দেশভাগ ও নিন্মবর্গের বাংলা নাটক / রাজু দাস
রচনা : 2016
বাংলা ভাষায় সর্বশ্রেষ্ঠ নাটকগুলি তৈরী হয়েছে নিন্মবর্ণের অথবা নিন্মবিত্তের খেটেখাওয়া কষ্টজীবী মানুষের সুখ দু:খ ও বিভিন্ন সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সমস্যা ও সমাধানের ওপর দৃষ্টি রেখে ।
অথচ দেশত্যাগি উদ্বাস্তু মানুষের জীবনের ওপরে বহু কবিতা গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ লেখা হলেও নাটকের ক্ষেত্রে পিছিয়ে রাখা সমাজের মাত্র জনাকয়েক উদ্বাস্তু নাট্যকারের দেশবিভাগ বিয়ষক নাটক নিয়ে পর্যালোচনা করছি । নিজে একজন উদ্বাস্তু দলিত নাট্যকর্মী হিসাবে দায়বদ্ধতার কারনে ।
1947 সালে মুষ্টিমেয় কয়েকজন কট্টর ধর্মান্ধ জাতপাত বিদ্বেষী হিন্দু মুসলিম নেতা ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করবার জন্য ভারতবর্ষ নামক দেশটাকে ভেঙ্গে তিন টুকরো করেও সুখী হলো না। সংখ্যালঘুদের বিতারণের চক্রান্ত চলতে লাগল ।
কোটি কোটি অত্যাচারিত গৃহহীন উদ্বাস্তু মানুষ আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের পাহাড় জঙ্গল অনুর্বর জমিতে। আশ্রয় শিবিরে ।
এই সকল শিকড়বিহীন উদ্বাস্তুদের নিয়ে তথাকথিত উচ্চবর্ণের নাট্যকারেরা বেশ কয়েকটি নাটক লিখে শহরের মঞ্চে মঞ্চে অভিনয় করে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন । সেই সকল নাট্যদলের পেছনে ছিলেন শিক্ষিত সাম্যবাদি অর্থবান রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিবর্গ।
নাট্যশিল্পে অন্তজ মানুষের প্রাধান্য অতীতেও ছিল না, বতর্মানে তো আশাপ্রদভাবে নেইই। এর মূল কারন বিশ্লেষনের ক্ষেত্র এটা নয় । শুধু এইটুকু বলতে পারি শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ও সঙ্গীতের অনেক ধারাতেই অন্তজ মানুষদের প্রাধান্য অতীতেও ছিল, বর্তমানেও আছে শুধু বর্ণবাদিদের প্রচারের আলো এদের দিকে পড়েনি।
আমার ক্ষেত্রসমিক্ষায় যে কজন নট- নাট্যকার -পরিচালক পেয়েছি তাদের বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করছি।
গণনাট্য সংগের হাত ধরে যেমন প্রতিবাদী নাটক রচিত হয়েছে তেমনি দেশভাগের পটভূমিতেও 1951 সালের 21 শে জুন সলিল সেন রচিত ” নতুন ইহুদি ” নাটকটি রঙমঞ্চে অভিনীত হয়েছিল ।
দেশভাগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সাধারণ ছাপোষা মধ্যবিত্ত শ্রেণি। সবকিছু হারিয়ে বিবেকের কাছে তারা অসহায় হয়ে পড়েছিল। একান্নবর্তী পারাবারিক সম্পর্ক ভেঙ্গে গিয়েছিল। সেই সঙ্গে পুরাতন মূল্যবোধগুলিও বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বাস্তুচুত্য – দেশচুত্য – সমাজচুত্য – পরিবারচুত্য এইসব পরিচয়হীন উদ্বাস্তুদেরই ইহুদী বলে তুলনা করেছেন,হিটলারের অত্যাচারিত জার্মানির ইহুদীদের উদ্বাস্তু হবার কাহিনী সামনে রেখে কপিলকৃষ্ঞ ঠাকুরের ” অন্য ইহুদী “ছোটগল্পের নাট্যরুপ দিয়ে অভিনয় করালেন প্রানগোবিন্দ বিশ্বাস 28 শে ডিসেম্বর 1997 সালে । ঠাকুর নগর হাইস্কুলে, বাংলা দলিত সাহিত্য সংস্থার বাৎসরিক সঙ্গীতিতে। এরপরও একাধিক আমন্ত্রিত শো হয়েছিল।
অন্য ইহুদী নাটকের ভূমিকা তুলে দিচ্ছি।
দলিত মানুষের সঙ্গেই মাটির থাকে নিবির যোগ। যারা মুনাফাভোগী পরের শ্রম চুরি করে বেঁচে থাকে। বাস্তুচ্যুত হলে জমিহারা হলে তাদের তেমন কিছু আসে যায় না।
কিন্তু সমুহ ক্ষতি হয় কৃষক আর কৃষিশ্রমিকের। এরাই আবার যখন ধর্মীয় মৌলবাদীদের কোন নতুন দেশে আসেন সেখানেও আর এক ধর্মীয় মৌলবাদী তথা বর্ণবাদীরা তাদের প্রতিষ্ঠার সমস্ত পথ রুদ্ধ করে রাখে।
কোন ধর্মেই যাদের কোন অধিকার ছিল না। শুধু ধর্মের কারনেই ছিন্নমূল হয়ে ঘুরে বেড়ায় তারা ভারতের পথে প্রান্তরে। এ যেন ইহুদীদের ইতিহাসের পুণরাবৃত্তি। কিন্তু কে এদের পরিত্রান করবে!
এইসব হতভাগ্য দু:খি মানুষের জীবনালেখ্য নিয়েই নাটক ” অন্য ইহুদি “
1970 – 71 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে খানসেনা এবং তাদের দোসর রাজাকার বাহিনী যেভাবে আওয়ামীলীগ এবং তাদের সমর্থিত নিম্নবর্ণের তথাকথিত হিন্দুদের মধ্যে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে তাদের বাড়ি ঘর গুড়িয়ে লুটপাট করে নিরাশ্রয় করেছিল। তাতে হিন্দু মুসলিমরা ( আওয়ামীলীগ সমর্থক ) প্রান মান বাঁচাতে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। এদের সংখ্যা আনুমানিক দুকোটি।
বাংলাদেশের এই মুক্তিযুদ্ধের ( চাক্ষুস ) পটভূমিকায় দলিত নট নাট্যকার রাজু দাস 1971 সালে লিখেছেন ” শপথ নিলাম ” একাঙ্ক নাটক।
যে নাটকটি নিজের পরিচালনায় প্রথম অভিনয় করেছিলেন যুব সংহতি ক্লাবের সৌজন্যে মাঠপাড়া, বাবাকপুর, উ : 24 পরগনায়। নাটকটি পঞ্চাশের উর্দ্ধে আমন্ত্রিত ও একাঙ্ক মঞ্চে অভিনিত হয়েছিল।
এই নাটকের শেষের দিকের কিছু সংলাপ তুলে দিচ্ছি।
বাবু : দাদা দাদা, তুমি শান্ত হও। শান্ত হয়ে কথা শোন। আমি তোমার সোনার বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দেবোই দেবো।
পাগল : ( হাসি থামিয়ে ) দিবি! দিবি আমাদের চৌদ্দ পুরুষের দেশকে খানসেনাদের হাত থেকে মুক্ত করে দিবি, কথা দে। আমি শান্ত হবো। ভুলে যাবো সব দু:খ। না না তুই একা তো পারবি না।
সব্বাই : বাবুদা একা নয়, আমরা সব্বাই –
লতিফ : কৃষক মজুর সমস্ত হিন্দু মুসলমান বাঙালি একজোট হয়ে অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে পূর্ব বাঙালাকে স্বাধীন করবোই।
অসিত : কুসংস্কার মুক্ত এক নতুন সমাজ শাসনতন্ত্র গড়ে তুলবো। যে সমাজে থাকবে না হিন্দু মুসলমান ভেদাভেদ। ফিরিয়ে আনবো সাম্যবাদ।
ভোলা : আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যে সকল মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ হয়েছেন তাদের জীবন নিয়ে নাটক লিখে অভিনয় করাবো।
পাগল : সত্যি বলছ,তোমরা সত্যি বলছো! তবে শপথ নাও দেহের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে যুদ্ধরত মুক্তি ফৌজের পাশে থাকবো। আজ থেকে শপথ নিলাম বাংলা মায়ের মুক্তি ও শান্তি প্রতিষ্ঠাই আমাদের ধর্ম কর্ম। জ য় বাংলাদেশের জ য়।
দেশভাগের কাহিনী অবলম্বনে কপিলকৃষ্ঞ ঠাকুরের ছোট্টগল্পের ” হুকো “, বিমল বিশ্বাসের গল্পের ” মাটির টান ” নাট্যরূপ দিয়ে এবং নিজের লেখা নাটক ” এই দেশ কী আমার ? ” ” নয়নজ্যোতি ” ” অদাব ” বহু অভিনয় করিয়েছেনন রাজু দাস।
নমিতা দাসের ছোট নাটক ” প্রত্যাক্ষান ” এর কয়েকটি সংলাপ : –
সঞ্চারি : মরিচঝাপিতে বাবা মাকে হারানোর পরে , যে মামা মামি আমাকে আপন সন্তানের মতো কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন। যারা এক মুহূর্তের জন্য বুঝতে দেননি আমি পিতৃ মাতৃহীন। সেই তাদেরকে দু:খ দিয়ে আমি নিজের সুখের জন্য পালিয়ে গিয়ে তোমাকে বিয়ে করতে পারব না।
বিশু : তাহলে এতদিন তুমি আমার সাথে প্রেমের অভিনয় করলে কেন ?
সঞ্চারি : তুমি তো জানো, আমরা পণপ্রথার ঘোরতর বিরোধী । তাছাড়া তোমার মা বাবার অমতে আমাকে বিয়ে করে তুমি সুখি হতে পারবে না।
বিশু : এ কথা কেন বলছো সঞ্চারি ?
সঞ্চারি : বলছি কারন তুমি হিন্দুধর্মের আজগুবি গল্পগাথায় বিশ্বাসী আর আমি মতুয়াধর্মে বিশ্বাসী। যোগেন মন্ডল, আম্বেদকরের রাজনৈতিক মতাদর্শে অনুপ্রাণিত ।
বিশু : বেশ তো। তোমার বিশ্বাস তোমার ধর্ম নিয়ে তুমি থাকবে । আমার বিশ্বাস নিয়ে আমি থাকব।
সঞ্চারি : এই বিষয়টা যদি এতো সহজ হতো তাহলে রামমন্দির আর বাবরি মসজিদ নিয়ে কোন বিরোধ থাকতো না। আসল কথা কি জানো বিশুদা, গৌতমবুদ্ধ কবির তুকারাম লালন ফকিরের মতো উদার মনের মানুষের আজকে বড় অভাব। একমাএ মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল মহাশয়ই মনে প্রানে বিশ্বাস করতেন হিন্দু মুসলমান একই মায়ের দুটি সন্তান ।
নকুল মল্লিকের আটখানি প্রকাশিত নাটকের মধ্যে একমাএ ” বিচরণ মাঝির উপখ্যান ” নাটকে পূর্ব বাংলা থেকে দেশত্যাগি পূত্রের কলকাতার ধোপদস্তুর বাসায় একান্ত বাধ্য হয়ে উঠেছিলেন বৃদ্ধ পিতা। এবং এসেছিলেন বলেই জানতে পারলেন তার একমাত্র নম:শূদ্র পূত্র প্রেমথ মাঝি, মিষ্টার প্রমথনাথ মজুমদার, হায়ারকাষ্ট হয়ে গেছেন ।
দেশত্যাগি না হলে এই পরিনতি হতো কি ?
এই প্রশ্নটাই রেখেছেন নট্যকার পাঠক ও দর্শকের কাছে ।
প্রানগোবিন্দ বিশ্বাস জীবনে গোটা কুড়ি যাত্রা নাটক লিখেছেন । তার মধ্যে একমাত্র 1971 সালে জুলাই মাসের এক বিশেষ ঘটনাকে নিয়ে লিখেছেন মৌলিক নাটক ” সম্ভ্রমের স্বাধীনতা “। এই নাটকের কিছু সংলাপ : –
গীতা : শুরু হলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ । চলতে লাগল জঙ্গিদের তান্ডব – রাহাজানি – অগ্নিসংযোগ।
প্রনব : মানবিক কারনে মিত্রদেশ ভারত বাড়িয়ে দিয়েছেন সহযোগিতার হাত। দলে দলে বাংলাদেশের শরনার্থী ঢুকতে লাগল ভারতবর্ষের মাটি পশ্চিমবঙ্গে।
গীতা : অগ্নিগর্ভ এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি জঙ্গিদের সাথে মির্জাফরেরা মত হাত মিলিয়েছে রাজাকার বাহিনী ।
রহিম : দেশের মা বোনের ইজ্জত নিয়ে হানাদাররা ছিনিমিনি খেলছে । নারীত্বের শেষ সম্বলটুকু রক্ষা করতে আমাদের মায়েরা বোনেরা ঘর বাড়ি ছেড়ে পথে প্রান্তরে- ঝোপে ঝাড়ে আত্মগোপন করে আছে ।
গীতা : হ্যা – তাদের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম। এই মুহূর্তে আমার বাবা মা আত্মীয় স্বজনেরা কোথায় আছেন জানি না।
রহিম : কাঁদিস না গীতু। তুইতো জানিস আমার বাবা মা বোনটাও নিরুদ্দেশ ঐ সকল রাজাকারদের ভয়ে।
স্মৃতিকনা হাওলাদার, ওপার বাংলার ছিন্নমূল একটি পরিবারের সদস্য। তাই তার দৃষ্টি এড়ায়নি রেল লাইনের পাশে দরমার বেড়ার ছোট ঘর করে আরো অনেক ছিন্নমূল পরিবারের সাথে লড়াই করছিলেন প্রত্যেকে।
এই সব পরিবারের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কাহিনী নিয়ে একটি নাটক লিখেছেন স্মৃতিকনা দেবী ” জলে কুমির ডাঙায় বাঘ ” এই নাটকের দু চারটি সংলাপ :
দুলাল : ঘর চিনলেন কি করে ? লাইনের পাড়ের সব ঘরগুলি তো একই রকম ।
কানাই : কিছুদূর আসার পরে একজনকে তোমার নাম বললাম। সে দেখিয়ে দিল। আর বলল – ভাঙাপায়ে পিতলা চোখ। কে না চিনতে পারে দুলালের ঘর।
দুলাল : ও বুঝতে পেরেছি, ওনি বাছারদা। খুব ভালো লোক । আমাদের দুর্দশার কথা ভাবে। আমি গাছপালার একটু আধটু চাষ করি। উনি বলেন – এ লাইনের যায়গা পরের যায়গা। এখানে এসব করে কি লাভ হবে। আবার তো সব ছেড়ে দিতে হবে। তার থেকেও বড় কথা এই সব গাছপালা দেখলে পুববাঙলার কথা মনে পড়ে যায়। ও দেশে কি ছিল আর কি হল।
এ সব কথা ছাড়ান দ্যান। আপনি হঠাৎ পূর্ব বাংলা থেকে এ দেশে এলেন কেন?
কানাই : তোমরা ঐ দেশে না ফিরে ভালোই করেছিলে।
দুলাল : ক্যান ?
কানাই : শোন নাই, মুজিবুর রহমানরে গতকাইল মাইর্যা ফালাইছে। জয়বাঙলা এখন উত্তাল । নমো মন্ত্রীরা সবাই পালাইয়া আইছে। তাদের লগে আমরাও অনেকে চইল্যা আইচি।
লীলা : ( কান্নার সুরে ) মা বাবা দিদি বৌদি আর সবাই কে কোথায় আছে জানো কি ?
কানাই : না এখনো খোঁজ খবর নিতে পারি নাই। আমরা বেপদের আশঙ্কা কইর্যা আগে ভাগে চইলা আইছি। বাকিরাও চইলা আসবে ।
রবিন বিশ্বাস : স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি ঘটনা বিন্যাসের নাটক ” লাঠিয়াল “। তারই দু একটি সংলাপ ।
কবিতা : দাদা তোমার মাথায় আঘাতটা কিভাবে লাগল তাকি তোমার মনে আছে ?
গদাই : না রে বোন। যদি মনে থাকতো তাহলে মা বাবা ভাই বোনেরা কে কোথায় আছে তা নিশ্চয় জানতাম । শুধু মনে আছে ঝুঝঝুম গোলা গুলির শব্দ। একটু পরেই একটা গুলি আমার মাথা ছুয়ে বেড়িয়ে গেল। আমি ভয়ে আতঙ্কে পাশের ইছামতি নদীর জলে ঝাপিয়ে পড়লাম। ব্যাস, আর কিছু মনে নাই।
নেপাল রায় : ওপার বাঙলায় বসে লিখেছিলেন 1973 সালে ” রক্ত স্বাক্ষর ” মুক্তি যুদ্ধের পটভূমিতে পূর্নাঙ্গ নাটক ।
এটি বরিশাল জেলার কুড়িয়ানি গ্রামে অভিনীত হয়েছিল। সেদিন দর্শক আসনে বসেছিলেন প্রখ্যাত সমাজসেবি চিত্তরঞ্জন সুতার ।
ব্রজেন্দ্র নাথ হালদার : লিবারেশন মুভমেন্টের উপর নিজের লিখিত এবং পুরুস্কৃত উপন্যাস ” রক্তে রাঙা রূপসী বাংলা ” র নাট্যরূপ দিয়েছেন নিজেই । সেই নাটকটি গত চারবছর যাবত অভিনয় করে চলেছেন ” পঞ্চম সওয়ারী ” নামক একটা গ্রুপ থিয়েটার দল।
পরিমল মিস্ত্রি : 2003 সালে দিল্লি জাতীয় স্কুল অফ ড্রামা থেকে পাশ করে বাবা মা স্ত্রীকে নিয়ে এবং আরো ছেলে মেয়েদের নিয়ে গড়ে তোলেন ” হালিশহর মাটি ” নামে একটি নাটকের দল। নিজের লেখা একধিক নাটক শো এর পরে দেশভাগ এবং মরিচঝাপির কাহিনিকে অবলম্বন করে, বিভিন্ন লেখকের লেখা থেকে তথ্য সংগ্রহ, সম্পাদনা, ও নাট্যরূপ দিয়ে অভিনয় করে চলেছেন ” জিয়ান ডাঙার খোঁজে “
এই নাটকটি প্রচুর আমন্ত্রিত শো করে চলেছে আজও ।
সুবল চন্দ্র দাস : দুর্গাপুর থাকাকালীন হরিচাঁদ ঠাকুর, গুরুচাঁদ ঠাকুর ও অশ্বিনী গোসাইকে নিয়ে তিনটি পূর্নাঙ্গ নাটক লেখার আগেই দেশভাগের উপর 1974 সালে লিখেছেন এবং প্রকাশ করেছেন ” কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ ” এই নাটক বেশ কয়েকটি শো হয়েছিল । এই নাটকের একটি দৃশ্য তুলে দিলাম।
নগেন : এই দেশে কেমন করে থাকবি অপু। এ দেশ এখন আর আমাদের নয়। কিন্তু এমন তো আগে ছিল না। সেই অনাদিকাল থেকে আমরা হিন্দু মুছলমান একসাথে ছিলাম । কখনো ঝগড়া বিবাদ হলে নিজরাই মিটিয়ে নিতাম। এখন সন্ত্রাসবাদী রাজাকাররা আমাদের ভয় দেখাচ্ছে। বলছে হিন্দুদের এদেশ থেকে তাড়াতে পারলে তাদের জমিজমা বিষয় সম্পত্তি সব মুছলিমদেরই হবে। তাই শুনে প্রতিবেশি মুসলমানরাও আমাদের অত্যাচার করছে। প্রশাসকের কাছে নালিশ করতে গেলে তারাও দুরদুর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে। অপু, যে দেশে থেকে মা বোনের ইজ্জত বাঁচাতে পারবো না। সে দেশে আমরা আর থাকবো না।
অপু : আপনিও দ্যাশ ছাইড়া চইলা যাইবেন মাষ্টার মশাই ?
নগেন : উপায় নাইরে অপু, সেদিন বাজার করতে গিয়েছিলাম। আমার ছাত্র নরুল কাশেম করিম আমাকে দাড় করিয়ে বলল – এই শালা মাষ্টার আগামীকালই সক্কালে এই দ্যাশ ছাইড়া ইন্ডিয়াতে চইলা যাবি নইলে কাইটা নদীর জলে ভাষাইয়া দিমু। আর তোর মাইয়ারে নিকা করুম।
সুমিতা : ঠিক কইছেন মাষ্টার মশাই। সেদিন আমি পুকুরে জল আনতি গেলে কতগুলা অচেনা মুছলমান ছাওয়াল আমার দিকে এমন ভাবে তাকাইয়া ছিল যে আমি ভয়ে আতঙ্কে আতকে ওঠছিলাম। এই বুঝি খাবলাইয়া খায়।
নগেন : শোন অপু অনেক অপমান সহ্য করেছি। আর নয়। মান সম্মান থাকতে আমরা আজ রাতেই ভারতে চলে যাই। সেখানে হয় তো ভাতের অভাব হবে কিন্তু মান সম্মান তো থাকবে !
( বাইরে আল্লাহ আকবর ধ্বনি শোনা যাবে। হঠাৎ ছুটতে ছুটতে বাদলের প্রবেশ )
বাদল : দাদা দাদা, রাজাকারা দল বাইন্ধা এদিকেই আইতাছে। হাতের কাছে পাইলে আমাগো কচুকাটা করবো। এখনি পালাইতে হইবো। চল
অপু : একটু দাড়া মাকে লইয়া আসি –
বাদল : মা রে হরেন কাকার লগে আগেই ভারতে পাঠাইয়া দিছি। তাড়াতাড়ি চলেন মাষ্টার মশাই।
নগেন : তোমরা সুমিতাকে নিয়ে এগোও। আমি বাড়ি থেকে সব্বাইকে নিয়ে আসি।
বাদল : আপনাগো বাড়ির সবাইরে হরেন কাকার লগে পাঠাইয়া দিছি ।
সুমিতা : আপনি আমাগো লগে চলেন মাষ্টার মশাই। ভাগ্যে থাকলে পথেই দেখা হইবোনে।
অপু : তোরা আগাইয়া যা। আমি জগারে লইয়া আইতাছি। আর হরিচাঁদের থানে শ্যাষ প্রনাম কইরা আসি । ( সকলের প্রস্থান )
এ পযর্ন্ত দেশভাগের পটভূমিতে তথাকথিত নিম্ন বর্ণের নাটককারদের প্রকাশিত এবং অভিনিত নাটকের সংক্ষিপ্ত বর্নণা করা হয়েছে ।
এর মধ্যে 1969 রাজু দাসের রচিত প্রথম নাটক ” বেনামী ” র কিছু সংলাপ : –
তাপস : কি বললি! বেড়ালে দুধ খেয়েছে। ননসেন্স। সাধারণ একটা কাজ যদি তোর দ্বারা হয়।
নটহরি : কোন কামডা হয় না কন দিকি ?
তাপস : ক’দিন আগে অতোদামি আলমারিটার কাঁচটা ভাঙ্গলি। রেডিও টা নষ্ট করলি। ছোটজাতের ছেলে তো এসবের মূল্য বুঝবি কি করে ?
নটহরি : বাবু আমারে আপনে যতখুশি গাইল দ্যান, মারেন বকেন আমি কিছ্ছু কমু না। কিন্তু ছোটজাইত আর বাপ মা রে তুইলা গাইল দিবেন না।
তাপস : চাকর বাকরকে ছোটজাত বলবো না তো ভদ্রলোক বলবো! তুই ছোটলোক তোর বাপ ছোটলোক।
নটহরি : খবরদার। আবার যদি এমন গাইল পারেন তাইলে আমিও কিন্তু মুখ খুলুম।
তাপস : একশোবার বলবো। কি বলবি তুই, বল?
নটহরি : আপনেও তো অবিনাশ মুখার্জির ঘরজামাই। ঘরজামাই চাকর বাকর ছাড়া আর কি ।
তাপস : ( থাপ্পর ) যতবড় মুখ নয় ততবড় কথা। তোকে আজ আমি মেরেই ফেলবো। আমার কোম্পানিতে দেড়শো স্টাফ কাজ করে তাদের কারো সাহস নেই যে কেউ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে। আর তুই –
নটহরি : কল কারখানা আপনাদের না। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফালাইয়া কাম করে সেই সব শ্রমিক মেহনতি মানুষের । ওদের দয়াতেই আপনারা বাইচা আছেন। এই কথাডা মনে রাইখবেন।
তাপস : বা: বা:! ওপার বাংলা থেকে এসে অল্পদিনের মধ্যে বেশ পলিটিক্যাল ডায়লগ শিখে নিয়েছিস দেখছি। যা যা বেরো এখান থেকে। সেদিন ফুটপাত থেকে তুলে এনে আশ্রয় দিয়ে ভুল করেছি । যা ভাগ।
নটহরি : যাইতাছি। তয় জানেন বাবু, পূর্ব পাকিস্তানে জমিজমা টাকা পয়সা আমাগো কম ছিল না। ভাগ্যদোষে আইজ আমরা ভিটামাটি ছাড়া।
আইজই ফিরা যামু ফেলে আসা জন্ম ভিটায়। মরি তো ওদেশেই মরবো। ( প্রস্থান )
তাপস : যা যা তোদের সব বাঙালদের মুখে একই ডায়লগ ওদেশে জমিদারি ছিল। ( প্রস্থান )
আমার অজান্তে হয় তো আরো অনেক দলিত নাটককার আছেন যাদের সন্ধান আমি পাইনি।
= = = = = = = = = =