দলিত সাহিত্য আন্দোলনের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত
ডাঃ স্বপন বিশ্বাস
সম্প্রতি সাহিত্য লইয়া বিবাদ বাঁধিয়াছে। দলিত সাহিত্য নামক এক প্রকার সাহিত্যের উদ্ভব হইয়াছে। দলিতদের জীবন লইয়া, দলিতদের দ্বারা লিখিত সাহিত্যকে দলিত সাহিত্য বলা হইতেছে।
একদল বলিতেছেন, ‘দলিত সাহিত্য’? সে আবার কি এবং কেন? সাহিত্যকে কি কোনও বিশেষ তকমা দেওয়া যায়? কতই না রঙ্গ দেখিতেছি! ইহার পরে আরও কত দেখিব কে জানে? সাহিত্যের মত এই সুপবিত্র বিষয় লইয়া যে ছেলেখেলা শুরু হইতেছে, ইহার আসু অন্তিম সংস্কার করা দরকার। তাহাদের কথা, দলিতদের দ্বারা রচিত সাহিত্যকে যদি দলিত সাহিত্য বলিতে হইবে, তাহা হইলে ব্রাহ্মনদের রচিত সাহিত্য হইবে ব্রাহ্মন্য সাহিত্য, তেমনই হইবে কায়স্থ সাহিত্য, বৈশ্য সাহিত্য ইত্যাদি.. ইত্যাদি..। প্রকৃত সাহিত্যের মাধুর্য্য লইয়া, সূচীতা লইয়া এই ছেলেখেলা বন্ধ হউক। ইহাদের মধ্যে প্রায় সবাই তথাকথিত প্রতিষ্ঠিত অ-দলিত সাহিত্যিক সপ্রদায়। কেহ কেহ তো সোস্যাল মিডিয়ায় লাঠালাঠি করিতেছে- যেন এই সাহিত্য তাহার স্থাবর সম্পত্তি কাড়িয়া লইতেছে, তাহার ভিটামাটি জবর-দখল করিতেছে। তাহারা সাহিত্যের সূচীতা রক্ষায় দৃড়-প্রতিজ্ঞ হইয়া একজোটে মাঠে নামিতেছেন। তাহারা হয়তো মনে মনে এইরূপও ভাবিতেছেন, ব্যাটারা রিজার্বেশান পাইতে পাইতে মাথায় উঠিয়াছে, এখন সাহিত্যেও রিজার্বেশন লইয়া আমাদের ভাগে ভাগ বসাইতে চাহে!
আর অন্যদল বলিতেছে অন্য কথা। তাহাদের বক্তব্য, যদি ‘বৈষ্ণব সাহিত্য’ হইতে পারে, যদি ‘শিশু সাহিত্য’ হইতে পারে, যকি ‘কৃষ্ণ সাহিত্য’ হইতে পারে, তবে দলিত সাহিত্য নহে কেন?
কিন্তু দলিত সাহিত্য বিষয়টি কি? যাহারা এই সাহিত্যের পক্ষে, তাহারা বলিতেছেন, যাহারা বঞ্চিত, যাহারা নিপীড়িত, যুগ যুগ ধরিয়া যাহারা অবহেলা, অপমান ও বঞ্চনার শিকার, যাহারা তথাকথিত সমাজের নিকট অস্পৃশ্য, যাহারা রাস্তায়, দোকানে, অপিসে এমনকি প্রেমে ও সংসারে জন্মসুত্রে দলিত হইবার জন্যে ক্ষণে ক্ষণে অপমানিত হয়, তাহারা যখন তাহাদের মনের কথা কলমে তুলিয়া আনে, তাহাদের দ্বারা সেই সুত্রে যে সাহিত্যের জন্ম হয়, তাহাই দলিত সাহিত্য। যেহেতু সাহিত্য জীবনের কথাই বলে, তাই যে জীবন সেই যন্ত্রণা উপলব্দি করে নাই, সে কখনওই এই যন্ত্রণার প্রকৃত স্বরুপ তুলিয়া আনিতে পারিবে না এবং আনিতে চাহিবে না।
এখন বেশিরভাগ মানুষেরই দ্বৈত সত্ত্বা। তিনি অন্তরে এক প্রকার, বাহিরে অন্য প্রকার। বাহিরে খোলা মঞ্চে গিয়া সাম্যবাদী বক্তৃতা পেশ করিয়া মঞ্চ কাঁপাইয়া, জাত-পাতের তুলাধোনা করিয়া ঘরে গিয়া পুত্রের জন্যে স্বগোত্র, বা উচ্চ অসবর্ণ পাত্রী খোঁজেন। অপিসের কোন বড়বাবু ব্রাহ্মন হইলে তাহার অধস্তন কোন ‘সর্দার’ পদবীধারী কর্মচারীকে আঁড় চোখে দেখেন, মনে মনে গালি পাড়েন, তাহাকে পদে পদে বিড়ম্বিত করিবার প্রয়াস করেন, কিন্তু বাহিরে খোলা মঞ্চে তিনি কিছুই বলেননা, বরং জাত-পাত অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার বলিয়া দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেন। আবার ‘মন্ডল’ বা ‘কিসকু’ পদবীর কোন অফিসারকে তাহার মুখার্জী বা চক্রবর্তী কর্মচারীগন ভিতরে গিয়া ‘স্যার স্যার’ করিলেও, তাহার যতই যোগ্যতা থাকুক না কেন, বাহিরে আসিয়া গালাগালি করিয়া বলেন, মালটা রিজার্বেশানেই এত উঁচুতে উঠিয়াছে। এই যে ভিতর ও বাহিরে দ্বৈত সত্তা, চিন্তাধারার ভিন্নতা, এই ভিন্নতা তাহার জীবনযাত্রায়, তাহার কর্মে, তাহার ঘরোয়া বানীতে এবং অবশ্যই সাহিত্য রচনায় প্রতিফলিত হয়। বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শে প্রভাবিত সাহিত্যিক যেমন তাহার সাহিত্যে তাহার রাজনৈতিক দলের পরোক্ষ গুনগান করিবেন, প্রকৃত সত্য না বলিয়া ছয়কে নয় করিবেন, তেমনি বিশেষ ধর্মের লোকেরাও সাহিত্যেও প্রকৃত সত্য না লিখিয়া তাহার ধর্মের গুনগান করিবেন। প্রকৃ সত্য চাপা পড়িয়া যাইবে। একই ভাবে মনে পদবী বা জাতপাতের ঘৃণা থাকিলে তাহার রচিত সাহিত্যেও অবশ্যই তাহার প্রতিফলন ঘটিবে। ইহা মানুষের ধর্ম। বর্তমান সমাজে বুদ্ধিজীবি নামধারী ব্যক্তিগন ইহার জ্বলন্ত প্রমান। তাহারা কখনও মুখে কুলুপ আটেন, আবার কখনও রাজপথ কাঁপাইয়া গলা ফাটান। কাজেই সমাজের উচ্চস্থানে বসিয়া নীচের দিকে তাকাইয়া আধখানা দেখিয়া প্রকৃত স্বরুপ উপলব্ধি করা যাইবে না। যদিওবা যায়, তাহাতে অনেকখানি ময়াম মিশাইয়া বেশ কুড়মুড়ে করিয়া পরিবেশন করা হইবে। যাহাতে পাবলিক খায়, খাইতে ভাল লাগে। কোন্ পাঠক আর সময় নষ্ট করিয়া, বঞ্চিত জীবনের ঘ্যানঘ্যানানি শুনিতে বা পড়িতে চাহিবে? বরং শবররা চুরি করে, ইহাই ধ্রুবসত্য ধরিয়া তাহাদের চুরি করার অদ্ভুত নতুন কায়দা লইয়া একটি জমপেশ উপন্যাস লিখিতে পারিলে লক্ষ্মীলাভ হইবে। এমনকি সিনেমাও হইতে পারে। কে কোথায় চুনী কোটাল মরিল, কেন মরিল, তাহাকে লইয়া লিখিতে গেলে ‘কেচো খুড়তে কেউটে’ বাহির হইয়া আসিবে, তাহাতে আমাদের গোত্রের লোকেদেরই বদনাম হইবে। কি দরকার? বরং এমত অবস্থায় বুদ্ধিজীবি সাহিত্যিক হইয়া মুখে কুলুপ আটিয়া থাকা ভাল। অন্য সময় দ্বিগুন উৎসাহে চীৎকার করা যাইবে। মঁরিচঝাপিতে রাষ্ট্রীয় গনহত্যার বিরুদ্ধেও কুলুপ আটা ভাল, মরিয়াছে তো কিছু ন্যাংটো, পুঁটুলী আর ঝোলা কাঁধের ছোটজাতের জঞ্জাল মানুষ, তাহাতে এত চীৎকারের কি আছে? ইহা কি কোন সাহিত্যের বিষয় হইল? বরং রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরীর চিঠি বিনিময় লইয়া রসালো গল্প লিখিলে কিছু কাঞ্চনের আগমন হইবে, আরও দুই পেগ লইয়া গ্রান্ডে বসিয়া মৌত করা যাইবে। কাগজে কাগজে পরিচিতদের বলিয়া দুই কলাম ‘বুক রিভিউ’ লিখাইয়া দিলে তো কথাই নাই! সেখানে ও মামা দাদা স্বজাতির অভাব নাই। তখন ব্যাঙ্কের পাশবইয়ের পাতা ভারী হইবে। ইহাই সত্য, ইহাই সাহিত্য, প্রকৃত সাহিত্য। সাহিত্যের আবার ভাগ হয় নাকি! দলিত সাহিত্য আবার কি?
অর্থাৎ সাহিত্য রচনা, প্রকাশ, এবং বিপনন। এই কয়েকটি ধাপ সঠিক ভাবে সঠিক পন্থায় পার হইতে পারিলেই প্রতিষ্ঠা পাওয়া যাইবে। রচনা উৎকৃষ্ট বলিয়া গন্য হইবে। ঘরে কড়ি আসিবে। মঞ্চে অঞ্চে ডাক আসিবে, বিদেশ গমনের বাসনা পূর্ণ হইবে। প্রকৃত জীবনের কথা বলা হউক বা না হউক, ইহাই সত্য বলিয়া গন্য হইবে। সাহিত্য বলিয়া প্রতিষ্ঠা পাইবে, বলা যায় না চীরকালীন সাহিত্যের ভান্ডারে কোন একদিন ইহার স্থানও হইতে পারে। আর এই আলোর জৌলুসের নীচে প্রকৃত সত্য চিরকালের জন্যে চাপা পড়িয়া থাকিবে।
মোদ্দা কথা কি দাঁড়াইল? সাহিত্য রচনা করে সাহিত্যিকের মন, তাহার চিন্তাধারা, ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্বাস। এই সত্য অস্বীকার করিবার উপায় নাই। বৈদিক সাহিত্য মানেই দেব-দেবীর আরাধনা, তাহাদের মাহাত্য প্রকাশ। বৌদ্ধ সাহিত্যে, তাহার সুপ্তি ও নিকায় গুলোতেও বুদ্ধের গুনগান বা কীর্তির প্রকাশ, পরবর্তীতে বৈষ্ণব সাহিত্যও রাধা-কৃষ্ণময়।
বেদ রচনাকালে সমাজের বর্ণবিভাগ এত তীব্র ছিল না। মনু সংহিতা হিন্দু ধর্মের যে পেনাল কোড রচনা করিল, একাদশ শতকে শঙ্করাচার্য্য যে বিধান চালু করিলেন, তাহাতে নীঁচু জাতের লেখা, পড়া, এমনকি শোনাও বন্ধ করিয়া দেওয়া হইল। ফলে তখনকার শুদ্র, তথা এখনকার দলিতদের জীবনযাত্রা একেবারে শুণ্যের নীচে নামিয়া গেল। বাঁচিয়া থাকাটাই কষ্টকর হইল। অক্ষরজ্ঞান, লেখা-পড়া শেখা তাহাদের কল্পনার অতীত হইল। সাহিত্য রচনা তো কল্পনায়ও আসে নাই। দীর্ঘকাল এই প্রথা চলিতে চলিতে ইহা তাহাদের একেবারে মজ্জায় এবং সম্ভবতঃ জিনে ঢুকিয়া গেল। তাহাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় থাকিলেও সকল ইন্দ্রিয় অবশ হইয়া গেল। তাহাদের মস্তিস্ক থাকিলেও সেই মস্তিস্ক চিন্তা ও বিচার করিতে ভুলিয়া গেল, এবং প্রতিবাদের মত শব্দ ‘সমাজ’ নামক জন্তর-মন্তর ঘর তাহাদের মস্তিস্ক হইতে ডিলিট করিয়া দিল। এই একবিংশ শতাব্দীতেও সেই ঘোর কাটে নাই।
পরবর্তী কালে অবস্থার পরিবর্তন ঘটিল সময়ের পরিবর্তনের সাথে। কিন্তু ইহাও সঠিক কথা নহে। বাংলা সাহিত্যের জন্মলগ্ন হইতে কিছুকাল পরে পর্যন্ত কোন শুদ্র বা নীচু সম্প্রদায়ের সাহিত্যিকের দেখা পাওয়া যায় কি? না। কারণ সেই সময়েও এই নীঁচু অবস্থানের লোকের সামাজিক অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয় নাই। মানষিকতার পরিবর্তন কখনও হঠাৎ ঘটে না। সময়ের সাথে সাথে জিরাফের গলার মত ইহাও একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম যতোই প্রগতিশীল হউক, জাতপাত লইয়া, এই নীম্ন বর্গের লেখাপড়া লইয়া কে কতটা সরব হইয়াছে? ওই সময় হইতে তাহারা অনেকটাই আগাইয়া থাকিলেও শুদ্র-শিক্ষা লইয়া তাহারা ভাবিবার প্রয়োজন মনে করেন নাই। তাহাদের রচনায়ও তাই দলিত জীবন নাই। আরও পরে রবীন্দ্রনাথও স্বীকার করিয়াছেন, তাহার লেখনী ‘হয় নাই সর্বত্রগামী’।
যদিও সমাজ তখন বেদ শুনিলে আর শুদ্রদের কানে শিশা গলাইয়া ঢুকাইয়া দেওয়ার অবস্থায় নাই, তবুও তাহাদের শিক্ষার দিকে কাহারও নজরও ছিল না। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় কেহ কেহ তখন ব্যক্তিগত শিক্ষা আন্দোলন শুরু করিয়াছেন বটে। যেমন জ্যোতিরাও ফুলে ও সবিত্রীবাই ফুলে, গুরুচাঁদ ঠাকুর, বাবাহাসেব আম্বেদকর। ইহারাই শুদ্র-শিক্ষা তথা দলিত শিক্ষার পথিকৃত।
সংখ্যাজ্ঞান এবং অক্ষরজ্ঞান যখন ঘটিল, তখন অনেকের মস্তিস্কের ঘুমাইয়া থাকা প্রকোষ্ঠগুলান একে একে খুলিতে লাগিল। সংখ্যা জ্ঞান লাভ লোকসানের হিসাব করিল, অক্ষর জ্ঞান দোষ-গুন বিচার শুরু করিল। হিসাবে বড় বড় গরমিল এবং গোঁজামিল দেখা দিল। তাকাইয়া দেখা গেল, হিসাব রক্ষক হিসাবে পুরা সমাজটাই ইচ্ছাকৃত ভাবে এই গরমিল ও গোঁজামিলে ইতিহাস ভরিয়া রাখিয়াছে। দুঃখ হইল, রাগ হইল, পঞ্চ ইন্দ্রিয় সজাগ হইয়া উঠিল। বলিয়া উঠিল, Educate, Agitate, Organize. শুরু হইল প্রতিবাদ। সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সামাজিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সামাজিক শোষনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এবং এই প্রতিবাদের অন্যতম হাতিয়ার হইল লেখনী। যে লেখা কোনও দিন কোনও ব্রাহ্মন্য বা শোষক শ্রেনীর কলম লিখিবে না। এই লেখা একমাত্র শোষিত শ্রেনীর প্রতিনিধিই লিখিতে পারিবে। তাহার নিজের কলমে, নিজের কথায়, নিজের ভাষায় নিজের অনুভুতি একমাত্র তিনিই প্রকাশ করিতে পারিবেন। প্রথমেই তাহা না হইল সুললিত কাব্যিক, থাকিল না হয় দুই চারিটা ব্যকরনগত ভুল-ত্রুটি, যাহা নিরন্তর অনুশীলনের মাধ্যমে একদিন প্রথম শ্রেনীর সাহিত্যে উন্নীত হইবে, তবুও তাহার নিজের কলমে, নিজের কথায়, মনের ভাব প্রকাশ, কলমে মনের আগুন ছিটানো- ইহাই দলিত সাহিত্য।
‘পথ সংকেতে’র অক্টোবরের সাহিত্য সভার আলোচক, বিশিষ্ট দলিত সাহিত্যিক শ্রী শ্যামল কুমার প্রামানিক যথার্থই বলিয়াছেন, দলিত সাহিত্য রচনা করিতে হইলে পথে নামিতে হইবে। পথে মানে রাজনৈতিক ঝান্ডা হাতে মিছিল নহে। পথে মানে দলিত জীবনের পথে, দলিত সাহিত্য আলোচনার পথে, দলিত সাহিত্য সভার পথে। জানিতে হইবে আমাদের বঞ্চনার ইতিহাস, আমাদের অতীতের ঐতিহ্য, আমাদের সমাজের লোকের বর্তমান অবস্থা। তবেই সাহিত্যের মাধ্যমে আমরা প্রকৃত সত্য তুলিয়া ধরিতে পারিব।
সমাজের উচ্চ শ্রেনী এখনও তাহাদের নখ-দাঁত কাটিয়া ফেলে নাই, আস্তিনের নীচে লুকাইয়া রাখিয়াছে মাত্র। না হইলে অধ্যাপক মেরুনা মুর্মুকে এই কিছুদিন আগেই দলিত বলিয়া অপমানিত হইতে হইত না। রোহিত ভেমুলাকে মৃত্যবরন করিতে হইত না।
ইংরাজীতে একটি কথা আছে ‘Pen is mightier than sword’ । অর্থাৎ কলম তরবারী অপেক্ষাও শক্তিশালী। ইহা মনে রাখিতে হইবে। মনে রাখিতে হইবে সামাজিক মুক্তির অন্যতম হাতিয়ার সাহিত্য বা লেখনী। সেই লেখনী নামক তরবারিকে ধার দিতে হইবে। তীব্র নিনাদ ছাড়িতে হইবে। মতুয়াদের ডঙ্কা ও শিঙ্গার মত আকাশ-বাতাশ কাঁপাইয়া সাহিত্যে হুঙ্কার ছাড়িতে হইবে। যাহারা এখনও সমাজ সচেতন নহে, তাহাদের সচেতন করিতে হইবে, যাহারা ঘুমাইয়া আছে, তাহাদের জাগাইতে হইবে। লেখক সৃষ্টি করিতে হইবে, লেখনীর মান উঁচু করিয়া এমন করিতে হইবে, যেন পাঠকের বুকে শেল বেঁধে। সে যন্ত্রণায় ছটফট করিতে থাকে, আর তারপর নিজেও এক সময় এই দলিত সাহিত্য আন্দোলনের শরিক হয়।
বিশ্বের এবং ভারতের প্রেক্ষাপটে দলিত সাহিত্য জাগিয়া উঠিয়াছে। প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় এই সাহিত্যকে মান্যতা দিয়া তাহাদের পাঠ্যসূচীতে স্থান দিতে বাধ্য হইয়াছে। অনেক নতুন প্রজন্ম এই সাহিত্যের বিষয় লইয়া তাহাদের ডক্টরেট করিয়াছে এবং করিতেছে। চলমান সাহিত্যের পেলব শরীরে কামড় বসাইয়া দলিত সাহিত্য আপন ক্ষমতায় তাহার স্থান করিয়া লইয়াছে। রাজনীতির কথা ছাড়িয়া দিয়াই বলি, এই কারণেই পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘বাংলা দলিত সাহিত্য একাডেমি’ গঠন করিতে বাধ্য হইয়াছে।
তবে মনে রাখিতে হইবে, এই সাহিত্যের যাত্রাপথ পুস্প বিছানো পথে নহে। যেমন আগেই বলিয়াছি, এই সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা এবং মান লইয়া অচিরেই ইহাকে ধ্বংশ করিবার প্রচেষ্টা হইয়াছে, ইহার প্রচার ও বিপনন লইয়াও বাঁধা আছে এবং বাঁধা আসিবে। মনের দৃড়তা, সাহিত্যের গুনগত মান এবং স্থির সংকল্প থাকিলেই সব বাঁধা অতিক্রম করা সম্ভব হইবে। হইবেই। আর এই সব অর্জন করিতে হইলে দলিত সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে থাকিতে হইবে। পড়িতে হইবে, লিখিতে হইবে, জানিতে হইবে, আলোচনা- সমালোচনায় উপস্থিত থাকিতে হইবে।
সুখের কথা, বর্তমান বাংলা সাহিত্যে কিছু নিবেদিতপ্রান দলিত সাহিত্যিক আছেন। কিছু সাহিত্য চর্চা ও প্রচার প্রসার সংস্থাও আছে। আছে ‘পথ সংকেত’, ‘বাংলা দলিত সাহিত্য সংস্থা’। ‘গাঙচিল’ প্রকাশনা সংস্থাও অনেক দলিত পুস্তক প্রকাশ করিয়াছে ও করিতেছে। আরও আছে। অনেক পত্রিকাও আছে। তাহারা নিরলস প্রচেষ্টা করিতেছেন দলিত সাহিত্যের উন্নতি ঘটাইতে।
একথা অনস্বীকার্য্য, সৃষ্টি এং সময়ের গতিপথকে কেহই রদ্ধ করিতে পারে না। ভারতবর্ষের বেশির ভাগ লোকই দলিত সম্প্রদায় ভুক্ত। এতদিন সুযোগ এবং বঞ্চনার অভাবে তাহারা তাহাদের কথা বলিতে পারে নাই, মনের ভাব প্রকাশ করিতে পারে নাই। আজ যদি আত্মনিবেদিত লেখনীর মাধ্যমে তাহারা সেই পথে অগ্রসর হয়, তবে এই দলিত সাহিত্যই বিশ্বসাহিত্যে এবং ভারতীয় সাহিত্যে অচিরে প্রধান সাহিত্য রুপে পরিগনিত হইবে। এখন মাটি হারানোর ভয়ে অনেকেই আতঙ্কিত হইলেও সময়ের দাবি রুদ্ধ করিবার ক্ষমতা তাহাদের নাই।