কুমার রাণাঃ প্রকৃতিস্থ মানুষের পথ

প্রকৃতিস্থ মানুষের পথ

কুমার রাণা

সারা পৃথিবী জুড়েই প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নিয়ে মানুষে মানুষে একটা আদর্শগত বৈর মানব সমাজের গতি প্রকৃতির নির্ধারক হয়ে উঠেছে। আমরা এমন এক মোড়ে এসে পৌঁছেছি,  যেখানে প্রকৃতি ও প্রকৃতিস্থ মানুষদের সংগ্রামটি কেবল তাঁদের একক সংগ্রাম নয়, আদিবাসী মানুষের বাস্তব জীবনের সংগ্রাম নয়, এটা হল গোটা পৃথিবীর অস্তিত্বের সংগ্রাম

“শত শত প্রাণীগণ ভয়ঙ্কর চীৎকার করিতে করিতে ইতস্তত বিধাবিত হইতে লাগিল। … ক্ষুদ্রজাতীয় প্রাণী দানব ও নিশাচরগণ চক্রাঘাতে জর্জরিত কলেবর হইয়া প্রাণ পরিত্যাগপূর্বক প্রদীপ্ত অগ্নিমধ্যে পতিত হইল…”  

অথচ আশ্চর্য, এমন এক নিষ্ঠুর বিধ্বংসের নিন্দায় কারো মুখ থেকে একটি শব্দ উচ্চারিত হল না।যে সৃষ্টি ছিল নানা উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির, এবং,“ক্ষুদ্রজাতীয় প্রাণী দানব ও নিশাচর” অর্থাৎ আর্যেতর মানুষদের আবাস, সেই সৃষ্টিকে দগ্ধ করার জন্য যেখানে মহাকাব্যের দুই নায়কের প্রাপ্য ছিল তিরস্কার ও শাস্তি, সেখানে তাঁরা পেলেন প্রশংসা ও বর। (কালীপ্রসন্ন সিংহ (অনূদিত), মহাভারত, আদিপর্ব: ২২৩-২৩৩; কলকাতা: পি এম বাকচি, ১৩৯৮(১৯৯১))

আবার, সম্পত্তির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত ষড়যন্ত্রের কারণে পাণ্ডবদেরযখন বারণাবত জতুগৃহেপাঠানো হয়, তখন “ক্ষুধাতুরা এক নিষাদী কালপ্রেরিত হইয়া অন্নলাভ প্রত্যাশায় পঞ্চপুত্রসমভিব্যাহারে তথায় উপস্থিত হইয়াছিল।” তাদের খাইয়ে দাইয়ে, প্রচুর মদ্যপানে অচেতন করে ফেলে রেখে, পাণ্ডবরা জতুগৃহে আগুন লাগিয়ে পালিয়ে গেল, আর ছয় নিষাদের জীবন্ত দহন ঘটল। (কালীপ্রসন্ন সিংহ, পূর্বোক্ত, আদিপর্ব: ১৪৮) আশ্চর্য, সত্য ও নীতির পরাকাষ্ঠা বিদুর বা যুধিষ্ঠির কদাচ এর জন্য লজ্জিত হননি। কারণ, এই মানুষদের মনে করা হত মনুষ্যেতর, দস্যু, অসুর, রাক্ষস, ইত্যাদি। আর, ভারত ইতিহাসের দীর্ঘ পর্ব জুড়ে এই “অপর”দের বাসভূমি ও জীবনযাত্রার সংস্থান কেড়ে নিয়ে, তাদের “ক্ষুধাতুর” করে তোলা হয়েছে, যাদের ছিল বিপুল ঐশ্বর্য, প্রকৃতি থেকে পাওয়া জীবনধারণের সকল উপকরণ, তাদেরকেই পরিণত করা হয়েছে, নিঃসহায়, বুভুক্ষুতে।আবার, যখনই বৈষয়িক প্রয়োজন পড়েছে তখনই এই ম্লেচ্ছদের সাহায্য প্রার্থনা করা হয়েছে। যেমন, বিদুর পাণ্ডবদের রক্ষা করবার জন্য যে খনককে জতুগৃহ থেকে নিষ্ক্রমণের সুড়ঙ্গ খনন করতে পাঠান, তিনিও তো ছিলেন ম্লেচ্ছ—হয়তো বা এখন ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী কোড়া বা কোড়ামুণ্ডাদের পূর্বজ। কিম্বা ধরা যাক, ঘটোৎকচের কথা। যখন কর্ণের মৃত্যুবাণ থেকে অর্জুনকে রক্ষা করার প্রয়োজন হল, তখন স্মরণ করা হল সেই পিতৃকুলস্নেহবঞ্চিত ঘটোৎকচকে। প্রয়োজনে,অযোধ্যার রাজপুত্র রাম চণ্ডাল গুহককে জড়িয়ে ধরেন, আবার রাজ- সিংহাসনে বসে চণ্ডাল শম্বুককে বেদপাঠের অপরাধে হত্যা করেন। ক্ষমতা ক্ষেত্রে প্রবঞ্চনার মতো অস্ত্র নেই। অর্জুনকে অজেয় ধনুর্ধর করে তুলতে একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ চেয়ে নিতে গুরু দ্রোণ অন্তত একবারও লজ্জায় অধোবদন হননি। এই ধারাবাহিকতাতেই, যে সৃষ্টি মানুষের অধিগত নয়, কেবল প্রকৃতিই যার সৃজনকর্ত্রী, সেই সৃষ্টিকে দহন করে ফেলতে কৃষ্ণার্জুনের নৈতিকতায় বাধেনি— বনবাসকালে সময় কাটানোর জন্য পাণ্ডবরা দিনের পর দিন নৈতিকতার প্রবচন শুনে এসেছেন, কিন্তু ক্ষমতার বাস্তব ক্ষেত্রটিতে নৈতিকতার অনুশীলন বিলাসিতামাত্র।

ক্ষমতার প্রয়োজনে খাণ্ডবদহন ন্যায্য হয়ে ওঠে, আবার বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণও প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। যেমন, কোটিল্য-র অর্থশাস্ত্র।ইতিহাসবেত্তা উপিন্দর সিংহ দেখাচ্ছেন:

অর্থশাস্ত্র বনকে দেখেছিল একটি আর্থনীতিক ও সামরিক সংসাধন যেখান থেকে যথেচ্ছ আহরণ করা হত ও তাকেসুরক্ষিত রাখা হত। বন এমন এক স্থান যেখানে বিপজ্জনক হিংস্র মানুষদের বাস, এদের বাগ মানিয়ে রাজার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হত। আর তার সঙ্গে বন ছিল রাজার শিকারের মধ্য দিয়ে পরাক্রম দেখানোর জায়গা। (উপিন্দর সিংহ, পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স ইন এনশেন্ট ইণ্ডিয়া, কেমব্রিজ ম্যাসাচুসেটস: হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১৭, ৫ম অধ্যায়)

কৌটিল্য অরণ্যবাসীদের “বিপজ্জনক ও হিংস্র” বলে অভিহিত করছেন, কিন্তু তিনি সাধারণ দস্যু বা তস্করদের সঙ্গে অরণ্যবাসীদের এমন একটাপার্থক্য করছেন যেটি খুবই অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন:

দস্যুরা কেবল অসাবধানী লোকেদেরই দ্রব্য লুণ্ঠন করে, এবং তারা সংখ্যায় কম ও তাদের সহজে চিহ্নিত করা যায় ও ধরা যায়। কিন্তু, অরণ্যবাসী (আটবিক) লোকেরা তাদের নিজস্ব অঞ্চলে বসবাস করে, তারা সংখ্যায় প্রচুর, এবং সাহসী; তারা প্রকাশ্যে যুদ্ধ করে, বিভিন্ন জনপদ অধিকার ও ধ্বংস করে। রাজার যে-সব বৈশিষ্ট্য থাকে তারাও সে-সব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। (উপিন্দর সিংহ, পূর্বোক্ত-তে উদ্ধৃত)

ক্ষমতার এই বহুমুখী প্রয়োজন থেকেই দেবনামপীয় অশোকের নীতির মধ্যেও আমরা দেখতে পাই একদিকে অহিংসার বাণী, পশুহত্যানিরোধের অনুজ্ঞা, অকারণে অরণ্যের ক্ষতিসাধন না করা, ইত্যাদি, আর অন্যদিকে দেখতে পাই যে আটবিক মানুষেরা বন ও বন্যপ্রাণীর সঙ্গে এক অঙ্গাঙ্গী জীবনযাপন করে আসছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে একপ্রকার হুমকি।

এটা কেবল ভারতবর্ষের একান্ত কোনো বৈশিষ্ট্য নয়। সারা পৃথিবী জুড়েই প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নিয়ে মানুষে মানুষে একটা আদর্শগত বৈর মানবসমাজের গতিপ্রকৃতির নির্ধারক হয়ে উঠেছে। এর একদিকে আছে, প্রকৃতির মধ্যে, প্রকৃতির অংশ হিসেবে এগিয়ে চলার আদর্শের মানুষেরা, যাঁরা আক্ষরিক— এবং চরিতগত— উভয় অর্থেই প্রকৃতিস্থ। আর অন্যদিকে আছে প্রকৃতিকে জয় করার মনোবৃত্তি নিয়ে নিরন্তর তার ক্ষতিসাধন করে চলা স্বার্থপরতার পরাকাষ্ঠা মানব প্রজাতিরই আর একটি দল।

পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা প্রথম আদর্শগোষ্ঠীর মানুষদের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য, তারা মানুষের শ্রেষ্ঠতায় বিশ্বাস করে না, বরং তারা নির্ভর করে প্রকৃতির শ্রেষ্ঠতার ওপর। পাহাড়, অরণ্য, সমুদ্র, বায়ু, প্রাণীকুল—এককথায় সমগ্র প্রাকৃতিক জগতের একটা মাত্র অংশ হচ্ছে মানুষ। এই মানুষসম্প্রসারণে বিশ্বাস করে না, যতটুকু প্রয়োজন তার বেশি এক কণাও সে চায় না। এই মানুষরাই আজ সর্বত্র আদিবাসী বলে পরিচিত। আমাদের দেশের এক আদিবাসী সমাজ থেকে উঠে আসা বিশিষ্ট জ্ঞানবেত্তা নির্মল মিনজের চোখে এই আদিবাসীদের কাছে প্রকৃতি“আত্মীয়েরমতো।” তারা “এমনকিযে কোনোমানুষ, গাছ, জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ, আরজল, বাতাসএবংরোদেরআলোকেওসম্মানকরতে” শিখেছে।(সমরবসুমল্লিক, “আদিবাসীদেরসুখেরদর্শন : মুণ্ডাপরিপ্রেক্ষিত’’, অনুষ্টুপ, ৫৬(৪), প্রাক-শারদীয়, ২০২২-তেউদ্ধৃত)

একই রকম কথা আমরা শুনি, আমেরিকারমূলনিবাসীস্কুইমিশগোষ্ঠীরপ্রধানেরকাছথেকে: “এইপৃথিবীরপ্রতিটাঅংশআমারগোষ্ঠীরমানুষেরকাছেপবিত্র।”(সমরবসুমল্লিক, পূর্বোক্ত-তেউদ্ধৃত)

এ মানুষ সেই প্রকৃতিস্থ মানুষদের উত্তরাধিকারী, যারা প্রকৃতি থেকেই শিখেছিল কীভাবে আগুন জ্বালাতে হয়। তারা দেখেছিল, গাছে গাছে ঘষা লেগে, বা পাথরে পাথরে ঠোকা লেগে, কীভাবে আগুন জ্বলে। অন্যভাবে বলতে গেলে প্রকৃতি তাকে দেখিয়ে দিয়েছিল, কীভাবে আগুন জ্বালাতে হয়। আজকের মানব-প্রজাতির প্রতিটি সদস্যই নিজের অস্তিত্বের জন্য এই প্রকৃতিস্থ মানবদর্শনের কাছে ঋণী।

ক্লিফর্ড কনার দেখাচ্ছেন, “খাদ্য উৎপাদনের জন্য আমরা আধুনিক উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের চেয়ে প্রাক-কলম্বীয় মানুষদের কাছে অনেক বেশি ঋণী। এমনকি তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিককালেও আমেরিকার বাগিচামালিকরা যখন ধানচাষ করতে উদ্যোগী হল তখন তারা ধান বিষয়ক জ্ঞানসম্পন্ন আফ্রিকান দাসদের কিনতে বাধ্য হল।” তাঁর গবেষণা আমাদের সামনে তুলে আনছে কীভাবে সাক্ষরতা-পূর্ব মানুষ গ্রহ-নক্ষত্র থেকে নিয়ে পশুপাখির চলন দেখতে দেখতে অর্জন করেছিলজলবায়ু সংক্রান্ত জ্ঞান, আবহাওয়ার পূর্বাভাসের ক্ষমতা, সমুদ্রযাত্রার মতো অতি উচ্চমানের জ্ঞান-ভিত্তিক দক্ষতা। (ক্লিফর্ড ডি কনার, আ পিপলস হিস্টরি অব সায়েন্স: মাইনারস, মিডওয়াইভস অ্যান্ড লো মেকানিকস”, ন্যু ইয়র্ক: নেশন বুকস, ২০০৫)

এর বিপরীতে আর একদল মানুষ নিজেকে সর্বশক্তিধর মনে করতে লাগল। ক্ষমতার আত্মভরিতায় তারা বিস্মৃত হল, মানুষ হিসেবে নিজের শ্রেষ্ঠতা নিয়ে তার যে গর্ব, সেই তথাকথিত শ্রেষ্ঠতা তার নিজের অর্জন নয়, এ-সবই প্রকৃতির দান, এবং প্রকৃতির কল্যাণে নিয়োজিত মানুষে মানুষে – শত্রুতা নয় – সহযোগিতার মনোভাব।

অহংকার বহুপ্রসবিনী। যে অহংকারে সে উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতকে নিকৃষ্ট মনে করে তাদের ওপর দখলদারি কায়েম করে, সেই অহংকার তার নিজের সমাজকেও ভাঙে: অন্য মানুষদের, এমনকি তার সহবাসী মানুষদেরও শত্রু করে তোলে। এই ক্রমেই ঘটে যায় মানব সমাজে এক ঐতিহাসিক বিভাজন: প্রকৃতির সৃষ্ট জৈব প্রয়োজনে গড়ে ওঠা নারী-পুরুষ বিভাগ হয়ে ওঠে ক্ষমতার বিভাজনের এক বিষাক্ত প্রতিমূর্তি।

অথচ, প্রকৃতিস্থ মানুষদের মধ্যে এই ভাব ছিল না। কলম্বাসের আমেরিকা দখলের পর যা ঘটে, তার বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় বার্তোলোমে দে লাস কাসাসের লেখায়। তিনি  লিখছেন, পরে আমেরিকান ইন্ডিয়ান বলে চিহ্নিত এই মানুষদের আদর্শগত উচ্চতার কথা, যার মধ্যে একটা ছিল নারী-পুরুষ সম্পর্ক বিষয়ে। (হাওয়ার্ড জিন, আপিপলস হিস্ট্রি অব দি ইউনাইটেড স্টেটস, ন্যু ইয়র্ক: হার্পার কলিন্স, ২০০৩ বইতে উদ্ধৃত)বস্তুত, এখনো, সভ্য ক্ষমতার সর্বগ্রাসী প্রভাবের পরেও নানা আদিবাসী সমাজে নারীদের কেবল মানুষ হিসেবে দেখার আদর্শটিকে টিকে থাকতে দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে ভারতের দিকেই তাকাতে পারে। যখনতথাকথিত সভ্য সমাজগুলোতে উন্নত ও আকাঁড়া প্রযুক্তি এবং প্রায়শই দেহবল প্রয়োগ করে মেয়েদের জন্মানোর আগে ও পরে মেরে ফেলা হয়, তখন “পশ্চাৎপদ” আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোতে বিজ্ঞানের এমন দুষ্প্রয়োগের অভিজ্ঞান দেখা যায় না।

মহাভারতে আমরা যেমন দেখেছি, একদিকে ক্ষমতাগোষ্ঠী প্রকৃতিস্থ মানুষদের উৎখাত ও নিধন করছে, অন্যদিকে তাদের প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের জন্যও তাদের কাজে লাগাচ্ছে। এই দুইধারী আয়ুধটা সব থেকে তীক্ষ্ণভাবে নেমে আসল, ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদের কালে। ঔপনিবেশিক পুঁজির সঞ্চরণ শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত মানুষে মানুষে এবং মানুষে প্রকৃতিতে বিভাজন ও বৈরসম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তার মাত্রা ছিল নিতান্ত সীমিত। এর বিশ্বধ্বংসী রূপটির সূচনা হল, মাত্র চারশ বছর আগে, ইউরোপ থেকে ঔপনিবেশিক পুঁজির বিশ্বগ্রাসী অভিযানের মধ্য দিয়ে। সাম্প্রতিক এক গবেষণাগ্রন্থে, সাহিত্যিক অমিতাভ ঘোষ পুঁজির সম্প্রসারণ, আগ্রাসন ও আক্রমণ নিয়ে যে বর্ণনা তুলে ধরেছেন তা পড়তে গিয়ে বুক কেঁপে ওঠে।

তাঁর বর্ণনার শুরু ভারত মহাসাগরে, জাভার পূর্বদিকে ছোট একটি ভূখণ্ড বান্দা দ্বীপ থেকে। এখানে পাওয়া যেত জায়ফল। অধিবাসীদের জন্য এ দ্বীপ “শুধু ভূখণ্ডমাত্র ছিল না, ছিল তাদের দেশ।” তারা, এবং জায়ফলের গাছ, এবং নানান পশুপাখি, গাছপালা, তৃণ ও গুল্ম, এবং তাদের বিশ্বাস – এইসব   ছিল এখানকার প্রকৃতির অংশ। বান্দা দ্বীপের লোকেরা মনে করত, প্রকৃতি হচ্ছে তার অন্তর্ভুক্ত সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদ, আকাশ ও ধরিত্রী, জল ও বাতাস— সকলের। এখানেই তথাকথিত আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধল তাদের মনোজগতের: ইউরোপীয় “অভিযাত্রীরা” মনে করতে শুরু করল, প্রকৃতির ওপর মানুষেরই একচ্ছত্র অধিকার। শুধু তাই নয়, তারা এটাও মনে করতে লাগল যে, কিছু মানুষের এ পৃথিবীতে থাকবার কোনো দরকারই নেই, এখানে তারাই থাকবে যারা “সভ্য”, এবং সেই সভ্যতার জোরে অপর মানুষদের পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত করে দেবে। এই তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন “আধুনিক” বিশ্বের অন্যতম জ্ঞানবেত্তা ফ্রান্সিস বেকন।

এই মনোভাব থেকেই ১৬২১ সালে ওলন্দাজ ঔপনিবেশিকরা জায়ফলের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করতে বান্দা দ্বীপের অধিবাসীদের ওপর নামিয়ে আনে এক বীভৎসআক্রমণ। উপনিবেশবাদ এইধরিত্রীকেই তার আক্রমণের লক্ষ্য বানিয়ে ফেলল। এর মূল্য চোকাতে হচ্ছে সমগ্র বিশ্ববাসীকে—মানুষ, প্রাণীকুল, উদ্ভিদজগৎ ওপ্রকৃতিকে, যারাসকলেইআজধ্বংসেরমুখোমুখি। (অমিতাভ ঘোষ, দ্য নাটমেগস কার্স: প্যারাবলস ফর আ প্ল্যানেট ইন ক্রাইসিস, পেঙ্গুইন বুকস, ২০২১)

হাওয়ার্ড জিনের লেখা ইতিহাস  চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কীভাবে ঔপনিবেশিক আক্রমণে আমেরিকার আদিবাসিন্দাদের— “কোথাও ৭০ শতাংশ, আবার কোথাও ৯০ শতাংশ”—পর্যন্ত পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যে সামান্য অংশ টিকে আছে তাদের ভাষা, সঙ্গীত, সংস্কৃতি থেকে আমরা জানতে পারি, কী বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী ছিল এই সভ্যতাগুলো, যার ভিত্তি ছিল প্রকৃতির অংশ হয়ে বেঁচে থাকা, এবং প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের সমৃদ্ধিশালী করে তোলা। তাঁদের সহস্র বছর ধরে গড়ে তোলা ইতিহাসকে নিশ্চিহ্ন করেই ক্ষান্ত দেয়নি বিজেতা আক্রমণকারীরা, যে অংশটুকু টিকে আছে, তাদের মানবিক মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গে কেড়ে নেওয়া হয়েছে বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও। (হাওয়ার্ড জিন, পূর্বোক্ত)

ভারত কোন পথে? অতি সংক্ষিপ্ত  কিন্তু সঠিক উত্তরটি হচ্ছে ভারতজোড়া খাণ্ডব দহন। পৃথিবী জুড়ে ঔপনিবেশিক পুঁজি প্রকৃতির বিরুদ্ধে যে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে  নেমে পড়ল, ভারতও তার বাইরে রইল না।সেই মৌর্যযুগ, মহাকাব্যের যুগ, সুলতানি শাসন বা মুঘল সাম্রাজ্য ব্যবস্থাতেও, ইতিহাসবেত্তারা দেখাচ্ছেন, অরণ্য ও অরণ্যবাসীর ব্যাপারে শাসকদেরদৃষ্টিভঙ্গী ও কার্যকলাপের ভিত্তিতে পরিমিতির একটা ভূমিকা ছিল। একথা ঠিক যে, প্রাচীন ভারত থেকে মুঘল শাসন পর্যন্ত সময়কাল জুড়ে এ-দেশের আদি বাসিন্দাদের সঙ্গে শাসনতন্ত্রের সংঘাত জারি থেকেছে, এবং সেই সংঘাতে শাসকপক্ষ সভ্যাসভ্য ধারণাটিকে নিজেদের মতো করে গড়ে নিয়ে আদিবাসীদের রাক্ষস, বর্বর, অসভ্য, অপরাধপ্রবণ, ইত্যাদি পরিচয়ে অভিহিত করে গেছে। কিন্তু, সেই সঙ্গে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে – এবং প্রকৃতির বিরুদ্ধে– যুদ্ধটাকে রাজ্যশাসনের একটি প্রধান কর্মসূচি করে তোলেনি।  এ-বিষয়ে গভীর আলোচনা পাওয়া যায় রোমিলা থাপর (এনশেন্ট ইন্ডিয়ান সোশ্যাল হিস্ট্রি: সাম ইন্টারপ্রিটেশন, নিউ দিল্লি: ওরিয়েন্ট লংম্যান) এবং অন্যান্যদের লেখায়। ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা ব্রিটিশ শাসন এই পরিমিতির ভিত্তিটাকে সম্পূর্ণ ভেঙে দিল। সুমিত সরকার দেখাচ্ছেন, বিপুল জনসমষ্টির ওপর রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ দখলদারি কায়েম করার হাতিয়ার হিসেবে ব্রিটিশ শাসনে প্রবর্তিত হল দুটি আইন, ১৮৬৫ ও ১৮৭৮-এর অরণ্য আইন। ১৮৬৫’তে যদিও বা অরণ্য ব্যবহারকারীদের বিদ্যমান অধিকারগুলোর স্বীকৃতি ছিল, যতই অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্টভাবে হোক না কেন, ১৮৭৮-এর আইনে “যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রথাগুলি রাষ্ট্রীয় আদেশনামার এক আঁচড়ে পরিণত হল বিশেষভাবে অনুমতিপ্রদত্ত  অধিকারে… এইভাবে অরণ্য বিভাগ ব্রিটিশ ভারতের মোট ভূমি এলাকার পাঁচ ভাগের এক ভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে সক্ষম হয়। যার অর্থ, এই উপমহাদেশে উক্ত বিভাগটি হয়ে দাঁড়ায় জমির সবচেয়ে বড়ো ব্যবস্থাপক সংস্থা।” (সুমিত সরকার, পূর্বোক্ত)

একই সঙ্গে ব্রিটিশ  সরকার প্রাচীন কাল থেকে ভারতীয় আদিবাসিন্দাদের বিরুদ্ধে শাসকপক্ষীয়দের আরোপিত ঊনমানবিক (রাক্ষস, অপরাধী, হিংস্র) পরিচয়গুলোকে একেবারে আইনী মোহর লাগিয়ে দিল—রচিত হল ইন্ডিয়ান ক্রিমিনাল ট্রাইবস অ্যাক্ট, ১৮৭১। গোল্ডি এম জর্জ-এর একটি সাম্প্রতিক লেখায় এই প্রতিরোধগুলোর কথা খুব স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। (“হুল টু উলগুলান: লোকেটিং আদিবাসী রিভোল্টস ইন দ্য হিস্টরি অব ইন্ডিয়ান ফরেস্ট ল’জ”,  ফরোয়ার্ড প্রেস, ৩০ জুন, ২০২২; https://www.forwardpress.in/2020/06/hul-to-ulgulan-locating-adivasi-revolts-in-the-history-of-indian-forest-laws/) বস্তুত, ভারতে ব্রিটিশ  উপনিবেশ বিস্তারের আগের শতাব্দীগুলোর ঔপনিবেশিক ইতিহাসে —দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়ার মতো বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ঔপনিবেশিক দখলের কালে– বহিরাগত আক্রমণকারীদের সামনে স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে এমনতর প্রতিরোধের নজির খুব বেশি দেখা যায়নি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের কাছে এ-ধরনের প্রতিরোধের চরিত্র ছিল অপরিচিত। কেবল একটা প্রতিরোধের কথা মনে করা যাক: ১৮৫৫ সালে কেবল তীর-ধনুকের ওপর ভর করে সাঁওতাল জনজাতির নেতৃত্বে হুল নামক যে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, প্রবল প্রতাপশালী ব্রিটিশের পক্ষে সৈন্য ও অস্ত্রবল এবং তার এতদ্দেশীয় লাভার্থীদের সহায়তা সত্ত্বেও সেই প্রতিরোধকে ভাঙতে নাকানিচোবানি খেতে হয়েছিল। এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা বেশ তড়িঘড়ি অরণ্য আইন ও অপরাধী জনজাতি সংক্রান্ত আইনগুলো বলবৎ করে ফেলল।এর সঙ্গে যুক্ত হল নতুন নতুন ভূমি রাজস্ব নীতি, সম্পত্তির আইন (রুল অব প্রপার্টি), ও তথাকথিত আধুনিক কৃষির সম্প্রসারণ। যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রকৃতির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ কৃষি ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলে নতুন, এবং প্রায়শই প্রকৃতি-বিধ্বংসী, কৃষিব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হল।  ভাঙ্গিয়া ভুক্যা মধ্য ভারতের গোণ্ডদের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্রিটিশ অরণ্য ও ভূমি নীতি নিয়ে একটি বিশ্লেষণেযে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, সেটি ভারতের প্রায় সব আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও অঞ্চল সম্পর্কেই প্রযোজ্য। তিনি লিখছেন,

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বিভিন্ন শাসন নীতির মধ্য দিয়ে তুলনামূলকভাবে স্বায়ত্তশাসিত আদিবাসী ও পার্বত্য জনজাতিগুলিকে ব্রিটিশ শাসনের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে চাইল। ভূমি রাজস্ব নীতির সঙ্গে  আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির  যোগ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র নির্মাণ প্রক্রিয়াটিকে পাহাড় ও অরণ্য পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করল। এই নীতির ফলেজমির লোভে বহু অ-আদিবাসীর এই সব অঞ্চলে অনুপ্রবেশ ঘটল, এবং বিস্তীর্ণ অকর্ষিত জমি কৃষিক্ষেত্রে পরিণত হল। প্রথমে আদিবাসীরা এইসব জমি কৃষিযোগ্য করে তুললেন, তারপর মহাজনীর অ-আদিবাসীরা সেই সব জমি বেদখল করে নিল ও আদিবাসীদের উচ্ছেদ করল। তখন আদিবাসীরা অরণ্যের আরো ভিতরের দিকে গিয়ে চাষের জমি তৈরি করলেন। তাঁরা যেভাবে অবাধে অরণ্যকে  ব্যবহার করতে পারতেন, তা বন্ধ হয়ে গেল। এইভাবে ঔপনিবেশিক প্রকল্প আদিবাসীদের একটা জায়গায় আবদ্ধ করে দিল; তাদের আদিম ও বিচ্ছিন্ন সম্প্রদায় হিসেবে ছাপ মেরে দিল। ঔপনিবেশিক শাসনে এই বিচ্ছিন্নতার মধ্য দিয়ে আদিবাসীদের প্রান্তিক করে দেওয়া হল। (ভাঙ্গিয়া ভুখ্যা, “এনক্লোজিং ল্যান্ড, এনক্লোজিং আদিবাসিজ: কলোনিয়াল এগ্রিকালচার অ্যান্ড আদিবাসিজ ইন সেন্ট্রাল ইন্ডিয়া, ১৮৫৩-১৯৪৮”, ইন্ডিয়ান হিস্টরিক্যাল রিভিউ, ৪০(১), ২০১৩)

ঝাড়খণ্ড, ওডিশা, বাংলা—সর্বত্র একই চাতুর্য ও নিষ্ঠুরতার পুনরাবৃত্তি। উদাহরণ হিসেবে, রেললাইন পাতার কাজে, কয়লাখনির মজুর হিসেবে, অন্যান্য শিল্প প্রকল্পে, চা-বাগান গড়ে তোলায়—যে বিপুল শ্রমশক্তি নিয়োজিত হল, তা এল বাস্তুহারা, দেশহারা, প্রকৃতিহারা আদিবাসীদের কাছ থেকে। সাঁওতাল পরগনা বা ছোটনাগপুরের আদিবাসীদের পরবাসী হতে হল আসামে, উত্তর বাংলায়। উল্টোদিকে আদিবাসী অঞ্চলগুলো ভরে উঠল ঔপনিবেশিক প্রকল্পের লাভার্থী অ-আদিবাসীদের অনুপ্রবেশ কিছুটা  ও জবরদখলের মধ্য দিয়ে। এ বিষয়ে আমি অন্যত্র কিছুটা বিস্তারে আলোচনা করেছি (যেমন, ঘরছাড়াদের গ্রামে, কলকাতা: ক্যাম্প, ২০০৭ – বইতে, এবং “আদিবাসী ভারত”, প্রশ্নের লোককথা, কলকাতা: আরবিই বুকস, ২০২২ – প্রবন্ধে)। কিছু কিছু আদিবাসীকে অপরাধী জনজাতি হিসেবে চিহ্নিতকরণও এই পুঁজিবাদী প্রকল্পের অঙ্গ। সুমিত সরকার দেখাচ্ছেন, পুঁজিবাদী আগ্রাসনের অংশ হিসেবে, ব্রিটিশরা শুধু ভারতে বা অন্য উপনিবেশগুলোতেই “অপরাধী” ছাপ মারার কৌশলটি কাজে লাগায়নি। “দেশি-বিদেশি উভয় গোত্রের সম্পত্তিবানদের কাজে লাগবে” এমন এক “আধা বশংবদ শ্রমিক ভাণ্ডার তৈরি করার” উদ্দেশ্যে তারা স্বদেশেও “‘স্বভাব-অপরাধী’ গোষ্ঠীগুলিকে চিহ্নিত করে খেটে-খাওয়া গরিব ‘ভদ্রজন’দের থেকে আলাদা করার চেষ্টায় রত ছিল। (সুমিত সরকার, পূর্বোক্ত)। বস্তুত এর মধ্যে দিয়ে একদিকে যেমন আদিবাসী ও অ-আদিবাসীদের মধ্যে নিহিত, কিন্তু প্রায়শই নিষ্ক্রিয়, সংঘাতমূলক বৈশিষ্ট্যগুলোকে সঞ্জীবিত করে তোলা হল, অন্যদিকে তেমনি ভারতীয় স্তরবিভাজিত সমাজব্যবস্থাটিকে কাজে  লাগিয়ে সাধারণ শ্রমজীবীদের মধ্যেও অনৈক্যের অনেক নতুন উপাদান যোগ করল। এর নানা বিষময় ফল উত্তর-ঔপনিবেশিক কালেও, সভবত অধিক মাত্রায়, ফলে চলতে লাগল। এর সভ্যতাকে লজ্জায় অধোবদন করে দেওয়ার মতো উদাহরণগুলোর মধ্যে একটা হল আসামে ভয়ানক জাতি-দাঙ্গা। যে ঝাড়খণ্ডী আদিবাসীরা ঔপনিবেশিক প্রকল্পের মধ্য দিয়ে আসামের—এবং ভারতের—অর্থনীতির নির্মাণে বিপুল অবদান রাখলেন, সেই আদিবাসীরা আসামে কেবল যে সাংবিধানিক অধিকারগুলো থেকেই বঞ্চিত হলেন, তাই না, সরাসরি রাষ্ট্রীয় মদতেসেখানকার স্থানীয় আদিবাসীদের নানা অসন্তোষকে ঝাড়খণ্ডী আদিবাসীদের বিরুদ্ধে প্রবাহিত করে, তাঁদের হাজারে হাজারে হত্যা করা হল। যাঁরা হতে পারতেন স্বজন, তাঁরাই অবতীর্ণ হলেন দুর্জনের রূপে।

ঔপনিবেশিক শাসনের সমাপ্তি ঘটল। কিন্তু, ঔপনিবেশিক নীতিগুলো স্বাধীন ভারতের শাসকদের খুবই প্রিয় নীতি হয়ে উঠল। অরণ্যের বিনাশ উত্তরোত্তর বেড়ে চলতে লাগল, তার সঙ্গে যোগ হল, পাহাড়, নদী, জলাশয়, চারণভূমি দখল করে, সেখানে বসবাসকারী আদিবাসীদের তথাকথিত উন্নয়নের যূপকাষ্ঠে বলি দিয়ে পুঁজিমালিকদের জন্য লুণ্ঠনের যাবতীয় সু্যোগ তৈরি করে দেওয়া।  একটা সমীক্ষার হিসেবে, উন্নয়নের নামে উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের ৪০ শতাংশই হচ্ছেন আদিবাসী— অথচ মোট জনসংখ্যায় তাঁদের অংশ মাত্র ৮ ভাগ! ২০১৪ সালের পর থেকে এইলুণ্ঠনের মাত্রা বেড়ে গেছে বহুগুণ। খনির নামে, কারখানার নামে, বাঁধের নামে এতকাল আদিবাসীদের উচ্ছেদের যে প্রক্রিয়া জারি ছিল, বর্তমান শাসনে তা এক ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বহুসংগ্রামে অর্জিত ২০০৬ সালের অরণ্য আইন আদিবাসী মানুষদের যে সামান্য সুরক্ষা দিয়েছিল,  যার সুবাদে ডোঙ্গরিয়া কন্ধ আদিবাসীরা তাঁদের দেবতার আবাস নিয়মগিরি পাহাড়কে পুঁজিবাদী আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন, সেই আইনের ক্ষমতাকে সংকুচিত করে দেওয়া হল।

এই সংকোচন কেবল আদিবাসীদের বাস্তবজীবনের ওপর আক্রমণ মাত্র নয়, এটি হল একটি জীবনাদর্শের ওপর আক্রমণ। এই জীবনাদর্শের কেন্দ্রে আছে প্রকৃতির সঙ্গে সহজীবী হয়ে থাকার মানব পরম্পরায় অর্জিত অভিজ্ঞতা। এখনো খুব প্রয়োজন না পড়লে কাঁচা গাছ কাটার ওপর ঐতিহাসিকভাবে গড়ে ওঠা নিষেধাজ্ঞা তাঁরা মেনে চলেন। এখনো পাহাড়িয়া জনজাতির লোকেরা তাঁদের পরম্পরাগত চাষ কুরাম-এর জন্য জঙ্গলের যে অংশটি বেছে নেন, চাষ তুলে নেবার পর অন্তত তিন বছর সেই মাটিতে পা দেন না। সে-অঞ্চলের সাঁওতালদের কাঠের দরকার হলে কুরামের জন্য কাটা গাছের শুকনো ডালপালা নিয়ে যান—তা সে যত দূরের পথ হোক না কেন। আর যে আদর্শ এঁদের ওপর আক্রমণটা নামিয়ে আনছে তা হল মালিকী সম্পত্তির, একক স্বার্থের, একক দখলদারির কুৎসিত এক মনোবৃত্তি। আজকের পৃথিবীকে ব্যক্তির স্বার্থে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়ার মনোবৃত্তি। আমরা এমন এক মোড়ে এসে পৌঁছেছি, যেখানে প্রকৃতিও প্রকৃতিস্থ মানুষদের সংগ্রামটি কেবল তাঁদের একক সংগ্রাম নয়, আদিবাসী মানুষের বাস্তব জীবনের সংগ্রাম নয়, এটা হল গোটা পৃথিবীর অস্তিত্বের সংগ্রাম।

স্বাধীনতার আগে, ২৪ডিসেম্বর, ১৯৪৬ তারিখে আদিবাসী নেতা জয়পালসিংহ মুণ্ডা, কনস্টিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির সভায় দৃঢ় ভাষায় জানিয়েছিলেন, “এদেশে যারা সবচেয়ে খারাপ আচরণের শিকার হয়েছে, তারা হচ্ছে আমার লোকেরা। … আমাদের [আদিবাসীদের] গোটা ইতিহাসটাই হল শোষণ ও উচ্ছেদের ইতিহাস,  আর মাঝে মাঝেই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ইতিহাস।” (https://indianhistorycollective.com/jaipal-singh-munda-historyofindia-constituent-assembly-adivasirights/) তাসত্ত্বেও, আদিবাসী সমাজ থেকে পাওয়া তাঁর বিশ্ববোধে তিনি ঘোষণা করেছিলেন,  আমাদের সবাইকে একসঙ্গে এগোতে হবে। তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া মূল্যবোধ তাঁকে শিখিয়েছিল, মানুষে মানুষে, এবং মানুষে প্রকৃতিতে, মর্যাদার ভিত্তিতে সহযোগিতাই পারে আমাদের অস্তিত্বও উন্নতি সুনিশ্চিত করতে। বিপরীতটা হচ্ছে ধ্বংস।

এই মুহূর্তে ভারত এক ভয়ঙ্কর গণতান্ত্রিক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এ থেকে উদ্ধার পাবার খুব বেশি পথ খোলা নেই। ভারতীয় গণতন্ত্রই আজ প্রশ্ন চিহ্নের মুখে। আদিবাসী শুধু নন, দলিত, মুসলমান ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বা বিরুদ্ধকন্ঠী মানুষ – সকলেই বিপন্ন।

সমাজ শাস্ত্রী জঁদ্রেজের উপলব্ধি: “আমরা এমন একটা অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছি যেখানে মানুষের ইতিহাসে এই প্রথম একটা বাস্তব সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে যে মানব জাতি অচিরেই নিজেকে ধ্বংস করে ফেলবে, অথবা ‘মধ্যযুগে’ ফিরে যাবে।” (জঁদ্রেজ, পূর্বোক্ত) প্রকৃতিস্থ এক নতুন সংস্কৃতিই পারে পৃথিবীও সেই পৃথিবীতে  মানুষের বসবাসের নিশ্চয়তা এনে দিতে।

কার্ল মার্কস আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, “এমনকি একটা গোটা সমাজ, একটা জাতি, কিম্বা একই সঙ্গে বিদ্যমান সমস্ত সমাজ এ পৃথিবীর মালিক নয়। এরা কেবল বসবাসকারী অধিষ্ঠাতা, এর লাভার্থী, এবং উৎকৃষ্ট গৃহকর্তার মতো একে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি উন্নততর অবস্থায় রেখে যেতে হবে।” (কার্লমার্কস, ক্যাপিটালখণ্ড৩, লন্ডন: পেঙ্গুইন, ১৯৯১) ভারতের বহু দুর্ভাগ্যের মধ্যে একটা বিরাট সৌভাগ্য এই,  এখানে প্রকৃতিস্থ মানুষদের বসবাসের ও সংগ্রামের দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। এখনো এদেশে বসবাস কারী, বহু বিপর্যয়ে,  বহু আক্রমণে ও আপন আদর্শ পরিত্যাগ না করায় বদ্ধ পরিকর আদিবাসী মানব সমাজগুলো টিকে আছে। তাঁদের স্বজন এবং আদর্শগত অভিভাবক মেনে নিয়ে, তাঁদের হাত ধরে এগোনোটাই মানুষ ও পৃথিবী উভয়ের কাছে শুধু মঙ্গলের না, একমাত্র উপায় ও বটে।

[২৭ আগস্ট ২০২২ পশ্চিমবঙ্গ দলিত সাহিত্য সংস্থা আয়োজিত চুনি কোটাল স্মারক বক্তৃতা]

“চতুর্থ দুনিয়া” সেপ্টেম্বর ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত।

আপনার কেমন লাগলো?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *