শিক্ষা আন্দোলনের সেনাপতি মহাত্মা ভেগাই হালদার (নাটক)
রাজু দাস
মহাত্মা ভেগাই হালদার নাটকের প্রথম অভিনয় : 09 -12- 2018
নেতাজী সংঘ, অযোধ্যা নগর, বিরাটী।
কলা কুশলীবৃন্দ
সূত্রধর ও জগন্নাথ – প্রানগোবিন্দ বিশ্বাস।
চিত্তরঞ্জন দাস : হর্ষবর্দ্ধন চৌধুরী।
ধনপতি : চৈতন্য দত্ত। বিহারীলাল : বাবুলাল দে। কৈলাস বাবু : গোবিন্দ সরকার। হরভূষন : গোপাল হালদার।
নিশিকান্ত : শিবনাথ দে। রামচরণ : ভোলা মজুমদার। সহেব : সুবল দাস। ফটিক : সঞ্চয় সুত্রধর। পচা : সুব্রত বোস। গদাই : রাজু দাস। বাঘাই : সমীর দাস। ভেগাই : অতনু ঘোষ।
নারী চরিত্রে : বাসন্তীদেবী : নমিতা দাস। তারামণি : টুটুন মুর্খাজী। শ্যামতারা : অনিমা বিশ্বাস। বৃদ্ধা : জবা দে।
পরিবেশক : শান্তিকুঞ্জ ব্লাইন্ড নাট্য একাডেমি।
নাটক রচনা ও প্রয়োগ : রাজু দাস।
দর্শকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন : – সসীম বাড়ৈ । নারায়ন বিশ্বাস। নবীন দাস। হরিপ্রসাদ সরকার। মৃনাল মন্ডল।
রচনাকাল : – 20 জুন 2018 (Ohio)
( নাটকের শুরুতে প্রত্যেকে ধুতি বাংলা সার্ট, কোমরে গামছা ও মেয়েরা কমদামী সুতিরশাড়ী পরবে।
মঞ্চের ওপরে দুপাশে বাদ্যযন্ত্রকার বসবে । কারন যারা বাজাবে তারাই অভিনয় করবেন। তবে নাটকের শুরুতে সকল শিল্পীরা দর্শকদের পেছন থেকে এসে মঞ্চে গান গাইতে গাইতে ওঠবেন।
প্রয়োজনে শিল্পীরা একাধিক চরিত্রে অভিনয় করতে পারবেন।
বরিশালের কথ্যভাষায় অভিনয় করতে পারলে ভালো হয়। )
সূত্রধর : ( হেমন্ত মুখার্জীর গানের কলির গান )
শোন বন্ধু শোন প্রানহীন এই শহরের ইতিকথা –
ইটের পাঁজরে লোহার খাঁচায় দারুণ মর্মব্যাথা।
কোরাস : আহা: এ গান নয়। শোন শোন মন দিয়া শোন বন্ধুগণ।
সূত্রধর : ও হ্যাঁ। শোন শোন মন দিয়া ভাই বন্ধুগণ।
এক গাঁয়ের আজব কাহিনী করিব বর্ণন।
কোরাস : আহা বেশ বেশ। আহা বেশ বেশ।
সূত্রধর : বাংলাভাষার শৈশবকালে ফুল্লশ্রী গ্রামে।
মনসামঙল রচিলেন বিজয় গুপ্ত নামী।
কোরাস : আহা বেশ বেশ বেশ।
সূত্রধর : এই গাঁয়ে জগন্নাথ শ্যামাতারার ঘরে,
1250 সালে জন্মিল এক শিশু ভেগাই নাম ধরে।
কোরাস : আহা বেশ বেশ বেশ।
সূত্রধর : দিনে দিনে বাড়ে শিশু
পাঠশালায় নাহি যায়।
পাঁচগাঁয়ে দুষ্টুমিতে সকলের মাথা খায়।
কোরাস : আহা বেশ বেশ বেশ। সূত্রধরমশাই, আমরা বেশ বুঝতে পারছি – আপনি আর ছন্দ মিলিয়ে গাইতে পারবেন না। তার চেয়ে সহজ বাংলাতেই মহাত্মা ভেগাই হালদারের জীবনকথা মাঝে মধ্যে ধরিয়ে দিন। আমরা একেকজনে একেকটা চরিত্রে অভিনয় করি।
সূত্রধর : আহা বেশ বেশ। ( দর্শকদের প্রতি ) আমি তাহলে তাই করি কি বলেন ! কারন আপনারাই তো আমাদের নাটকের প্রনভোমরা।
তা হলে নাটক শুরু হচ্ছে – বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া গ্রামে শ্যামাতারা জগন্নাথের বারান্দায় – –
ধনপতি : এই যে জগন্নাথখুড়ো। তোমার দুষ্টুছেলে ভেগাইকে সামলাও। নইলে অনর্থ হয়ে যাবে বলে দিলাম।
জগন্নাথ : ( হুকো টানা বন্ধ করে ) ভেগাই কি করেছে বলবে তো?
গদাই : তোমার ছেলের দস্যিপানা তুমি জানো না বলতে চাও?
জগন্নাথ : তা জানবো না কেন ! সেই শিশুকাল থেকে ভেগাইয়ের দস্যিপনায় আমরা অতিষ্ঠ হয়ে আছি।
ধনপতি : তা তোমাদের ছেলেকে নিয়ে তোমরা অতিষ্ঠ হও আর উৎফুল্ল হও, তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই।
জগন্নাথ : সে তো ঠিকই। কিন্তু এবার কি করেছে ভেগাই?
পচাঁ : এর আগে বহুদিন ওর নামে তোমার কাছে নালিশ করেছি। তোমার ছেলেকে তুমি শাষন করেছো কোনদিন?
জগন্নাথ : আমার শাষন উপদেশ কিছুই তো ভেগাই মানে না বাবারা। এবার তোমাদের কি কি ক্ষতি করেছে বলো। আমি ক্ষতিপুরন দিয়ে দেব।
ফটিক : হু: এ যেন হাড়ি কলসির ব্যাপার ! ভাঙল আর তুমি হাট থেকে কিনে দিলে ।
জগন্নাথ : আহা আগে বলবে তো কি করছে?
ধনপতি : আমার গাছের এককাদি ঝুনো নারকেল পেড়ে খেয়েছে।
পচা : আমার ক্ষেতের একুকুড়ি বাঙি আর তরমুজ খেয়েছে।
ফটিক : এরপরে আমার আখক্ষেতের গোটাদশেক আখ খেয়েছে। এতো খেয়ে হজম করে কি করে তাই ভাবি।
ধনপতি : যেন রাক্ষসের পেট। বুঝলে খুড়ো এসব যে কেবল আজকের ঘটনা তা কিন্তু নয় ! প্রত্যেকদিন গ্রামের কারো না কারোর ক্ষেত বাগান থেকে আম লিচু যাম নারকেল জামরুল পেড়ে খায়।
জগন্নাথ : তোমরা নিষেধ করো না কেন?
পচা : যে পেটুক ছেলে মা বাপের কথা শোনে না – সে শুনবে আমাদের কথা।
জগন্নাথ : তোমরা পিঠমোড়া করে বেধে হাইলানড়ি অথবা বাঁশের লাঠি দিয়ে মেরে হাড়গোড় ভেঙ্গে দিতে পারো না?
ফটিক : পারতাম। যদি না কোমরে সর্বদা একখান দা আর হাতে লাঠি না থাকতো।
পচা : তার উপর ভেগাইয়ের যা মোষের মতো শক্তি।
ধনপতি : তুমি তো জানো খুড়ো ! গ্রামে হাডুডু খেলার সময় সাতজনেও ওকে আটকে রাখতে পারেনা।
ফটিক : সেই জন্যেই আমরা কেউ সাহস পাইনা।
পচা : গত সপ্তাহের এক কান্ড শুনেছিস তো; মজুমদার বাড়ির ভিটেতে মাটি ফেলে উচু করার চুক্তিতে আটজন মুনিশ একবেলা কাজ করে সবে খেতে বসবে, এমন সময় ভেগাই ওদের বলে বসল – এই এক গামলা ভাতে তোমাদের পেট ভরবে? ওতে তো আমার একার পেটই ভরবে না। ভিন গায়ের মুনিশরাতো ভেগাইয়ের রাক্ষুষে পেটের খবর জানে না তাই বললে – খেয়ে দেখাও দেখি। না পারলে সারাদিন আমাদের সাথে মাটি কাটতে হবে।
ভেগাই বললে- ঠিক আছে আমি রাজি।
মুনিশদের একজন বললে – আমরা কিন্তু মুছলমান। আমাদের ছোঁয়া ভাত খেলে তোমার কিন্তু জাত চলে যাবে।
জগন্নাথ : ভেগাই আটজনের খাবার একাই খেতে পারলো কি না তাই বলো !
ধনপতি : সহজেই পারলো। তবে ভেগাই মুনিশদের বলেছিল – তোমাদের সকলের ভাত আমি খেতাম না। শুধু কথার কথা বলেছিলাম। কিন্তু এবার ঐ ভাত খেয়ে আমি পরখ করে দেখবো আমার জাত কি করে যায় ! ও ভালো কথা, তোমরা এখন আমাদের বাড়িতে চলো। আমার মা তোমাদের ভাত রেধে খাওয়াবে।
জগন্নাথ : জয় হরিবোল। হে দীনবন্ধু তুমি ভেগাইকে আরো সুবুদ্ধি দাও ঠাকুর। সুবুদ্ধি দাও –
ফটিক : এ অন্যায়কে তুমি সুবুদ্ধি বললে সাধুকর্তা? ওর সাথে তোমাদের ও জাত চলে যাবে যে?
জগন্নাথ : ওরে জাত কি মানুষের শরীরের মাখানো রঙ যে ছোঁয়া লাগলেই চলে যাবে ! কেন তোমরা শোননি স্বয়ং চৈতন্য মহাপ্রভু, যবনহরিদাস ও মুছলমান হোসেন শাহকে কোল দিয়েছিলেন। তাই তো লালন ফকির গাইতেন – জাত গেল জাত গেল বলে ( গান গাইবেন )
পচা : কাকা তোমার কথা আমরা বুঝলেও সমাজপতিরা কিন্তু বুঝবে না।
ধনপতি : এই কথাতো মানবে একমাত্র হারাধন চক্রবর্তীই হলো আমাদের কুড়িটি গ্রামের নমোদের পুরোহিত ও কুলগুরু। তিনি জানতে পারলে তোমার বাড়িতে কোন পুজোআচ্চা করবে তো নাইই উল্টে জোট পাকিয়ে তোমাকে একঘরে করবে নয়তো পাড়াছাড়া করবে।
জগন্নাথ : বাবারা এই বিপদের হাত থেকে তোমরা আমাকে বাঁচাও।
ধনপতি : সে তুমি সাধুমানুষ কারো সাতেপাঁচে থাক না। নিজের জমিতে চাষ করো, হাড়ের চিরুনি বানিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিক্রি করো। সকলের বিপদে আপদে পাশে থাকো তাই আমরা না হয় ক্ষমাঘেন্যা করে চুপচাপ থাকলাম কিন্তু কোনভাবে পাঁচকান হলে জগন্নাথ : আমি কি করবো বলোতো বাবারা ! ভেগাইকে দূরের গাঁয়ের পাঠশালায় ভর্তি করালাম। ও কিছুদিন পড়ে চলে এলো। আর ওমুখো হল না। ওর মা শ্যামাতারা ও মোড়ল বলল – ছেলের বিয়ে বিয়ে দিয়ে দাও দেখবে সংসারে মতিগতি ফিরবে।
অগত্যা গোয়াইল গ্রামের নদীরাম জয়ধরের মেয়ে তারামনির সাথে বিয়ে দিলাম। কিন্তু উড়োনচন্ডী ভেগাই পাল্টালো না।
ধনপতি : এসব আমরা জানি কিন্তু গ্রামের মানুষ ভেগাইয়ের অত্যাচার আর কতদিন সইবে?
পচা : শোন সাধুকাকা, ভেগাইয়ের ভয়ে কেউ কোন কথা তোমাকে বলে না; এই তো দিন কয়েক আগে গৈলার ক্ষেত্রমোহন বাড়ৈয়ের গাইয়ের বাছুর হয়েছে বলে ত্রিনাথ ঠাকুরের পুজোর আয়োজন করেছিল আর আমরা সবাই গান করছিলাম। ( ওরা তিনজনে ঘুরে ঘুরে ত্রিনাথ ঠাকুরের গান করবে। যেন সেইদিনের দৃশ্যে পুনরাবৃত্তি করছে ) আরে দ্যাখ দ্যাখ – ভেগাই ত্রিনাথের ঘট উল্টে দিয়ে গুড়খের নাড়ু ও গাঁজারকল্কে নিয়ে পালালো। ধ র্ ধর্ –
ফটিক : ভেগাইয়ের লাঠির ভয়ে সেদিন আর কেউ ওকে ধরতে যায়নি।
জগন্নাথ : ( কপালে জোড়া হাত ঠেকিয়ে ) হে বাবা ত্রিনাথ ঠাকুর, তুমি ভেগাইকে ক্ষমা করে আমাকে শাস্তি দাও ঠাকুর। আমাকে শাস্তি দাও।
ধনপতি : আমরা এখন যাই খুড়ো ( প্রনাম করে সকলে প্রস্থান )
জগন্নাথ : এসো। শ্রীহরি তোমাদের মঙ্গল করুন।
( ভেগাইয়ের মা শ্যামাতারা কাঁদতে কাঁদতে প্রবেশ করে )
শ্যামতারা : ওগো – এ আমাদের কি সব্বনাশ হলো গো ! আমি কি করে নাতপুতি তিনটেকে দুধ খাওয়াবো গো।
জগন্নাথ : আহা কি হয়েছে বলবে তো? নাকি ভ্যা ভ্যা করে কাঁদবে?
শ্যামাতারা : কি আর বলবো গো, বলার যে সব শেষ হয়ে গেছে গো (কাঁদে)
জগন্নাথ : তা হলে তুমি পা ছড়িয়ে কাঁদো – আমি চললাম।
শ্যামতারা : (হাত ধরে ) কোথায় পালাচ্ছো; আজকে একটা বিহিত তোমাকে করতেই হবে। নইলে আমি আজকেই বাপের বাড়ি চলে যাবো।
জগন্নাথ : তুমি যাবে কেন। দরকার হলে আমি যাবো। এবার বলো তো কি হয়েছে?
শ্যামতারা : ও এখনো বলিনি বুঝি ! ( শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে ) আমাদের বাড়ির পেছনের ভিটায় মাথামোটা ভেগাই দুটো বলদের সাথে জেদ করে গাভিন গাইটাকে জুড়ে আমনধান মাড়াই করছিল –
জগন্নাথ : তুমি এক মা হয়ে তাই দাঁড়িয়ে দেখলে?
শ্যামতারা : দেখলাম কই ! আমি ওর হাত টেনে বললাম – ওরে ভেগাই পোয়াতি গাইটাকে দিয়ে ধান মলিশ না। গাইটা দু চারদিনের মধ্যে বিয়ান দেবে।
জগন্নাথ : তুমি বলোনি কৃষকের ঘরে গাইগরু হলো মা লক্ষ্মী । ঘরের লক্ষ্মীকে দিয়ে লাঙল চালাই না। মলম দেওয়াই না। এমনকি হাইলানড়ি দিয়ে আঘাতও দেই না।
শ্যামতারা : বলেছিলাম তো; কিন্তু কে শোনে কার কথা ! উল্টে লেজ মুড়ে, লাঠিপেটা করে গাই বলদকটিকে কয়েকপাক লাগাতেই বিছানো ধানের উপর শুয়ে বাছুর প্রসব করে দিল গাভিন গাইটা। মাড়াই ধান ভিজে গেল ফুলভাঙা তাজা রক্ত জলে।
জগন্নাথ : গাইমাতা বাছুরটা ভালো আছে তো শ্যামাতারা ?
শ্যামাতারা : গাইটা স্থির হয়ে শুয়ে আছে আর সদ্যজাত বাছুরটা ওঠে দাড়াঁনোর চেষ্টা করছে।
জগন্নাথ : হে বাবা ত্রিনাথ ঠাকুর, তুমি গাইমাতাকে সুস্থ্য করে দিও ঠাকুর।
ওর শরীরে যে আমার মায়ের হাতের স্পর্শ এখনো লেগে আছে ঠাকুর।
শ্যামতারা : তুমি একবার চলো দেখে আসবে।
জগন্নাথ : না আমি ঐ পাষন্ড ভেগাইয়ের মুখ আর দেখবো না। শ্যামাতারা, সারাজীবনে তুমি আমি তো জ্ঞানত: কোন অন্যায় পাপ করিনি। কাউকে আঘাত দিইনি। মনপ্রান দিয়ে ঠাকুরের নাম করেছি । তাহলে এমন কুলাঙ্গার সন্তান আমাদের হলো কেন ?
শ্যামাতারা : আমি জানি না গো। জানি না ( কাঁদে )
জগন্নাথ : এই একটু আগে প্রতিবেশীদের তিনজন এসে ভেগাইয়ের একাধিক অপকর্মের কেচ্ছা শুনিয়ে অপমান করে গেল। জানি না এই বাড়িতে থাকলে ভবিষ্যতে আরো কত অভিযোগ অপমান সইতে হবে ভেগাইয়ের জন্য। যা আমি পারবো না।
তাই আমি এক্ষুণি এই ছেড়ে গ্রাম ছেড়ে নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করলাম।
শ্যামতারা : ( সামনে হাটুগেড়ে বসে হাটু ধরে ) একি বলছো তুমি ! এ ভাবে হঠাৎ ভরাসংসার ফেলে তুমি যেও না গো। যতই পাষন্ড হোক হোক, ভেগাই তো আমাদেরই সন্তান।
জগন্নাথ : ওঠো শ্যামাতারা। তুমি তো শুনেছো স্বয়ং গৌরাঙ মহাপ্রভু মানুষের মঙ্গলের জন্য মা ভাই স্ত্রীকে ত্যাগ করেছিলেন। সেই কারনে আমিও ভেগাইয়ের মঙ্গলের জন্যেই এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি শ্যামা।
শ্যামাতারা : তুমি চলে গেলে ভেগাইয়ের কি যে মঙ্গল হবে, তা আমার মাথায় আসছে না।
জগন্নাথ : আমি না থাকলে সংসারের দায় দায়িত্ব সবই ভেগাইয়ের উপর এসে পড়বে। তখন দেখো ভেগাই শুধরে যাবে।
শ্যামাতারা : যদি না শুধরোয় ?
জগন্নাথ : শুধরোবেই। জানো শ্যামা, আমাদের শক্তিশালী মাথামোটা ছেলেটা দুষ্টুমি দুরন্তপনা করলেও ওর মনটা যে খুব উদার মানবিক। তা আমি বেশ বুঝতে পেরেছি।
শ্যামাতারা : তাহলে আমাকেও তোমার সাথে নিয়ে চলো।
জগন্নাথ : তা হয় না। তুমি না থাকলে ভেগাইয়ের ছোট ছোট ছেলে মেয়ে তিনটিকে বড় করবে কে ? বৌমা তো একা সামলাতে পারবে না। ভালো থেকো- চলি ( ঝড়ের বেগে প্রস্থান )
শ্যামাতারা : ও রে ভেগাই ; ভেগাইরে। তুই আমার একি সব্বনাশ করলি রে ভেগাই – ( কাঁদে )
ভেগাই : ( প্রবেশ ) কি হয়েছে মা? এ ভাবে গলাছেড়ে ডাকছো কেন ?
শ্যামাতারা : ( পাগনিনীর মতো ভেগাইয়ের বুকে দুহাতে থাপ্পড় মারতে মারতে ) ওরে ভেগাই, তোরে আতুরঘরে নুন খাইয়ে মেরে ফেললে আজকে আমার এতোবড় ক্ষতি হতো না রে –
ভেগাই : তোমার গাই বাছুর তো সুস্থ্য হয়ে গেছে। এবার তো কান্নাকাটি থামাও।
শ্যামাতারা : ওরে না রে না। আমি গাই বাছুরের জন্য কাঁদছি না। তোর বাবা যে তোর ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে এইমাত্র চলে গেল রে। আমি কি করে তোর বাবাকে ছাড়া বাঁচবো রে ভেগাই –
ভেগাই : কি বলছ মা !
শ্যামাতারা : এই হতচ্ছাড়া নচ্ছার গোয়ারগোবিন্দ, আমি কি মিথ্যে বলছি। এ কি আমার বুকের বাঁ দিকটায় এমন চাপ লাগছে কেন ! কেন হঠাৎ ব্যথা করছে। কেন আমার কথা বলতে এতো কষ্ট হচ্ছে। আ: ( মৃত্যু। মায়ের মাথাটাকে কোলে নিয়ে )
ভেগাই : মা মা একি হলো আমার। একই দিনে আমি মা বাবা দু’জনকেই হারালাম। মা মাগো (কাঁদে) না আমিও আর এই বাড়িতে থাকবো না। এক্ষুনি আমি বাবাকে খুঁজতে নবদ্বীপ মথুরা বৃন্দাবন কাশীতে যাবো। বাবাকে খুঁজে পেলে বলবো – বাবা এই দেখ আমি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছি। আর কোনদিন আমি আর অন্যায় অসৎ কাজ করবো না। তোমাকে কথা দিলাম, আমি ভালো মানুষ হবো। তুমি বাড়ি চলো বাবা।
( নেপথ্যে গান : ” ওরে মন তুই খুঁজিস কারে ! মনের মাঝে সে জন আছে খুঁজলে পাবি তারে ” )
সূত্রধর : কোথাও বাবার অথবা ঈশ্বরের সন্ধান না পেয়ে বছরখানেক পরে সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হয়ে ফিরে এলো ভেগাই হালদার। কিন্তু তিনি আর সংসারে মনোনিবেশ করতে পারলেন না। তাই বাড়ির অদূরে আগৈলঝাড়া হাটের এককোনে ছোট্ট তৃণের কুটির নির্মাণ করে একাই জীবন যাপন ও সমাজ উন্নয়নের কাজে মেতে রইলেন।( প্রস্থান )
বাঘাই : ও বন্ধু এখানে চুপচাপ গুমমেরে বসে না থেকে চলো হরিসভাতে যাই।
ভেগাই : এতো তীর্থ ঘুরলাম কোথাও ঈশ্বরের সন্ধান দূরের কথা, খাঁটি সাধু সন্যাসীকেও পেলাম না। যিনি আমাকে ঈশ্বর দেখাতে পারেন। কাজেই হরিসভার কীর্তনে আর রামায়ন, ভাগবত পাঠে আর মন ভরে না। খালি সময় নষ্ট হয়।
বাঘাই : আরে সে জন্যই তো আমাদের হরিচাঁদ ঠাকুর বলেছেন – হাতে কাম আর মুখে নাম নাও। তাহলে হরিচাঁদ ঠাকুর নিজেই তোমাকে ডাকবেন। শোন ভেগাই, হরিসভাতে আজকে অশ্বনী কুমার দত্ত মশাই আসবেন ভাষন দিতে। চেনো তো তাকে ?
ভেগাই : কি বললি অশ্বিনী দত্ত। আরে ওনার মতো দেশনেতার নাম শোনেনি, এমন মানুষ বঙদেশে আছে না কি? চল চল। দেখে আসি। ( বাঘাই ভেগাই এগোনোর মাইম করে। লাইট এসে পড়ে ভাষনরত অশ্বিনী দত্তের মুখে )
অশ্বিনী দত্ত : হে আমার মা ও ভগ্নিগণ। আপনাদের মতো পূণ্যবতী স্বদেশ ভারতবর্ষ আমাদের মা। সেই স্বদেশ মা এখন সাদাচামড়ার দানবের থাবায় বন্দী। তাই আমরা পরাধীন। এই অশুভশক্তির নাগপাশ থেকে মুক্তি অথবা স্বাধীনতা আমাদের ছিনিয়ে আনতেই হবে। হে আমার স্বদেশী বীরপুরুষগণ, বীরাঙ্গণা মায়েরা আমার। আপনারা দলবদ্ধ ভাবে স্বাধীনতার লড়াইতে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবেন এই আশা করে আমার কথা শেষ করছি। বন্দে মাতরম।
ভেগাই : ( পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে ) এ আপনি কি কথা শোনালেন অশ্বিনীবাবু ?
অশ্বিনী : কি নাম তোমার ?
ভেগাই : অধমের নাম ভেগাই হালদার। গাঁয়ের সব্বাই আমাকে গোয়ারগোবিন্দ, মাথামোটা বলে। আমি পাপী। আমার জীবনের কোন দাম নেই।
অশ্বিনী : ভেগাই তুমি পাপকে চিনে নিজকে চিনতে পেরেছো। জ্বলতে জ্বলতে তোমার আত্মশুদ্ধি হয়েছে । দস্যু রত্নাকর সত্যের মুখোমুখিতে ঋষিবাল্মীকিতে পাল্টে গিয়েছিলেন।
কাজেই তুমি তোমার মনের শক্তিকে দেশের মানুষের কাজে লাগাও ভেগাই। শোন তুমি আমার বাটাজোরের অথবা বরিশালের বাড়িতে এসো। অনেক কথা আছে তোমার সাথে। আজকে আমি আসি (প্রস্থান )
নিশিকান্ত : ( প্রবেশ হাফাতে হাপাতে ) ভেগাইদাদা তোমারে অনেক খুঁজতে খুঁজতে এখানে এয়েচি।
ভেগাই : কি নাম তোমার? কোন গ্রামে বাড়ি ?
নিশিকান্ত : পাশের গাঁয়ে। মোর নাম নিশিকান্ত মিস্ত্রি।
ভেগাই : কি ব্যাপার ! আমাকে কেন খুঁজছো?
নিশিকান্ত : মোর খুব বেপদ গো দাদা। একমাত্র তুমিই এর বিহিত করতি পারো।
ভেগাই : আগে বলবি তো কি হয়েছে?
নিশিকান্ত : জমিদার বিহারীলাল চক্রবর্তীর পেয়াদা খাজনার নাম করে অর্দ্ধেকের বেশি ধান লইয়ে গ্যাচে। আমার পোয়াতি বউ বাঁধা দিতে গ্যালে পেয়াদা বৌডার কাপড় চোপড় ধরে টানাটানি করলো।
ভেগাই : আর তুই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলি ! কেন কুড়ুল বা হাতুরি দিয়ে পেয়াদার মাথা ফাটাতে পারলি না?
নিশিকান্ত : আমি তহন বাড়িতে ছেলাম না। খ্যাপলা জাল নিয়া গাঙে গেচিলাম মাছ ধরতে। একন পোলাপান লইয়া সারাবছর কি খামু। বৌটা আমার নজ্জায় ফোপাইতেছে আর কইচে – আমি গলায় দড়ি দিয়া ঝুইলা মরুম।
মোগো কি আর বাঁচনের পথ নাই ভেগাইদাদা !
ভেগাই : জমিদারের অত্যাচারে বাংলাদেশের কৃষকরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এর বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। চল্ জমিদারের কাচারী বাড়িতে যাই।
( দুজনে চলার মাইম করে )
নিশিকান্ত : এই উঠানটা পাড় হলেই কাচারীঘর।
বৃদ্ধা ( প্রবেশ ) হায় হায়। ওরে ও ভেগাই করলি কি? আমার শুকনা থান শাড়িটাকে ছুঁয়ে দিলি। জানিস না নমশুদ্দুর চাড়ালদের ছোঁয়া লাগলে উচাবর্ণের জাত চইলা যায়।
ভেগাই : ঠাকুমা আপনার জাত কোনদিক দিয়ে চলে গেল আমি তো দেখতে পেলাম না।
বৃদ্ধা : ওরে হাদারাম। এসব বাতাসের মতোন, চোকে দেখা যায় না। শাস্তরে লেখা আছে – অচ্ছুৎ ছোটজাতের ছোঁয়াচ লাগলে ভাতের হাড়ি ফাইটা যায়। ঘরে মন্দিরে ঢুকলে অপবিত্র হইয়া যায়। এসব কতা আগে শোনস নাই?
নিশিকান্ত : আমি শুইনেছি কারো ছোঁয়া লাইগলে গোবর চোনা আর গঙ্গাজল পান করলে পবিত্র হওন যায়। আইচ্ছা ঠাকুমা তুমি শাস্তর পড়িচো ?
বৃদ্ধা : চুপ কর ড্যামনা। তোদের দেখাচ্ছি মজা। বিহারী ও বিহারী, শিগগির এদিকে আয়। দেইখা যা দুইডা চাড়ালের পো চাড়াল আমার লগে কেমন ঝগড়া করতাছে।
বিহারীলাল : ( সাথে চাটুকার ধনপতিকে নিয়ে প্রবেশ ) কি হইচে মা? এভাবে ডাকতাছো ক্যান?
বৃদ্ধা : দ্যাখ দ্যাখ। এই ভেগাই হালদার আমার কাপড়টা ছুইয়া আবার মুকে মুকে তক্কো করতাছে। এখন এই বৈকালে আমারে আবার পুকুরে কাপড় কাইচা চান করন লাগবো। গঙ্গা গঙ্গা –
বিহারীলাল : তুমি কাপড় কাইচা চান কইরা একটু গঙ্গাজল ছিটাইয়ো। এখন যাও ( বৃদ্ধার প্রস্থান ) ভেগাই কাজটা তুমি মোটেও ভালো করনি।
ধনপতি : গাঁয়ে থাকবে অথচ হিন্দু ধর্মের জাতপাতের ভেদভাব মানবে না?
ভেগাই : আমি জানতাম না কত্তামশাই।
ধনপতি : জানতাম না বললেই কি সাতখুন মাফ করতে হবে নাকি? তাছাড়া তোর নামে অনেক অভিযোগ আছে। আজকে জমিদারবাবু সে সবের বিচার করবেন।
বিহারীলাল : হ্যাঁ বিচার করবো। প্রথম অভিযোগ মুছলমানের ছোঁয়া ভাত খেয়েছিস। দ্বিতীয় – তোর মায়ের শ্রাদ্ধশান্তি না করেই বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছিস।
ভেগাই : দুটি অভিযোগই অনেক দিন আগের কত্তামশাই।
ধনপতি : আগের তো কী হয়েছে। জমিদারবাবুর বিচারে প্রায়শ্চিত্ত তোকে করতেই হবে।
ভেগাই : গয়া কাশি বৃন্দাবন নবদ্বীপ গিয়ে আমি প্রায়শ্চিত্ত করে এসেছি।
বিহারীলাল : তাতে কি হয়েছে ! তোর গ্রামবাসী এবং কম করে এগারোজন ব্রাহ্মণকে দান দক্ষিণাসহ ভোজন না করালে তোর মায়ের আত্মা মুক্তি পাবে না ভেগাই।
ধনপতি : মানে স্বর্গে যাবে না।
ভেগাই : আমি গরিব মানুষ। মাত্র বিঘে তিনেক আবাদী জমিতে ছেলে মেয়ের ভরণপোষনই হয় না।
নিশিকান্ত : তার উপর আপনার পেয়াদাদের খাজনার জুলুম।
বিহারীলাল : বাকী খাজনা আদায় না করলে আমি ইংরেজ সরকার বাহাদুরের খাজনা দেব কি করে?
ভেগাই : তাই বলে নিশিকান্তের সারা বছরের খোরাকি কেড়ে আনতে গিয়ে মা বোনের কাপড় ধরে টানাটানি করবে?
ধনপতি : এই ভেগাই তুই কি জমিদার বাবুর কাছে কৈফিয়ৎ চাইছিস?
ভেগাই : হ্যা চাইছি। এই অঞ্চলের অত্যাচারীত কৃষকদের প্রতিনিধি হিসাবে আমি ভেগাই হালদার কৈফিয়ৎ চাইছি। মনে রাখবেন এরপর আপনার কোন পেয়াদা যদি কোন প্রজার গায়ে হাত তোলে, সে হাত আমরা ভেঙ্গে দেবো। আর প্রয়োজনে আপনার-
বিহারীলাল : তোর এতবড় সাহস তুই আমাকে চোখ রাঙাচ্ছিস। আজকে থেকে তোকে একঘরে করে রাখার আদেশ দিলাম। আজ থেকে তোর ধোপা নাপিত হাট বাজারে যাওয়া বন্ধ।
ভেগাই : (মৃদু হেসে ) আপনি আমাকে আর নতুন করে কি একঘরে করে রাখবেন জমিদারবাবু ! আমি তো একা একাই থাকি আর মানুষের মঙ্গলের কথা ভাবি।
বিহারীলাল : তোর ঔদ্ধত্য আর সহ্য করতে পারছি না। ধনপতি আমার চাবুকটা এক্ষুনি নিয়ে আয়।
ধনপতি : কত্তামশাই বলছিলাম কি আপনার চাবুকমারাটা ঠিক হবে না বোধহয়। কারন ভেগাই এখন অশ্বিনী দত্তের সাথে স্বদেশীর খাতায় নাম লিখিয়েছে। কৈলাশ সেনের সাগরেদ হয়েছে।
নিশিকান্ত : অশ্বিনীবাবু বলেছেন – তুমি হলে ভেগাই আর আমি হলাম চেগাই।
দুই জনেই স্বাধীনতার সৈনিক।
ধনপতি : ( হিসহিস করে বলে) তার উপর বিপ্লবীদের সাথেও যোগাযোগ থাকতে পারে।
বিহারীলাল : তাই বুঝি ! যা ভেগাই তোকে মাফ করে দিলাম।
নিশিকান্ত : আপনে আর কি মাফ করবেন। ভবিষ্যতে এই অঞ্চলের কৃষকরা আপনার বিচার করবেই করবে। ( দৌড়ে পালায়। ভেগাই ধীরপায়ে প্রস্থান। নেপথ্যে গানের কলি ” অবাক পৃথিবী অবাক করলে মোরে)
সূত্রধর : – ইতিহাসে অনেক দেশহিতৈষীদের কথা লেখা হয়নি। যেমন বরিশালের মানসী ফুল্লশ্রী গ্রামের কৈলাশ সেন মহাশয়। যিনি জমিদারি, ডিপুটি কালেকটরের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে 1893 সালে গৈলাতে সর্বজনের জন্য উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে নিজেই প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বভার বহন করেছন। এবং দেশের সেবায় নিজকে নিয়োজিত করেছেন।
ভেগাই, বিহারীলালের বাড়িতে অপমানিত হয়ে এখন কৈলাশ সেনের বাড়িতে এসেছেন।( প্রস্থান )
ভেগাই : মাষ্টারমশাই, বলুন তো আমি কি অস্পৃশ্য ! আমার ছোঁয়া লাগলে কী আপনার জাত চলে যাবে ?
কৈলাশ সেন : ( পিঠে হাত রেখে ) আগে শান্ত হয়ে এখানে বসো তারপর বলো কি হয়েছে ?
ভেগাই : আমরা নমো এবং মুছলমান ভাইয়েরা কাপড় বুনি, ধান চাষ করি, শাকসবজি ফলাই, আমরা দুধ দোয়াই,আমরা মাছ ধরি সবই এই দুই হাত দিয়ে। সে সব বিহারীলাল চক্রবর্তী বা উচ্চবর্ণের লোকেরা পরতে পারে, পেটপুরে খেতে পারে, সে বেলা কোন দোষ নেই। যতো দোষ আমাদের ছোঁয়া লাগলে ?
কৈলাশবাবু : দেখ ভেগাই কোন মানুষই অস্পৃশ্য অশুচি নয়। ব্রাহ্মণরা তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মের দোহাই দিয়ে সমাজে ভেদভাব প্রচার করেছে। তাই তথাকথিত শূদ্ররা সামাজিক বঞ্চনার শিকারে পরিনত হয়েছে। আমি তোমাদের দু:খ ক্ষোভ বুঝি ভেগাই। দেখোনা আমার গৈলা হাইস্কুলে হাতগোনা কতিপয় শূদ্র সমাজের ছাত্র আসে। তাদেরকে উচ্চবর্ণের ছেলেদের ছোঁয়াচ বাঁচাতে পেছনের আলাদা বেঞ্চে বসতে বাধ্য করানো হয়। আমি প্রধান শিক্ষক হয়েও অন্যান্য উচ্চবর্ণের শিক্ষকদের সচেতন করতে পারিনি। এ যে আমার কতবড় পরাজয় তা কাউকে বোঝাতে পারবো না।
শোন ভেগাই আজ তোমাকে দেখে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। কারন তুমি আজ সত্যের মুখোমুখি হয়েছ। তোমার বিবেকের মুক্তি ঘটেছে। এবার তোমাকে অনেক বড় কাজ করতে হবে ভেগাই।
ভেগাই : বলুন আমাকে কি করতে হবে?
কৈলাশবাবু : শোন ভেগাই। শিক্ষাই মানুষের কুসংস্কার থেকে মুক্তি দিতে পারে। তাই যতদিন মানুষের ভেতর সঠিক শিক্ষার প্রসার না ঘটবে, ততদিন মানুষের চেতনা বিচার বিবেচনা জাগ্রত হবে না। কেউ সম্মান যেচে দেবে না। সম্মান পাবার উপযুক্ত হয়ে উঠতে হবে তোমাদের।
ভেগাই : কিন্তু কি করে ?
কৈলাশবাবু : শোন তোমাদের গৈলা ফুল্লশ্রী গাঁয়ের আশেপাশে বিস্তীর্ণ এলাকায় নমো জেলে বাদ্যকার ছুতার মুসলমান, এক কথায় পিছিয়েরাখা শ্রেণীর বাস। অথচ তাদের শিক্ষা নেই , স্বাস্থ্য নেই । এই সকল নিরক্ষর মানুষের ছেলে মেয়েদের জন্য তুমি স্কুল গড়ে তোল ভেগাই।
ভেগাই : ( ওঠে দাঁড়িয়ে ) কি বলছেন মাষ্টারমশাই। আমি নিজে লেখাপড়া না জানা মুখ্যমানুষ। তাছাড়া আমার টাকাকড়ি লোকবল কিছুই নেই। আমি এতোবড় কাজ করব কিভাবে ?
কৈলাশবাবু : তোমার মধ্যে কতবড় শক্তি আছে তা তুমি নিজে জানো না। অথচ অশ্বিনী দত্তের মতো মহান মানুষ তোমাকে ঠিক চিনতে পেরেছেন। তোমার ভেতরের উদ্যমকে অনুধাবন করতে পেরেছেন।
ভেগাই : আমার সম্পর্কে এসব কথা অশ্বিনীবাবু আপনাকে বলেছেন ?
কৈলাশবাবু : বলেছেন তো ! শোন ভেগাই তুমি আগৈলঝাড়া গ্রামে একটা স্কুল গড়ো। শূদ্রদের জন্য শিক্ষার আলো আনো। ওদের সকলের দু:খ অপমান ঘুচিয়ে মাথা উচু করে বাঁচো। ক্ষণকালের জীবনের কির্ত্তি রেখে যাও ভেগাই।(ভেগাইয়ের কাধে ঝাকুনি দিয়ে ) বলো ভেগাই, আমি স্কুল গড়বোই। বলো বলো –
ভেগাই : হ্যাঁ আমি পারবো মাষ্টারমশাই। আমি পারবোই। আমি দোরে দোরে ভিক্ষা করেও পাঠশালা গড়বোই। জানেন কিছুদিন আগে বাবাকে খুজতে ফরিদপুরের ওড়াকান্দী ঠাকুরবাড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানে হরিচাঁদ পূত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর আমার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন – ওরে ভেগাই, হরিনামে মাতোয়ারা হয়ে ধেই ধেই করে উদ্দাম নাচন কোদন না করে দেশের কাজ কর। তুই পাঠশালা তৈরী কর। ছেলে মেয়েদের শিক্ষিত কর। মানুষের মনে ঞ্জানের আলো জ্বালা। আমি পারবো মাষ্টারমশাই। আমাকে পারতেই হবে। শুধু আপনি, অশ্বিনীবাবু আমার পাশে থাকবেন।( প্রনাম করে দুজনের প্রস্থান )
নেপথ্যে গান – ” আগুন জ্বালো আগুন জ্বালো।
ব্যর্থ প্রানের আর্বজনা পুড়িয়ে ফেলে
আগুন জ্বালো আগুন জ্বালো “
সূত্রধর : মাফ করবেন। আমি আর একবারই আপনাদের সামনে আসবো। কি করবো বলুন ! এতো আর সিনেমা নয় যে আড়াই ঘন্টাতেই একজন মহাপুরুষের জীবনী দেখিয়ে দেবো।
যাই হোক, 1905 সাল। চারিদিকে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে বরিশালে অশ্বিনী দত্তের নেতৃত্বে ভেগাই হালদার গ্রামে গ্রামে সভা সমিতি করেছন।
1906 সালে বরিশালের বঙ্গীয় প্রাদেশিক কনফারেন্সে আগত গন্যমান্য নেতাদের সাথে পরিচয় করিয়েছেন কৈলাশ সেন। ঐ সালেই বরিশালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের মাঝে বস্ত্র বিতরণের কাজ করেছন অশ্বিনীবাবুর সহকারি হিসাবে।
এসব ঘটনার আগেই ভেগাই হালদার তাঁর কুঁড়েঘরের পূর্বপাশে হোগলার বেড়া আর খড়ের ছাউনির নিচে নিম্নপ্রাথমিক স্কুল ( চতুর্থ শ্রেণী পযর্ন্ত ) চালানো শুরু করেছেন। সাথে দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র। অবশ্যই জনগণের আর্থিক সাহায্যে।
এবার কি করে হাইস্কুলে পরিনীত করা যায় তাই ভাবছেন ভেগাই হালদার। এমন সময় তার স্ত্রী তারামণি এসে হাজির হন। ( প্রস্থান )
তারামণি : একি চেহারার অবস্থা বানিয়েছ তুমি !
ভেগাই : কেন ঠিকই তো আছি।
তারামণি : বড়ছেলেকে ভাতসহ ফেরত পাঠিয়েছ কেন?
ভেগাই : সকালে সুজনকাঠি গ্রামে গিয়ে
অনেককে অভুক্ত থাকতে দেখে এসেছি। তাই খেতে ইচ্ছে হলো না।
তারামণি : আজকাল প্রায়ই তুমি এই ঘরে থাক না। ছেলেরা ভাত ফেরত নিয়ে যায়। কেন খাচ্ছো না তুমি !
ভেগাই : তারামনি, তোমাকে তো আমার কাছে আসতে বারন করেছিলাম। তবুও কেন এসেছ ?
তারামণি : তুমিই তো আসতে বাধ্য করলে। আজকাল প্রায়ই ভাত ফেরত দিচ্ছো। এভাবে না খেয়ে খেয়ে শরীরের অবস্থা করেছ তাও বুঝতে পারছ না। যে তুমি এক সময় একটা কচিপাঠা, পাঁচ ছয়জনের ভাত খেতে পারতে একথা আজকের ছেলেমেয়েরা বিশ্বাসই করবে না।
ভেগাই : তারামণি তুমি তো কোনদিন নিজের বাড়ি ছেড়ে বেরোয়নি, তাই জানো না। আমার এই বঙ্গদেশের অনেক মানুষ পেটপুরে খেতে পায় না। তাদের বুকের পাজরের হাড়গুলো গোনা যায়। ওদের পরনে বস্ত্র নেই, শিক্ষা নেই, আত্মসম্মান বোধ নেই।
ওদের কথা মনে পড়লে আমার আর খেতে ইচ্ছে করে না তারামণি।
তারামণি : তুমি সারাজীবন দেশের মানুষের কথাই ভাবলে সাধু ! আমি যে এতো বছর কি ভাবে কত কষ্ট করে দুটি ছেলে ও একটি মেয়েকে বড় করেছি তা তো কখনও জানতেও চাওনি?
ভেগাই : এখন তো তোমার কষ্টের অবসান হয়েছে। ছেলেদের বিয়ে দিয়েছ। তোমার নাতি পুতি হয়েছে। মেয়েটাকে ভালো ঘরে বিয়ে দিয়েছ।
আমি তোমাদের সব খবর রাখি তারামণি।
তারামণি : আচ্ছা তোমার কি নাতি পুতিদেরও দেখতে ইচ্ছে করে না?
ভেখাই : করে তো – –
তারামণি : তবে বাড়িতে যাও না কেন?
ভেগাই : আমার পাঠশালার এতোগুলো ছেলেমেয়েকে ফেলে রেখে মাত্র দুজনকে দেখতে যাবার সময় কোথায় আমার ! তাছাড়া আর কিছুদিন পরে আমার নাতি পুতিরাও তো আমার সামনে দিয়ে এই পাঠশালায় পড়তে আসবে, তখন রোজ দেখবো, আদর করবো। কোলে নিয়ে বলবো – দ্যাখ এই গন্ডমূর্খ গোয়ারগোবিন্দ আমি ভেগাই হালদার তোদের ঠাকুরদাদা। তোদের যেন কেউ এসব কথা না বলতে পারে।
তারামণি : আজকাল তুমি কত সুন্দর সুন্দর কথা বলো। দেশের মানুষ তোমায় কতো ভালোবাসে, সম্মান করে। আজকে তোমার মা বাবা কাছে থাকলে কত খুশি হতেন। তোমার জন্য গর্বে তাদের বুক ভরে যেতো !
ভেগাই : তোমার গর্ব হয় না?
তারামনি : হয় তো। জানো – আশে পাশের হিন্দু মূছলমান বৌরা প্রায়ই তোমার সেবার জন্য ফলমূল, তরিতরকারি, পিঠে পায়েস নিয়ে এসে তাদের দু:খ বেদনা আনন্দের কথা বলে যায়।
ভেগাই : তুমি ওসব গ্রহণ করো কেন ! বারণ করতে পারো না?
তারামণি : ওরা যে তোমাকে বাকসিদ্ধ সাধু পয়গম্বর ভাবে। ওদের বিশ্বাস তোমার আর্শীবাদে সকলের সুখ শান্তি ফিরে আসবেই।
ভেগাই : আমাদের অঞ্চলের মা বোনদের সমস্যা আমি বুঝি বলেই তাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বলি – তোমাদের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখাও, তাহলেই নারীর উপর পুরুষের অত্যাচার কিছুটা কমবে। এবার থেকে তুমিও এই কথাগুলো ওদের বুঝিয়ে বলবে। আরো বলবে – আমি সাধু পয়গম্বর নই। আমি অতি সাধারণ একজন মানুষ। যে সকল মানুষের মঙ্গল চায়।
তারামণি : ঠিক আছে বলবো। তবে ওদের বিশ্বাসকে আমি আঘাত দিতে পারবো না।
ভেগাই : জানো তারামণি; আজকাল বাবার গাওয়া একটি গানের সুর ও কথা প্রায়ই মনে পড়ে। শুনতে খুব ইচ্ছে করে।
তারামণি : বাবা তো অনেক ঠাকুরের গান গাইতেন। তুমি কোন গানটার কথা বলছো গো ?
ভেগাই : ঐ যে পদকর্তা রজনীকান্ত সেনের গানটা ” কবে তৃষিত এ মরু ছাড়িয়া যাইবো তোমারি রসালো নন্দনে”। একটিবির গানটি শোনাবে তারামণি?
তারামণি : তুমি আমার গান কি কখনো শুনেছ !
ভেগাই : শুনেছি তো। তুমি ঠাকুরের থানে সন্ধ্যা প্রদীপ দিয়ে কাসর ঘন্টা বাজানোর পরে,বাবার সাথে গলা মিলিয়ে গাইতে। কখনোবা মেয়ের মাথার উকুন বাছতে বাছতে গান গাইতে। আমি তখন আড়াল থেকে শুনতাম। কি যে ভালো লাগতো। গানটি গাও নাগো !
তারামণি : গাইতে পারি, কথা দাও- খাবার পাঠালে খাবে?
ভেগাই : খাবো গো খাবো।
( তারামণি গাইবে। সম্ভব হলে ভেগাই কন্ঠ মেলাবে )
তারামণি : জানো, তোমাকে দেখতে, তোমার সেবা করতে আমার যে খুব সাধ জাগে গো। (গলা ভেঙ্গে আসে )
ভেগাই : ( তারার মাথায় হাত বুলিয়ে ) তারামণি আমি তো তোমার মনের মধ্যেই আছি। যেমনটি তুমি আছো আমার মনে।( দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে )
তারামণি সবাই যদি বাড়ি ঘর বিষয় সম্পত্তি ছেলমেয়ে নাতিপুতি আর অর্থের বন্ধনে আবদ্ধ থাকে, তাহলে দেশের কাজ করবে কে ? যাও বাড়ি যাও। আমাকে আর মায়ার বন্ধনে বেধো না। যাও –
তারামণি : যাবার আগে মুখ্য মেয়েমানুষের একখান কথা মনে রেখো সাধুকর্তা, দেশের সেবা করতে হলে নিজেকে খেয়েদেয়ে সুস্থ্য থাকতে হয়।
ভেগাই : বা: একখান জব্বর কথা শোনালে খোকারমা। এই না হলে আমার বউ। যাও তোমাকে কথা দিলাম এবার থেকে যে যা খেতে দেবে সব খাবো। খুশি তো?
( তারামণি সলজ্জ হেসে বড় করে ঘোমটা টেনে প্রস্থান করে। নেপথ্যে এই গানের তিন চার লাইন হবে। ” আমার ভেতর বাহিরে আছো তুমি অন্তর জুড়ে)
হরভূষন : ( প্রবেশ ) ও সাধুকাকা বৈসা বৈসা তন্দ্রা গেলেন না কি?
ভেগাই : না না কও মাষ্টার কি কইবা !
হরভূষন : এই ছোট্ট স্কুলে তো ছাত্রছাত্রীগো বসনের জায়গা দেওয়াই মুশকিল হইয়া পড়ছে। হের ওপর আপনে গেরামে গেরামে ঘুইরা ঘুইরা পোলাপান আনতাছেন। আইজকাল আবার দূর দূর থাইকা ছাত্রের বাপেরা আসে আপনের ইস্কুলে ভর্তি করনের লাইগা।
ভেগাই : আমার ইস্কুল কও ক্যান মাষ্টার ! কও তোমাগো ইস্কুল। তোমরা মাষ্টাররা কম মায়নায় ভালো কইরা পড়াও তাই ওরা আসে।
হরভূষন : এবার হাই ইস্কুল না করলে চলবে না কাকা।
ভেগাই : হাইস্কুল করতে হলে আমার ঐ একবিঘা জমিতে হবে না মাষ্টার। কমপক্ষে পাঁচ দশবিঘা জমিতো লাগবেই। যাতে খেলার মাঠ,হাডুডু, দাইড়াবান্ধা, লাঠিখেলা ও কুস্তি খেলাও শেখানো হবে। ছাত্রাবাসের কথাও ভাবতে হবে কি বলো !
হরভূষন : ছাত্তরা অন্যের বাড়িতে যেমন লজিং থাকছে তেমনি থাকবে।
ভেগাই : কথাটা মন্দ কও নাই। এখন আমাদের কাজ হলো জমির ব্যবস্থা করা।
হরভূষন : রামচরন বাড়ৈগো হাটের উত্তর দিকে জঙ্গলেভরা অনেকটা জমি পইড়া আছে। আমরা সবাই মিল্যা রামদের বাড়িতে যাইয়া কতা কইলে হয় না ?
ভেগাই : উত্তম প্রস্তাব। এহনি চলো। শুভকাম ফালাইয়া রাখলে চলবে না। চলো –
হরভূষন : সাধুকাকা আর যাওন লাগবে না। ঐ দেহেন রামচন্দ্র বাড়ৈ এদিকপানেই আসতিছে।
ভেগাই : ও বাবা রামচরন মোর কাছে একটু আসো দেহি।
রাম : আপনের কাছেই আইচিগো সাধুকাকা। ছোড পোলাডার এবার হাইস্কুলে ভর্তি করন লাইগব।
ভেগাই : রামচরণ তুই খালি নিজের পোলার কথাই ভাবছিস ! আমরা ভাবছি সক্কলের পোলামাইয়াদের কথা। হেরা যাতে কেউ মোর মতোন মুখ্যু হয়ে না থাকে। ওদের যেন কেউ চাড়াল বলে গাইল দিতে না পারে। হেই কতা ভাবছি।
হরভূষন : কাকা আপনেরে তো আইজ মুখ্যুমানুষ কেউ কয় না। কয় মহাত্মা ভেগাই হালদার।
ভেগাই : ওরা ভুল বলে। মহাত্মা বিষেশনটা পুনা শহরের জ্যোতিরাও ফুলেকেই মানায়। আর কাউকে না। যাকগে কাজের কথায় আসি। তুই তো জানস, মুই একজন ভিখারী। ভিক্ষা কইরাই ইস্কুল বানাইছি। কারো বাড়ির অনুষ্ঠানে নিমতন্ন করলে বলি – আমাদের ইস্কুলের নামে যদি মোটাটাকা চাঁন্দা দাও, তাইলেই তোমার বাডিতে নিমতন্ন খাইতে যামু।
হরভূষন : আমরা এসব কতা জানি কাকা। আপনার সততা ও সৎ প্রচেষ্টার জন্যে সব্বাই আপনেরে সাধুকর্তা বলে ডাকে।
ভেগাই : বুঝলা রামচরণ, এই হরমাষ্টারের মতন লেখকরা অসৎ চোর ডাকাইতকেও মহৎ বানাতে পারে। আবার ইচ্ছে করলে চোর জোচ্চর ঠকবাজ বানাতে পারে। হা: হা: হা:
রাম : কন কাকা কি যেন কইবেন আমারে?
ভেগাই : ইস্ক্রুলডারে হাই ইশকুল বানাতে হবে আর এর জন্য তোমাদের মতোন ধনবানদের মোটাটাকা দান করতে হবে।
রাম : কন কাকা কতট্যাকা আমারে দিতে হইবো কন। প্রেয়জনে জমি বেইচা ইস্কুলের জন্য ট্যাকা দিমু।
হরভূষন : ট্যাকা তো আমরা অন্যের কাছথন নিতে পারুম।
রাম : তাইলে কি চান আপনেরা?
ভেগাই : তোর বাপে বাইচা থাকলে তিনিও আমারে নিরাশ করতো না।
হরভূষন : এই হাটের উত্তর পাশের একদাগের জমিডা তুমি ইস্কুলের নামে দানপত্র কইরা দাও রামচরন।
রাম : সাধুকাকা, আপনিই তো কন্ – ধন সম্পত্তি হইল অনিত্যবস্তু। তা যতক্ষণ বহুজন মানুষের সেবায় না লাগে, তার কোন মূল্য নাই। তাই আপনার কতাতে জমিডা ইস্কুলের নামে দিয়া দিলাম। শুধু আর্শীর্বাদ করেন – আমার একটা ছেলে যেন আপনার মতো জনদরদি মানুষ হয়।
ভেগাই : হা: হা: হা আমি কি বাকসিদ্ধ মহাপুরুষ যে আমি আর্শীবাদ করলেই তা ফলবে ! তবে আমি কামনা করি তোর পোলা যেন তোর মতন খাঁটি মানুষ হয়। তাহলে মাষ্টার, আমাদের জমির সমস্যা মিটলো। এবার আমাকে অর্থ সংগ্রহের জন্য ফজলুল হক, অশ্বিনীবাবু, চিত্তরঞ্জনবাবুর মত আরও দেশনেতাদের কাছে যেতে হবে। আর তোমরা হাত জোড় করে সক্কলের কাছে সাহায্য চাইবা। কেউ একট্যাকা দিলেও নেবে।
হরভূষন : আ রে ! একজন গোরাসাহেব সেপাই নিয়া আপনার কাচেই আসতেছেন।
ভেগাই : আসতে দাও। ভয়ডা কিসের আমরা তো দেশদ্রোহী নই।
সাহেব : (প্রবেশ) Are you hounorable Bhegai Haldar ?
হরভূষন : No. I am Harabhushan. Bengali teacher of this school. This man is great Begai Haldar.
সাহেব : (হাত বাড়িয়ে ) Nice to meet you.
ভেগাই : নমস্কার সাহেব। আমি নিরক্ষর মানুষ। সঠিক বাংলা ভাষাতেই কথা বলতে পারি না।
সাহেব : হামি এইডেশে আসিয়া অল্প অল্প বাংলা বলিতে পারে। হামি বাখরগঞ্জ জেলার ম্যাজিস্ট্রেট মি: জে আর ব্লাকউড। হাপনার মতন গ্রেটম্যানকে দেখিটে অ্যান্ড স্কুল ইনেসপেকশন করিবার জন্য বাবু অশ্বিনী দত্ত্, কৈলাশ সেন ইনভাইট করিয়াছিলেন। তাই আসিয়াছি।
ভেগাই : আমরা ধইন্য সাহেব। একবার বঙ্গদেশের গর্ভর্ণরের কাছ থেকেও আমি ইস্কুলের জন্যে চান্দা এনেছিলাম। এবারও যাব। ঐ খড়ের ছাউনির ইস্কুল যা দেখছেন সবটাই মানুষের দানের টাকায় হয়েছে।
সাহেব : অনেক ছাত্রদের দেখিয়া হামার ভালো লাগিয়াছে। এবার হাপনি বলেন, হামি হাপনাকে কি ভাবে হেল্প করিতে পারি ?
ভেগাই : সাহেব এই ইস্কুলটাকে আমরা হাই ইস্কুল বানাতে চাই। আপনাকে অনুমোদন করে দিতে হবে ।
সাহেব : হাইস্কুলের অনুমোদন পাইতে হইলে হাপনাকে জমি ও ঘর দেখাইতে হইবে। আন্ডারস্টান্ড !
হরভূষন : হাইস্কুলের জন্য দশবিঘা জমি এই রামচরণ বাড়ৈ মশাই দিয়েছেন।
রাম : পাঠশালার ঘরও আমরা তুইল্যা ফেলবানে অল্পদিনের মধ্যে।
সাহেব : দেন ওকে। ঘর তৈয়ার হইলে অ্যাপ্লিকেশন লইয়া হামার কাছে আসিবেন। ভেগাইবাবু, হাপনার স্কুলের জন্য হামি ফোর হান্ড্রেট ফিফটি টাকা ডোনেট করিতেছি। পরে আরো দিব।
ভেগাই : এই খাতাতে আপনি নিজে লিখে দিন সাহেব।
হরভূষন : খাতাটার দুই চাইর পৃষ্ঠা উল্টাইয়া দেখেন সাহেব, যারা নিজেরা লিখতে পারে তারা দানের টাকা ও ঠিকানা লিখেছেন। আর যারা লিখতে পারে না, তারা অন্যকে দিয়ে লিখে দিয়েছেন।
সাহেব : রিয়েলি আজকের দিনে ভেগাইবাবুর মতোন সট ও সাধু মানুষ হামি কোনডিন ডেখি নাই। খাতাটে হামি লিখিয়া দিলাম। Contribution Rs 450 /- granted by the Magistret of Bakhargong.
হরভূষন : Thank you hounarable Magistret সাহেব।
সাহেব : বাই দা বাই। হামি শুনিয়াছে হাপনি জীবনে ভালো জামা প্যান্ট পায়ে জুতা পরেন নাই কেন ?
ভেগাই : শোন সাহেববাবা, আমার দেশের বহু মানুষের পেটে ভাত নেই, পরনে কাপড় নেই, শিক্ষা নেই, স্বাস্থ্য নেই, সে দেশে আমার কি জামা জুতো পরা শোভন হয় ! তাছাড়া কৈলাশবাবুর কাছে শুনেছি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মশাই মস্তপন্ডিত ও অর্থবান ছিলেন। তিনি ছেলেদের জন্য স্কুল করেছেন, কত বই লিখেছেন, কত দানধেন করেছেন। শেষ জীবনে যখন বুঝলেন সবচাইতে পিছিয়েরাখা আদিবাসীদের জীবনে আক্ষরিক শিক্ষা ও স্বাস্থের উন্নয়নের জন্য ইংরেজ সাহেবরা এবং দেশীয় বাবুসমাজ কিছুই করেনি। তখন থেকে বাকি জীবন ওদের শিক্ষা ও স্বাস্থের সেবা করেছেন। সেই মহান পন্ডিত মানুষটা সারাটা জীবন একখানি কাপড় পরনে ও গায়ে জড়িয়ে, খরমপায়ে কাটালেন ! সেখানে আমি এক গন্ডগ্রামের মুখ্য ভেগাই হালদার যে কিনা ভিক্ষা করে একটা স্কুল করতেই জীবনপাত করছে।
আমার কি জামাজুতো পরা সাজে ! সাজে না।
সাহেব : রিয়েলি ইউ আর এ গ্রেটম্যাম। আই সেলুট ইউ। মানে আপনার মতোন মহান ব্যক্তিকে হামি প্রনাম জানাইতেছি। এবার আমি যাইতেছি। বাই বাই ( প্রস্থানের সাথে সাথে সবাই শ্লোগান দেয়। জয় সাধু ভেগাই হালদারের জয়।
জয় ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের জয়। নেপথ্যে গান – মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রান হলো বলিদান লেখা আছে অশ্রুজলে )
(চিত্তরঞ্জন দাসের বাড়ি )
ভেগাই : শতকোটি প্রনাম দাসবাবু।
চিত্তরঞ্জন : তোমাকেও প্রনাম। তা আমার বাড়ি খুঁজে পেতে কষ্ট হয়নি তো
ভেগাই : শিয়ালদহ স্টিশনে নেমে তিনজনকে জিঞ্জাসা করলাম স্বদেশপ্রেমি চিত্তরঞ্জন দাসের বাড়িতে যাব কোনরাস্তায় ! দুইজন বলল – জানি না। একজন রাস্তাটা দেখিয়ে দিল চলে এলাম।
চিত্ত : তুমি কি এতোটা রাস্তা পায়ে হেটে এলে ?
ভেগাই : হ্যা যে পয়সাটা বাস বা ট্রাম কোম্পানিকে দিতাম তা আমি আগৈলঝাড়া স্কুলকে দেবো তাই আরকি –
চিত্ত : তা কি মনে করে ? শুধু কি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ না কি ফজলুল হক, সাহিদুল্লার সাথেও দেখা করবে ?
ভেগাই : হাইস্কুলের জন্য চাঁদা চাইতে, অনুমোদন নিতে আরো অনেকের কাছে যাবো।
চিত্ত : বা: তুমি শেষ পযর্ন্ত তোমার উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়কে হাই ইংলিশ স্কুল বানাবেই। বেশ বেশ। বঙ্গদেশে গুরুচাঁদ ঠাকুর আর তোমার মতো আরো কয়েকজন শিক্ষা আন্দোলনের হোতা থাকলে অদূরেই নিরক্ষরতার অন্ধকার কেটে যেতো। কিন্তু ভেগাইবাবু আমার হাতে যে এখন তেমন টাকা নেই। ক’দিন কোর্টে যেতে পারিনি। এখন যাচ্ছি কোর্টে। হাতে টাকা এলেই তোমাকে দিয়ে দেবো। এই কে আছিস?
বাসন্তদেবী : সবাই কাজে ব্যস্ত। তুমি আমাকে বলো।
চিত্ত : ইনি শ্রদ্ধেয় ভেগাই হালদার। অশ্বিনী দত্তের সহযোগী। বরিশাল থেকে এসেছেন। এর থাকবার ঘরটা দেখিয়ে দিও। আমি আসি বাসন্তী (প্রস্থান )
বাসন্তী : চলো বাবা তোমার থাকার ঘর, স্নানের ঘর দেখিয়ে দিই ( প্রস্থান )
( কিছুটা বিরতির আবহসঙ্গীত)
( ভেগাই অপমানের জ্বালায় পায়চারি করবে। একটু পরে চিত্তরঞ্জন দাসের প্রবেশ )
চিত্ত : কি হলো বাবু ভেগাইচন্দ্র দুপুরে খাওয়া, বিশ্রাম ভালো হয়েছে তো ! এতোদূরের জার্নি। ঘুম হয়েছে একটু !
ভেগাই : আপনার বাড়িতে আর একদন্ডও থাকবো না। এ বাড়ির অন্নজলও গ্রহণ করবো না
চিত্ত : কেন কি হয়েছে আমায় বলো।
ভেগাই : আমাকে ময়লা অপরিচ্ছন্ন দুর্গন্ধময় জায়গায় খেতে দেওয়া হয়েছিল। আমি এতে অপমান বোধে না খেয়েই উঠে পড়েছি। আচ্ছা আমি নম:শৃদ্র হলেও আমার কি কোন আত্মসম্মান নেই। আপনারা সভায় ভাষন দিতে গিয়ে বলেন – হে আমার ভাই ও বোনেরা। বলেন তো ! সেই কথা বিশ্বাস করে আমরা সংখ্যাধিক অন্তজ অস্পৃশ্য মানুষেরা ঐ সকল সভাতে ভীর করে আপনার মতো উচ্চবর্ণের নেতাদের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে চিৎকার করে বলি – বন্দে মাতরম । আমরাই পলাশির যুদ্ধে, সিপাহী বিদ্রোহে ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াইতে আত্মাহুতি দিই। অথচ আপনাদের ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম লেখা হয় না।
চিত্ত : কাকাবাবু আপনি শান্ত হোন। আমি আপনার সবকথা মানছি। এই সব কারনেই 1905 সালে বঙ্গভঙ্গরোধের আন্দোলনে মহামানব গুরুচাঁদ ঠাকুরের সমর্থন পেতে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর চিঠির জবাবে তিনি লিখেছিলেন – সর্বপ্রথম আপনারা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে অনুন্নত অস্পৃশ্য জাতি সমুহের প্রতি ভ্রাতৃত্ত্বভাব আনুন। ওদের অন্তর থেকে ভালোবাসুন। তাহা না হইলে কোনদিনই
বাংলার অনুন্নত সমাজ উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সহিত মিলিত হইয়া কোনপ্রকার স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান করিতে সমর্থ হইবে না। কাকা আপনি বসুন। আমি দেখছি, বাসন্তী বাসন্তী শুনে যাও –
বাসন্তী : কি হলো ! এভাবে রাগতস্বরে ডাকছো কেন?
চিত্ত : বাসন্তী তুমি কী জানো তোমার বাড়িতে একজন সম্মানীয় অতিথি অভুক্ত রয়েছেন ! কেন না তাকে পায়রার খাঁচার পাশে উঠোনে বসিয়ে খেতে দেওয়া হয়েছে ?
বাসন্তী : আপনি চাকর বাকরদের এক বিরাট বাহিনী তৈরী করেছেন। তারা আপনার উদারতার সুযোগ নিয়ে নিজেদেরকে বাবু ভাবতে শুরু করেছে। ওরা জেনে গেছে এবাড়ির রুপোর থালা চুরি করলেও ছাড় পাওয়া যায়।
চিত্ত : আ : সঠিক উত্তর দাও।
বাসন্তী : আমি তখন স্নানের ঘরে ছিলাম। আমার মনে হয় ঝি চাকর পাচকরা ওনার পদবি আর পোশাক দেখে জাতের বিষয়টা জেনে গিয়েছে। তাই এমন একটি কান্ড করেছে।
চিত্ত : ঝি চাকর রান্নার পাচকদের মধ্যে যারা জাতপাতের শুচিবাইগ্রস্থ তাদের তাড়িয়ে দাও।
ভেগাই : না না ওদের শাস্তি দেবেন না। বরং নিজেরা সংশোধিত হয়ে ওদেরকে সংশোধন করুন।
বাসন্তী : ঠিক আছে তাই করবো। কাকাবাবু আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমার ভুলের জন্যই আজকে আপনাকে অপমানজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে।
ভেগাই : না মাজননী, তোমার নি:স্বার্থ দেশপ্রেমের কথা আমি জানিগো। তুমি ছিলে তাইতো চিত্তরঞ্জন দাস আজ দেশনেতা হতে পেরেছেন। তোমার মতো সব মা মেয়েরা এগিয়ে না এলে তো দেশমাতার বন্ধনমুক্ত হবে না মা।
চিত্ত : বাসন্তী, এই মহাত্মাকে দেখেই আমি বিলেত থেকে জামা সুট প্যান্ট কিনে, লন্ড্রী থেকে কাচিয়ে আনা বন্ধ করেছি। বুঝতে শিখেছি পোশাক পরিচ্ছদ দেখিয়ে আর ভাষন দিয়ে দেশের মুক্তি আনা যায় না। অন্তজ সমাজের মানুষকে তথা মনুষ্যত্বকে যদি আমরা প্রথম থেকে মর্যাদা দিতাম, যদি ওদের স্বত্ত্বা অধিকার থেকে বঞ্চিত না করতাম, তাহলে ওদের ব্যবহারিক জীবনও আমাদের থেকে ভিন্ন হতো না। আমরা অন্যায় করে যে আত্মসচেতনার পথে ওদেরকে ছোটজাত বলে রুদ্ধ করে রেখেছি, সমাজের সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমাদেরই করতে হবে বাসন্তী। সেটা আজ থেকেই করতে হবে। কাকা তুমি আমাকে ক্ষমা করো।
ভেগাই : ছি: ছি : আপনার মতো দেশনেতার এসব মানায় না।
চিত্ত : বাসন্তী আজ থেকে কাকা আমার পাশের চেয়ারে বসে আমার সঙ্গে খাবে। তুমি নিজে পরিবেশন করবে।
বাসন্তী : রোজ বুঝি করিনা? তবে কথা দিচ্ছি ভেগাই কাকাবাবুকে আমি নিজে হাতে রান্না করে খাওয়াবো।
ভেগাই : কিন্তু মা আজকে এক্ষুনি আমাকে ফজলুল সাহেবের কাছে যেতেই হবে।
বাসন্তী : আবার আসবেন কথা দিন।
ভেগাই : যদি কখনো কইলকাতায় আসি, তখন অবশ্যই আসবো।
চিত্ত : আজকে মক্কেলদের কাছ থেকে মাত্র একহাজার টাকা পেয়েছি। পুরো টাকাটাই স্কুলের জন্য দান হিসাবে গ্রহন করুন কাকা –
ভেগাই : চলি – ( সকলের প্রস্থান )
সূত্রধর : আগৈলঝাড়া স্কুলটা ষষ্ঠ শ্রেণী পযর্ন্ত অনুমোদন সেই 1917 সালেই পেয়েছে। এখন দশম শ্রেণী পযর্ন্ত পেয়েছে। 1926 সালে প্রধান শিক্ষক ছিলেন বিধুভূষন সরকার।
ভেগাই হালদার নিজে বোঝেন এখনো অনেক পথ যেতে হবে। অনেকের কানে পৌছাতে হবে স্বজনের কথা। প্রতিকার চাইতে হবে নিজেদের ভাষায়। এ কে ফজলুল হক বাংলার চাষিদের দু:খ- দুর্দশার কথা বোঝেন। তাকে বলতে হবে। চাষিরা কি ভাবে কতটা জমিদার তালুকদারদের যাঁতাকলে অত্যাচারিত, ঋণজালে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। কংগ্রেসের কোলকাতা সন্মেলনে ভেগাই হালদার বাংলা ভাষায় বলে এসেছে, গোটা একটা জাতি ও কৃষকের সমস্যার কথা। অনেক নেতা অনেক কথা মঞ্চে বলেছেন। কিন্তু কেউ বলেনি দারিদ্র্য অশিক্ষা জাতপাতের নাগপাশ না ছিড়লে দেশটা কিভাবে সত্যিকারের স্বাধীন হবে? ভেগাই গুছিয়ে বলতে পারেনি। তবুও তার মতো করে বলেছেন। তাই শুনে ফজলুল হকের বিশ্বাস জন্মেছে ভেগাই হালদারই পারবে বরিশালের কৃষকমুক্তির পথ দেখাতে। তাই ওকে দিয়েই করাতে হবে আগৈলঝাড়ার কৃষক সন্মেলন।
অগত্যা 1926 সালে আগৈলঝাড়ায় ভেগাই হালদারের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় রায়ত কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হলো। এতে সর্বক্ষণের সহযোগি ছিলেন যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। সেদিন এই তরুণ তুর্কিই বুদ্ধি করে গৌরনদী থেকে হিন্দু মহাসভার নেতা পদ্মরাজ জৈন এবং কংগ্রেসনেত্রী সরোজিনী নাইডুকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। 1925 সালেই যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল বুঝেছিলেন – এই দুটি রাজনৈতিক দলই ভারতের পক্ষে বিপদজনক। কারন এরা ব্রাহ্মণ ও বানিয়াদের তোষণকারী এবং দলিতদের দলনকারী দল। কুর্ণিশ জানাই এই দূরদৃষ্টির জন্য যোগেন্দ্রনাথকে।
যাহোক জনসভাতে অসংখ্য পল্লীবাসীদের দেখে ভেগাইয়ের ভয় করেনি, ভয় করেছে মঞ্চে বসা সভাপতি হাসেম আলী খান, সভা পরিচালনা করছেন সর্বত্যাগী জননেতা বাণীকন্ঠ সেন। সভায় ভাষন শেষে বসে আছেন পন্ডিত মদনমোহন মালব্য, সমাজ সেবিকা সরলা দেবী, অশ্বিনী দত্ত ও কৈলাশ সেন। আর বলেছেন যুবনেতা যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। (প্রস্থান)
(নেপথ্যে সমবেত কন্ঠস্বর – আমরা সাধু ভেগাই হালদারের কথা শুনতে চাই )
ভেগাই : আমার আপনজন হিন্দু মুছলমান ভাইয়েরা ! মুই নেতা হওনের জন্য এই জনসভার আয়োজন করি নাই। করছি আপনাগের সমস্যার কথা, দু:খ- কষ্টের কথা মঞ্চে বসা গণ্যিমাণ্যি নেতাদের শোনাইবার জন্যি যাতে ওনারা জমিদার তালুকদারের খাজনার অত্যাচার, চক্রবৃদ্ধিহারে সুদের অত্যাচার, বিনা মজুরিতে কাজ করানোর অত্যাচার বন্ধ কইরতে পারেন। আপনেরা জানেন মুই ইস্কুলের জন্যি ভিক্ষার পাত্র নিয়া লোকের বাড়ি বাড়ি ঘুইরা বেড়াই। আপনেরা একমুঠা খাইতে দিলে খাই, না দিল না খাইয়া থাকি। খুশির কথা হাই ইস্কুলের অনুমোদন আমরা এ বছরে পাইছি। মাইনষে কয় ভেগাই হালদারের ইশকুল। আমি কই আপনাগের ইশকুল। কারন ঐডা আপনেগো টাকায় তৈরি হইছে। স্কুলডারে বাঁচাইয়া রাইখেন আপনেরা। আর একখান কথা কইয়া শেষ করুম। সক্কলে প্রিতিজ্ঞা করেন, আইজ থিকা জমিদার তালুকদারের বিরুদ্ধে জোটবাইন্দা রুখে দাঁড়াইতে হবে। বলতে হবে – আমরা খাজনা দিমু না। বেগাড় খাটুম না। কৃষকের ফসল কৃষকের গোলায় উঠবে। ফসলের দুইভাগ আমাদের দিতে হবে। নইলে জমিদারি ছাড়তে হবে। এবং অশিক্ষা দূর করত হবে।
আপনেগো শতকোটি পেন্নাম ও সেলাম।
( নেপথ্যে – সমবেত হাততালির সাথে সাথে শ্লোগান, জয় ভেগাই হালদারের জয়। জয় যোগেন মন্ডলের জয়।
সঙ্গীত – বন্দে মাতরম্ সুজলাং সুফলাং মলয়জ – -)
( বিহারীলাল চক্রবর্তীর বাড়ি। ধনপতির প্রবেশ )
ধনপতি : হায় হায় হায়রে, কি সব্বনাশ হলো রে। এবার আমার জমিদারবাবু কি করে মুখ দেখাবেন রে। ক্ষোভে দু:খে আমার কান্না পাচ্ছে রে। ( দুহাতে কপাল চাপড়াবে ) ওরে নতুন খবর শুনলে আমার কর্তামশাই হার্টফেল করে মরবে রে। ( ফিসফিস করে ) জানেন – রক্তচোষাটা মরলেই দেশের মঙ্গল। ও যদি মরে তাহলে আমার একগাদা ধারের টাকা আর ফেরত দিতে হবে না। কি বলেন ? ও কত্তামশাই আর কত দিবানিদ্রায় সুখের স্বপ্ন দেখবেন গো !
বিহারীলাল ( হাই ছাড়তে ছাড়তে প্রবেশ ) কি হলো ভাতারখাকি, রাঢ়ীমাগিদের মতো গলাছেড়ে কাঁদছিস কেন ?
ধনপতি : না কাঁদলে আমার কষ্টটা যে কমছে না গো কত্তামশধাই ।
বিহারীলাল : চুপকর ধনপতি। তোর কি বউ মারা গেছে যে এভাবে কাঁদছিস ?
ধনপতি : বালাইশাট। আমার বৌ মরবে কেন । আমিতো আপনার দু:খে কাঁদছিলাম।
বিহারীলাল : আমারতো কোন দু:খ নাই। গোলাভরা ধান চাল ডাল সরসে আছে , তাছাড়া সাত সাতটা বৌ, ছেলে মেয়ে দাস দাসি, নাতি পুতি সবাই ভালো আছে । শুধু ছোট বৌটা লাল লন্ঠন জ্বালিয়ে রেখেছে ?
ধনপতি : আপনার ছোট বৌ লাললন্ঠন জ্বালিয়েছেন মানে কি কত্তা ?
বিহারী : ওরে হারামজাদা এর মানে তোর বৌর কাছে জেনে নিস।
ধনপতি : ঠিক আছে। কিন্তু আপনার মান- সম্মান সবই তো গেল, সামন্য একজন গোমুখ্যু শুদ্দুরের কাছে –
বিহারী : ভ্যানতারা না করে আসল কথা বল ?
ধনপতি : সেই ভেগাইচাড়ালটা ইস্কুল খুলেছে।
বিহারী : উচ্চ প্রাথমিক পাঠশালা তো অনেক আগেই খুলেছে। তাতে তোর অত দু:খের কি আছে ?
ধনপতি : না না বড়কত্তা ! ভেগাই হাই ইশকুলের অনুমোদন পেয়েছে।
বিহারী : অ্যা: বলিস কি? তুই কি করে জানলি ?
ধনপতি : মানুষের ভীর ঠেইলা আমি তো আপনের বাড়িতে আইতেই পারছিলাম না।
বিহারী : তোরে মেলাদিন কয়েচি। ভদ্রলোকের সাথে শুদ্ধ ভাষায় কতা কবি।
ধনপতি : বারে ! মাঝে মধ্যে আপনিও তো গাইয়া ভাষায় কথা বলেন।
বিহারী : সে তো রেগে গেলে বলি। নে বাকিটুকু বল ?
ধনপতি : ভীড় ঠেইলা আমি তো আপনার কাচে আইতেই পারছিলাম না। মতুয়া নমোরা কাতারে কাতারে ডাংকা কাঁসর পেটাতে পেটাতে আসছে আগৈলঝাড়ায়। কি বলব কত্তা; বাকলা ফুল্লশ্রীর যে কয়ঘর ঢাকি আছে তারা বিনাপয়সায় ওখানে ঢাক বাজিয়ে নাচছে। মেয়েমানুষের উলুধ্বনিতে কানপাতা দায়। হিন্দু মুছলমান সব্বাই জয়ধ্বনি দিয়ে বলছে – জয় সাধু ভেগাই হালদারের জয়। জয় সাধু ভেগাই হালদারের জয়।
বিহারী : চুপ কর শুয়োর। মনে হচ্ছে তুইও ভেগাই হালদারের জয়ধ্বনি দিয়ে আনন্দে নেত্য করছিস ?
ধনপতি : ( দুকান ধরে ) ছি: ছি: কর্তাবাবু, আপনার শত্তুরের নামে আমি কি জয়ধ্বনি দিতে পারি ! পারি না। কারন আমি হলাম আপনার দাসানুদাস শ্রী ধনপতি মন্ডল।( ষষ্টাঙ্গে প্রণাম করে)
বিহারী : নে বাকিটুক বল।
ধনপতি : জানেন কত্তা ! নগরবাড়ির মুছলিম মেয়েরা ভেগাইয়ের নামে আল্লার কাছে দোয়া মাগছে। এমন কি বাকলা গ্রামের ধোনাই ফকিরও ধেই ধেই করে নাচছে ভেগাইকে কাধে নিয়ে।
ফুলের মালায় ভরে গেছে ভেগাইয়ের গলা। তাকে একবার এ কাঁধে নেয় আবার ও কাঁধে নেয়। যেন ভারত স্বাধীন করে ফিরে এসেছে ভেগাই হালদার।
বিহারী : আরে গর্দভ ! এতো ফুর্তি নাচানাচির কারনটা কি ?
ধনপতি : ও বলিনি বুঝি; আজকে বিকালে আগৈলঝাড়ার খেলার মাঠে ভেগাইয়ের আমন্ত্রণে তাবর তাবর নেতারা ভাষন দিল। তার মধ্যে ভেগাইয়ের বক্তিমে শুনে হাজার হাজার কৃষকেরা শ্লোগান দিল – জমিদারের কালোহাত ভেঙ্গে দাও – গুড়িয়ে দাও।
সুদখোড়ের সুদের ব্যবসা চলবে না চলবে না। খাজনা আমরা দিচ্ছি না দেব না দেব না। তাই এই আনন্দ উৎসব। এ কি কত্তামশাই; আপনি যে কাঁপতে কাঁপতে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন ! জানেন – কৈলাশ সেনও ঐ দলে ছিলেন।
বিহারী : ও শালা এখন কৈলাশ সেক নমো হয়ে গেছে নেতা হওনের জন্যি।
ধনপতি : বড়কত্তা আপনারে অনেক আগেই বলেছিলাম, ওদের দুজনকে নিকেশ করে গাঙের জলে ভাসিয়ে দেন। কথাটা শুনলেন না। এবার কাল সকালেই বরিশালের খবরের কাগজে ভেগাই কৈলাশ সেনের ফটো ছাপা হবেনে। আর একখান যুবনেতা হয়েছে মৈস্তারকান্দির যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল।
বিহারী : তুই আর ঘায়ের ওপর নুনের ছিটে দিস না ধনপতি। এমনিতেই রাগে আমার মাথায় আগুন জ্বলছে। ব্যাটাদের বাড়তে দিয়ে ভুল করেছি। ঐ ব্যাটা ভেগাইয়ের জন্য বাকলে আমার হাইস্কুলে ছাত্রের সংখ্যা কমে গেছে। আমার প্রজারা মাথাতুলে কথা বলছে।
ধনপতি : ব্যাটাদের কতবড় সাহস !
বিহারী : তুই দেখে নিস ধনা, কালকেই আমার বাল্যবন্ধূ দীনেশ চন্দ্র সেনকে দিয়ে ভেগাইয়ের স্কুলের অনুমোদন যদি বাতিল করতে না পারি তাহলে আমার নাম জমিদার বিহারী লাল চক্রবর্তী নয়। (প্রস্থান)
ধনপতি : হে ভগবান তুমি আমাকে ক্ষমা করো। সাধু ভেগাই হালদারের মতো সৎ মহান মানুষের বিরুদ্ধে কথা বলেছি বলে ( প্রস্থান )
নেপথ্যে গান – দুর্গম গিড়ি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার। লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে। যাত্রীরা হুশিয়ার।
সূত্রধর : সুধী দর্শক মন্ডলী, কথা দিচ্ছি। আমি আর মঞ্চে এসে নাটকের সূত্র ধরিয়ে রসভঙ্গ করবো না। এবার হবে এই নাটকের শেষ দৃশ্য। প্রকৃতির নিয়মে একদিন প্রত্যেকের জীবনীশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসে। তাদের স্বাস্থ্য যতই সুগঠিত হোক, কর্মোদ্যোগ যতই কল্যাণকর হোক।
মনে করুন আজকে একুশে আষাঢ় এবং ইংরেজি 1933 সালের 4 ঠা জুলাই। মঞ্চ ছাড়বার আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায় বলি – হে মহাত্মা ভেগাই হালদার ” তোমার জাতির চেয়ে তুমি যে মহৎ তাই তব জীবনের রথ পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার ( প্রস্থান )
( ভেগাই হালদারের কুটির )
হরভূষন : ( হরভূষনের কাঁধে হাত রেখে ভেগাইয়ের প্রবেশ ) সাধুকাকা আপনারে এত মানা করলাম অসুস্থ শরীলে ইশকুলে যাইতে হবেনা। আপনি এই বারান্দায় বইসা দেখেন। তা কথাডা শুনলেন না।
ভেগাই : তোমরা শিক্ষকরা তো সেই সকাল দশটা থেকে চারটে পযর্ন্ত ছাত্র ছাত্রীদের সাথে থাকো। আমার বুঝি ইচ্ছে করে না, ওদের বুকে জড়িয়ে বলি- তোমরাই এই দেশের ভবিষ্যতের নাগরিক। তোমরা লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়ে অশিক্ষিত মানুষের পাশে দাঁড়াবে। ভারতমাকে মুক্ত করবে।
হরভূষন : তাই বলে এই নব্বই বছরের দেহটাকে বয়ে নিয়ে আপনাকে গ্রামের মানুষের সাথে সংযোগ রাখতে হবে !
ভেগাই : এতো বছরের অভ্যাস ছেড়ে দিলে আমি কি নিয়ে বেঁচে থাকবো মাষ্টার ! ও ভালো কথা আমার একটা ইচ্ছে তুমি কালকেই পূর্ণ করে দিও।
হরভূষন : কি ইচ্ছে বলেন !
ভেগাই : আমি নিজেই আমার শ্রাদ্ধ করে যেতে চাই। যাতে আমার ছেলেরা নেড়া হযে ব্রাহ্মণ ডেকে খরচাপাতি না করে। পুজারী বামুনরাতো ওৎ পেতে বসে আছে। কবে আমার মৃত্যু হবে আর ওরা অংবং মন্তর পড়ে শেষ ছোবলটা ছেলেদের দেবে।
হরভূষন : কিন্তু মৃত্যুর আগে শ্রাদ্ধ কি ভাবে হবে ? এটা কি সমাজ মেনে নেবে?
ভেগাই : শাস্ত্রীয় সংস্কারে বাঁধা সমাজের রীতিনীতি ভাঙাই আমার লড়াই। শাস্ত্রে লিখেছে শূদ্রদের বিদ্যাশিক্ষা অপরাধ। আমি তা মানিনি।
সমাজপতিরা বলেছে – মা বাবার শ্রাদ্ধ করো। আমি করিনি। ধর্মীয় গুরুরা বলেছে – দিক্ষা শিক্ষার মন্ত্র নাও। আমি নিইনি।
হরভূষন : এসব আমারা জানি কিন্তু মরার আগে শ্রাদ্ধের কথা ইতিপূর্বে শুনিনি। তাও ব্রাহ্মণ বর্জিত?
ভেগাই : আরে বাবা, তুমি কালকেই ইশকুলের যত শিক্ষক ছেলে মেয়েরা আছে সব্বাইকে পেটপুরে চিড়ে খই, বাতাসা, দই মিষ্টি খাইয়ে দেবে। টাকাটা আজকেই ছেলেদের কাছ থেকে নিয়ে নেবে কেমন। ও আর একখান কথা, আমার মৃতদেহটা আমার দুখিনি মায়ের সমাধির পাশেই রাখতে ভুলো না। আমার এই দুটি অনুরোধ তুমি রাখবে তো হরভূষন ?
হরভূষন : রাখবো কাকা রাখবো । একটা কথা আপনাকে না জানিয়ে গৈলা স্কুলের নামে ছাত্রদের ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়াতে হচ্ছে।
ভেগাই : কেন ! আমাদের ইশকুল থেকে নয় কেন ? কি হলো চুপ করে আছো কেন ?
হরভূষন : আপনি কষ্ট পাবেন তাই বলিনি। আমাদের হাইস্কুলের অনুমোদন বাতিল হয়ে গেছে।
ভেগাই : কি করে! কেন বাতিল হলো ?
হরভূষন : বাকলার জমিদার বিহারীলাল চক্রবর্তী কলিকাতার শিক্ষা সিন্ডিকেটের ড: দিনেশ চন্দ্র সেনকে মিথ্যে অভিযোগ জানিয়ে বাতিল করিয়েছে। যেহেতু দিনেশবাবু বিহারীলালের সহপাঠি ছিলেন।
ভেগাই : আমাকে না জানিয়ে ভালোই করেছ। এখন আমার চলৎশক্তি নেই। কৈলাশবাবু, অশ্বিনীবাবু, বাণীকন্ঠবাবূ বেঁচে নেই যারা তদ্বির করে অনুমোদনটা করিয়ে দেবেন।
হরভূষন : আপনি ভেঙ্গে পড়বেন না। আর একজন আছেন মৈস্তারকান্দির যোগেন্দ্রনাথ। যে আপনার শিষ্য। যে ভারতের মধ্যে প্রথম সিডিউলকাষ্ট নির্দল পার্টির হয়ে এম এল এ হবেন বলে প্রস্ততি নিচ্ছেন। যাকে অশ্বিনী দত্ত কংগ্রেসের আর ফজলুল হক প্রজাপার্টির ক্যান্ডিডেট হিসাবে নমিনেশন দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু যোগেন বলেছে – কোনদিন ভোটে দাঁড়ালে তপসিলি নির্দল হয়ে দাঁড়াবো।
ভেগাই : ঠিক বলেছ। তাহলে তাকে এতদিন জানাও নি কেন ?
হরভূষন : অনেক আগেই জানিয়েছি। সে খবর পাঠিয়েছে আজকেই আপনার পদধুলি নিতে আসবে।
ভেগাই : যোগেন আসবে বলেছে ! কখন আসবে ( বুকের বা’দিকটা চেপে ধরে ) আমি যে ওর জন্যেই এখনো বেঁচে আছি। ওরে যোগেন শিগগির আয় বাবা –
যোগেন : আমি এসেছি জ্যাঠামশাই।( পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে ) শহরের নামকরা ডাক্তারকে বলে এসেছি। তিনি আগামীকাল আসবেন আপনার চিকিৎসা করতে।
ভেগাই : কেন এসব করতে গেলি ! আমি তো বেশ ভালোই ছিলাম। কিন্তু ইশকুলের খবরটি শুনে মনে হচ্ছে আমি আর বাঁচবো না। আ:-
যোগেন : নিশ্চয়ই বাঁচবেন। আপনি না বাঁচলে স্কুলটাও যে বাঁচবে না।
ভেগাই : তোরা তো জানিস যোগেন; আগৈলঝাড়া ইশকুলটার মধ্যেই ছিল আমার প্রানভোমরার জীয়নকাঠি। সেই ইশকুলটাই যে আর হাই ইশকুল হলো না ( কাঁদে )
যোগেন : – জ্যাঠা হাইস্কুলের অনুমোদন পত্র আমি প্রধান শিক্ষককের হাতে দিয়ে আপনার কাছে এসেছি।
ভেগাই : বা : বা: যোগেন। কি আনন্দ, কি আনন্দ। আমার সাধের ইশকুল বেঁচেছ ( একা উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে পড়ে যায় )
হরভূষন : আজকে আর উঠবেন না সাধুকাকা।
যোগেন : কালকে আপনাকে পালকিতে বসিয়ে আমরা শোভাযাত্রা করে বিহারীলাল চক্রবর্তীর সামনাসামনি দাঁড়িয়ে বলবো – তোমার মতো নরপিশাচ ব্রাহ্মণরা যতই আমাদের নিরক্ষর রাখার চেষ্টা করো না কেন, ভেগাই হালদারের ছাত্র ছাত্রীদের আর দাবিয়ে রাখতে পারবে না।
ধনপতি : ( প্রবেশ ) তোমাদের আর কষ্ট করে কাল অতদূরে বিহারীলাল চক্রবর্তীর বাড়িতে যেতে হবে না। আজকে আমার মুখে ইশকুলের অনুমোদনের খবরটা শুনে হার্টফেল করে মরবেই। সাধুদা তোমাদের কালকের শোভাযাত্রায় আমার মতো নরাধমকে সাথে নেবে তো? ( কাঁদে )
ভেগাই : ওরে ধনপতি, অনুতাপে অনুশোচনায় তুই তো এখন শুদ্ধ সৎ মানুষ হয়েছিস রে। আয় আমার কাছে এসে বোস। যোগেন তুমি এখন অন্তজ অস্পৃশ্যদের বড় নেতা। তুমি আর ফজলুল হক সাহেব ছাড়া কৃষকদের পক্ষে কথা বলার নেতা আর কেউ নাই।
এই ইশকুলটি হলো পিছিয়েরাখা মানুষেদের আলোর দিশারী। তুমি এর প্রান ফিরিয়ে দিয়েছো। তাই এবার থেকে তোমাকেই এই ইশকুলের দায়িত্বভার তুলে দিলাম বাবা। তুমি দায়িত্ব বহন করবে তো ! কথা দাও যোগেন। আ: বুকে ব্যথা –
যোগেন : জ্যাঠা আপনার পা ছুয়ে প্রতিজ্ঞা করছি – যতদিন বাঁচবো আপনার আদেশের মর্যাদা রাখবো।
হরভূষন : কাকা আপনার কি বুকে খুব ব্যথা করছে ?
ধনপতি : আমি কি কবিরাজ মশাইকে নিয়ে আসবো?
ভেগাই : না কবিরাজ ডাক্তারের আর প্রয়োজন হবে না। আমি এবার পরম শান্তিতে মরতে পারবো। আ: মাগো তুমিও তো আমার চোখের সামনে হঠাৎ বুকের ব্যাথায় মরেছিলে। আজকে ঠিক সেই ভাবেই আমি মরবো। দ্যাখো দ্যাখো হরভূষন, দ্যাখো যোগেন আমার পরম বন্ধু অবলা ষাঁড়টার চোখের জল টপ্ টপ্ করে ঝরে পড়ছে। পাখিগুলো কিচিরমিচির করে চক্কর খাচ্ছে। ইশকুলের চারপাশে আমার নিজের হাতে লাগানো ফলফলাদি, গাছের পাতারা নিথর হয়ে রয়েছে। ওরাও যেন বুঝতে পেরছে আমার ভবলীলা সাঙ্গ হবে এক্ষুনি। আ: আমি আর দম নিতে পারছি না কেন ! আ: আ: (মৃত্যু)
যোগেন : ( হাতের নাড়ি, বুকে হাত রেখে ) জ্যাঠা জ্যাঠা আর কিছু দিন অপেক্ষা করে গেলে দেখতে পেতেন আমি আগৈলঝাড়া স্কুলকে বরিশালের সেরা স্কুল কলেজ হোষ্টেল বানিয়ে দিয়েছি।
হরভূষন : সাধুকাকা এবার যে আমরা পথহারা হয়ে পড়লাম কাকা। ( কাঁদে )
যোগেন : কাঁদবে না। কেউ কাঁদবে না। শোন আজ থেকে এই স্কুলখের নাম রাখা হবে আগৈলঝাড়া ভেগাই হালদার স্কুল। আর একটি কথা মনে রাখবে। আমরা মোটেই পথহারা নই। মহাত্মা ভেগাই হালদার দলিত মুক্তির যে পথ আমাদের দেখিয়ে গেছেন, আমরা সেই পথেই চলবো।
হরভূষন + ধনপতি : তোমাকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি তোমার দেখানো পথেই আমরা চলবো।
( নেপথ্যে : গানের কলি। ” তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা। কে বলে আজ তুমি নেই। তুমি আছো মন বলে তাই ” )
= = = = = = = = =
নাটকটি লিখতে গিয়ে একান্ত সাহায্য নিয়েছি : – সসীম কুমার বাড়ৈর ” ভেগাইয়ের মাধুকারী “ছোট গল্প থেকে ।
নকুল মল্লিকের ” শিক্ষাব্রতী ভেগাই হালদার ” এবং বিনোদবিহারী জয়ধরের ” মহাত্মা ভেগাই হালদার ” আত্মজীবনীর লেখা থেকে।
এই নাটকটি বই আকারে প্রথম প্রকাশ হয়েছে 15 ই নভেম্বর 2018 সালে। নিজের অর্থব্যায় করে করছেন : হরিপ্রসাদ সরকার মহাশয়।
এদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
= = = = = = = =