচিত রামায়ণের দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যেতে পারে।গবেষকেরা মনে করেন, মনুসংহিতা রচনার পরে প্রচলিত রামায়ণ, মহাভারতের সংস্কার করা হয়েছিল খ্রীস্টিয় তৃতীয় শতক নাগাদ। মহাকাব্যের নানা স্থানে এই লক্ষ্যে শ্লোক প্রক্ষিপ্ত করা হয়েছিল। রামায়ণের একটি গোটা কাণ্ড যা ‘উত্তরকাণ্ড’ নামে চিহ্নিত, তা এই সময়ে সংযুক্ত করা হয়েছিল বলে অধিকাংশের ধারণা।শতাধিক বৎসর পূর্বে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় রামায়ণ বিচার করতে গিয়ে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন: “মহাভারতের পরিশিষ্টস্বরূপ ‘হরিবংশে’র ন্যায়, রামায়ণের পরিশিষ্টস্বরূপ ‘উত্তরকাণ্ড’ উত্তরকালে সংযুক্ত হইয়াছিল—এই সিদ্ধান্ত নিতান্ত অপরিহার্য বলিয়া বোধ হয়”। বস্তুত, উত্তরকাণ্ড অনুধাবন করলে (বিশেষত ৭৪,৭৫এবং ৭৬তম সর্গ) প্রতীতি হয়, এই রামচন্দ্র মহাকবি বাল্মীকির মানসপুত্র নন, ইনি সর্বতোভাবে মনু মহারাজের সৃষ্টি এক বর্ণবাদী ক্ষত্রিয় নৃপতি।বর্ণধর্মের রক্ষক।মনুবাদী ধারণা ও মূল্যবোধ দিয়ে শুধু ওই দুটি মহাকাব্যকেই পুষ্ট করা হয়নি, অষ্টাদশ পুরাণ, উপপুরাণ এমনকি বেদ উপনিষদও তাদের হাতের কারিকুরি থেকে নিষ্কৃতি পায়নি।এমন যে শিব, যাকে অনার্য দেবতা বলে অভিহিত করা হয়, ‘শিবপুরাণ’-এ সেই শিবকেও বর্ণবাদের পরিপোষক হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। সমাজের উদ্দেশে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ছিল সেই বার্তা। এ ভাবে সাহিত্যের মধ্য দিয়ে মনুবাদী মূল্যবোধ সমাজের সর্বোচ্চ স্তর থেকে সর্বনিম্ন স্তর অবধি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।বংশ পরম্পরায় সেই মূল্যবোধে জারিত হয়েছে সমগ্র ভারত। প্রাত্যহিক আচরণের মধ্য দিয়ে সমাজস্থিত মানুষের মধ্যে ফুটে উঠেছে সেই বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস এমনকি বিচারপতিদের ন্যায়বিচার প্রদানকেও প্রভাবিত করেছে বলে অনেকে দৃষ্টান্তসহ উল্লেখ করেছেন।
মনুবাদী সংস্কার ও মূল্যবোধই হাজার বছর ধরে টিকিয়ে রেখেছে ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ।যাকে আজও কেউ লঙ্ঘন করার কথা ভাবে না।বরং প্রাণপণে অটুট রাখার চেষ্টা চলে।মাঝে মাঝে ঝড় উঠলে ‘শাস্ত্রবাক্য’ দিয়ে তাকে নিরস্ত্র করা হয়।ওই শাস্ত্রবাক্যগুলি আসলে ধর্মীয় সাহিত্য ছাড়া আর কিছুই নয়।একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।সকলেই জানি, ভারতীয় সমাজে গুরুবাদের প্রভাব কত তীব্র।এই গুরুবাদের মহিমা প্রচারিত হয় একটি জনপ্রিয় সুললিত শ্লোকে: “ওঁ অজ্ঞান-তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন-শলাকয়া।/ চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।… অখণ্ড-মণ্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচরম্।/ তৎপদং দর্শিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ”।। ইত্যাদি। সুদক্ষ কবি ছাড়া এমন ধ্বনি ও ব্যঞ্জনাপূর্ণ মাধুর্যময় শ্লোক আর কে রচনা করতে পারেন?
লক্ষ করার বিষয়, দলিত নিম্নবর্ণের ভেতর থেকে মাঝেমধ্যেই কোনও কোনও মনীষী এই বর্ণবাদী ধর্মের প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠে দাঁড়ান।তাঁরা সকলেই দৃঢ়কন্ঠে মনুর বিধি-বিধানকে অমান্য এবং শাস্ত্রীয় আচার-বিচারকে অস্বীকার করার কথা বলেন।এঁদেরই কেউ শোষণের হাতিয়ার প্রবল প্রতাপান্বিত গুরুবাদ এবং দীক্ষাগ্রহণের প্রয়োজনীয়তাকে একেবারে ফুৎকারে উড়িয়ে দেন।কেউ বা নারীর শুচিতা, বৈধব্য, অধিকার ইত্যাদি নিয়ে প্রচলিত ব্রাহ্মণ্যসংস্কারের এত বিপরীত কথা বলেন যে, মনুর ধর্মে বিশ্বাসীদের হোঁচট খেতে হয়। সেই প্রতিবাদী ধর্মগুলিকে নিয়ে আলোচনার অবকাশ এখানে নেই।তবে, এ কথাটা বলা প্রয়োজন যে, ব্রাহ্মণ্যধর্মের ক্ষত মুছে নতুন ধর্মাদর্শের প্রসার ঘটাতে তারা আঁকড়ে ধরেন সাহিত্যকেই।কখনও মৌখিক সাহিত্য বা সঙ্গীত হয়ে ওঠে মাধ্যম, কখনওবা পত্র-পত্রিকা।সুতরাং, স্বীকার করে নিতেই হচ্ছে যে, সাহিত্যের সমাজবদলের ক্ষমতা শুধু আছে তাই নয়, বহু প্রাচীনকাল থেকে ভারতবর্ষে তা এক স্বীকৃত ও পরীক্ষিত পদ্ধতি।
মনুতন্ত্রকে পরাস্ত করতে না পারলে ভারতে সাম্যবাদ দূরের কথা গণতন্ত্রই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।দলিত সাহিত্য আন্দোলন সে কথাটাই দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চেয়েছে বারবার।দলিত মুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে যে সাহিত্য আন্দোলন, দলিত মুক্তির সেই সাহিত্য প্রচেষ্টাই হলো দলিত সাহিত্য।শুধু দলিত সমাজভুক্ত মানুষেরাই এই প্রচেষ্টায় সামিল থাকবেন, অন্যরা নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করবেন, এই ভাবনাটি একেবারেই অনভিপ্রেত। দলিত সমাজের মানুষেরা যখন থেকে নিজেদের আকাঙ্ক্ষাকে মেলে ধরার জন্য পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেছেন, আমরা লক্ষ করি প্রকৃত সমাজবদলকামী মানুষেরা সেই যুদ্ধে তাঁদের সঙ্গে সামিল হয়েছেন।সূচনায় দিগীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য ও অনাথবন্ধু সেনের নাম এ প্রসঙ্গে স্মরণ করতে পারি। মনুবাদী ফতোয়া ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে দলিত পত্র-পত্রিকার রয়েছে শতাধিক বছরের সংগ্রামী ইতিহাস। সেই ইতিহাস অবহিত হওয়া, তার পুনরুদ্ধার ও সঠিক মূল্যায়ন সবিশেষ জরুরি
—