অনুপ্রেরণাঃ রবীন্দ্রনাথ
গৌতম আলী
দেখতে দেখতে ষাট বছর পেরিয়ে গেলো। পয়ত্রিশ বছরের অবিরাম যাওয়া আসা একদিন বন্ধ হয়ে গেল। এক সন্ধ্যায় এক তোড়া ফুল হাতে দিয়ে অফিসের বন্ধুরা বলল- বুড়ো হয়ে গেছ, এবার বিদায় হও। দেখতে দেখতে ষাট বছর পেরিয়ে গেল। পয়ত্রিশ বছরের অবিরাম যাওয়া আসা একদিন বন্ধ হয়ে গেল। এক সন্ধ্যায় এক তোড়া ফুল হাতে দিয়ে অফিসের বন্ধুরা বলল- বুড়ো হয়ে গেছ, এবার বিদায় হও।
পরের দিন থেকে আর অফিসে গেলাম না। পরের মাসে কোন মাইনে পেলাম না। বিরাট ধাক্কা। মানসিক ধাক্কা। আয় নেই। পেনশন নেই। একরাশ অনিশ্চয়তা আছে।
কিছু একটা করা দরকার। সময় কাটানোর জন্য। আয় করার জন্য। কিন্তু কি করবো ? ষাট বছরে কিছু শুরু করা দুষ্কর। চিন্তা বাড়ছে। ভাল ঘুমাতে পারছিনা। জীবনের তাল কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
টিভিতে একটা অনুষ্ঠান দেখলাম। চিনের সফল ব্যবসায়ী মা(Maa) জীবন নিয়ে আলোচনা করছেন। জীবনকে কয়েকটি ভাগ করেছেন। সর্বশেষ ধাপ ষাট বছর থেকে। বললেন, বয়স যখন ষাট , এবার বিশ্রাম নিন। মনকে, শরীরকে বিশ্রাম দিন। অনেক করেছেন, এবার জীবনকে উপভোগ করুন। হতাশা বাড়ল। তিনিও বললেন, ষাট মানেই বুড়ো !
কয়েকজন বন্ধু বিজনেস ম্যাগনেট মা-এর মত বললেন- অনেক করেছি, এবার বিশ্রাম নিতে হবে। কয়েকজন বন্ধু কাশী-বৃন্দাবন-মক্কায় গেল। পরকালের ভাবনায় জীবন কাটাতে লাগলো।
বাকি কিছু বন্ধু ভাবতে লাগলো নতুন কিছু করা যায় কিনা। ভাবতে ভাবতে একটা বছর কেটে গেল।
হঠাৎ মনে পড়ল রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের কথা। তিনি বলেছিলেন, ” রবীন্দ্রনাথ আমাদের সুখে আছেন, দুখে আছেন, কোলাহলে আছেন, নির্জনতায় আছেন। ” ভাবলাম, তবে কি তিনি আমার নিস্তেজ জীবনেও আছেন ?
আমি রবীন্দ্র জীবনীতে ডুব দিলাম। কয়েকদিন সময় লাগলো পড়তে। পড়া শেষে এক অন্য অনুভূতি জন্ম নিল মনের মধ্যে। বিশ্বাস করুন, আমার সেই নিস্তেজ ভাবটা কেটে গেল।
যে বয়সে আমি এবং আমরা নিস্তেজ হয়ে পড়ছি, দিশাহীন হয়ে পড়ছি- সেই বয়সে রবীন্দ্রনাথ কী করতেন ? এক উজ্জিবক রবীন্দ্রনাথ- তাঁর সৃজনশীলতা , উদ্যম, কঠোর পরিশ্রম, তাঁর একাগ্রতা আমাদের মুগ্ধ করে এবং সতেজ করে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পারেন কিন্তু আমরা পারিনা। কেন পারিনা ? একটা তথ্য মনে রাখা দরকার। সেই সময় অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়ে ভারতীয় মানুষের গড় বয়স ছিল ত্রিশ বছর। আর আজ মানুষের গড় বয়স আটষট্টি বছর। অর্থাৎ সময়ের তুলনায় আমরাতো তরুণ !
চলুন, আমাদের প্রাণের আরাম , মনের শান্তি রবীন্দ্রনাথের কাছে ফিরে যাই।
চল্লিশ বছর বয়সে মাত্র পাঁচ জন ছাত্র নিয়ে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠা করলেন ব্রম্মচর্য বিদ্যালয়। সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যে একটি স্বপ্নও প্রতিষ্ঠা করলেন। এই ছোট্ট বিদ্যালয় একদিন বিশ্ববিদ্যালয় হবে, বিশ্বজ্ঞানের আকর হবে। সারা পৃথিবীর মানুষ আসবে জ্ঞানের পিপাসা মেটাতে।
রবীন্দ্রনাথের মনে জোর ছিল, বৈদিক যুগে যদি ‘ তপোবন ‘ হতে পারে, বৌদ্ধ যুগে যদি ‘নালন্দা ‘ হতে পারে তবে শান্তিনিকেতনে বিশ্ববিদ্যালয় হবে না কেন ?
সতের বছর পর , রবীন্দ্রনাথ-এর বয়স যখন সাতান্ন বছর, তিনি ভিত গড়লেন তাঁর স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ের, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের।
ইতিমধ্যে আঘাতে আঘাতে দীর্ণ হয়েছেন তিনি। বাবার মৃত্যু হয়েছে, স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে, দুই কন্যার মৃত্যু হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে ছোট ছেলের। কয়েক বছরের মধ্যে নিঃস্ব হয়েছেন তিনি। কিন্তু মৃত্যুর মধ্যেও রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের মৃত্যু ঘটেনি।
নিজের মনের শক্তি নিজেই সঞ্চয় করেছেন, তারুণ্যের কাছে হাত পেতেছেন—
“ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা
ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ
আধ মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা”।
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হলো। কিন্তু তারপর ?
হাতি পোষা ও তার যত্ন-আত্তি এবং খাবার জোগানোর দায় তো মালিকের। মালিক রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি দান করেছেন, বইয়ের স্বত্ব, নোবেল পুরস্কারের সুদের টাকা, সবই দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য। তারপর ভিক্ষার ঝুলি কাধে তুলে নিলেন। ষাট থেকে পচাত্তর বছর বয়স পর্যন্ত অক্লান্ত ভাবে ঘুরেছেন দেশের এবং পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে। গান গেয়ে, নাটক করে, বক্তৃতা দিয়ে টাকা সংগ্রহ করেছেন, বই সংগ্রহ করেছেন, ছাত্রদল নিয়ে ঘুরেছেন।
আমি যদি রবীন্দ্রনাথের ষাট থেকে পচাত্তর অর্থাৎ এই পনের বছরের টাকা সংগ্রহের জন্য ভ্রমণের কথা বলতে থাকি, বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে যাব, আপনারা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে যাবেন। কিন্তু তিনি রবীন্দ্রনাথ, তিনি ক্লান্ত হননি। এত পরিশ্রম তাঁর শরীর নিতে চায়নি, তবুও জোর করে বেরিয়েছেন। অসুস্থ হয়েছেন, সুস্থ হয়ে আবার পথে নেমেছেন।
চলুন, একটু সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেখি :
১৯২০ :
আমেদাবাদ, বোম্বাই, বরোদা, সুরাট, বোম্বাই, কলকাতা।
ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, প্যারিস, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, প্যারিস।
আমেরিকা-১৫ দিন নানা শহরে। তারপর ইংল্যান্ড, প্যারিস, ফ্রান্স, সুইডেন, জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, চেকোভ্লাকিয়া, কলকাতা।
১৯২২ :
বোম্বাই, পুনা, মহিশুর, বাঙ্গালোর, মাদ্রাজ, সিংহল।
১৯২৩ :
লক্ষ্মৌ, বোম্বাই, আমেদাবাদ, করাচি, পোরবন্দর, কলকাতা। আবার পোরবন্দর।
১৯২৪ :
চিন যাত্রা। সাংহাই, নানকিং, পেকিং, জাপান।
দক্ষিণ আমেরিকা, অসুস্থতার কারণে পেরু যাওয়া হয়নি। আর্জেন্টিনা, ইতালি, ভেনিস, কলকাতা।
১৯২৫ :
ইতালি। রোম, ফ্লোরেন্স, ট্যুরিন, সুইডেন, জুরিখ, ভিয়েনা, হাঙ্গেরি ।
জীবনীকার লিখেছেন, ‘ ভিয়েনা হয়ে কবি যখন হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে পৌঁছালেন তখন কবির শরীর সহ্যশক্তির শেষ সীমানায়। এই বয়সে এতো ঘোরাঘুরি সহ্য হবে কেন । তবু বক্তৃতা দিলেন। কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে আবার চললেন — যুগোস্লাভিয়া, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, ইস্তাম্বুল, গ্রিস, মিশর, সুয়েজ হয়ে দেশে।
১৯২৬ :
লক্ষ্মৌ। ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, আগরতলা, কলকাতা।
১৯২৭ :
ভরতপুর, জয়পুর, আমেদাবাদ, আগ্রা, শান্তিনিকেতন, ।
সিঙ্গাপুর, মালয়দ্বীপ, বালিদ্বীপ, জাকার্তা, ব্যাংকক, দেশ।
১৯২৮ :
মাদ্রাজ, কলম্ব, ব্যাঙ্গালোর, শান্তিনিকেতন।
১৯২৯ :
জাপান, কানাডা, জাপান, ইন্দোচীন।
১৯৩০ :
আমেদাবাদ, বরোদা, শান্তিনিকেতন।
১৯৩১ :
ভুপাল।
১৯৩২ :
পারস্য (এলাহাবাদ- যোধপুর- করাচি- বুশায়ার- তেহরান হয়ে ) ইরাক, বাগদাদ, কলকাতা।
১৯৩৩ :
শান্তিনিকেতনের ছাত্রদল নিয়ে কলকাতা, বোম্বাই, দক্ষিণ ভারত।
১৯৩৪ :
দল নিয়ে সিংহল।
দল নিয়ে মাদ্রাজ, ওয়াটারলু।
দল নিয়ে কাশি, এলাহাবাদ, লাহোর, লক্ষ্মৌ ।
১৯৩৬ :
নৃত্যনাট্য নিয়ে উত্তর ভারত। পাটনা, এলাহাবাদ, লাহোর, দিল্লী।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য টাকা সংগ্রহের এই পথ পরিক্রমা থামে তাঁর পচাত্তর বছর বয়সে। মহাত্মা গান্ধী অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংবাদ পেয়ে বিচলিত হন। তিনি রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেন এত পরিশ্রম না করতে। এইসময় শিল্পপতি বিড়লা বিশ্বভারতীর উন্নয়নের জন্য ষাট হাজার টাকা অনুদান দেন।
এতো কিছুর পরেও রবীন্দ্রনাথ লেখা থামাননি। বরং আরও বেশি সৃষ্টিশীল ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ-এর লেখাকে যদি তিন ভাগে ভাগ করে দেখা হয়, অপরিনত, পরিনত ও শেষ বয়সের লেখা, তবে সব চাইতে বেশি সৃজনশীল ছিলেন শেষ বয়সে।
আমরা ষাট বছর বয়স হতেই বুড়ো হয়ে যাই, যখন ভারতীয় গড় আয়ু ৬৮ বছর। অথচ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় ভারতীয়দের গড় আয়ু ছিল ৩০ বছর। তিনি গড় আয়ুকে পিছনে ফেলে নিত্য নতুন উদ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেছেন। লক্ষ্যে পৌঁছনোর তাগিদে শারীরিক অক্ষমতাকে পাত্তা না দিয়ে সারা পৃথিবী ঘুরেছেন। আর ঝর্নাধারার মত সৃষ্টি করে চলেছেন।
কি শিখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ আমাদের ?
১) বয়স কোন বাধা নয়।
মূল বিষয় “লক্ষ্য স্থির করা।” রবীন্দ্রনাথ পাখির চোখে দেখেছিলেন বিশ্বভারতী। আমাদেরও তেমনি লক্ষ্য স্থির করতে হবে।
২) লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
বাধা আসবেই। বাসনা যদি তীব্র হয়, সমাধানের রাস্তা মিলবেই।
৩) ধৈর্য বা সহনশীলতা।
সফল না হওয়া পর্যন্ত ধৈর্যশীল হতে হবে।
শেষ কথা।
বয়স হয়েছে ? তাতে কী ? আসুন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিই। তাঁর উদ্দিপনা, উদ্যম, কঠোর অনুশীলন, সহনশীলতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি। যতক্ষণ না সফল হই রবীন্দ্রনাথকে নিজের মধ্যে ধারণ করি। ষাট পেরিয়ে তিনি যদি নবীনতায় সজীব হতে পারেন আমরা কেন পারবোনা ?ল্তগৌম আলী একজন প্রতিষ্ঠিত দলিত কবি, সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ।
গৌতম আলী একজন প্রতিষ্ঠিত দলিত কবি, সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ।