অসিত বিশ্বাসের গল্পঃ কলা বিভাগ

কলা বিভাগ

সেদিন শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। বারো বছরের পুত্র উষ্ণীষ ও স্ত্রী শ্রীময়ীকে নিয়ে উদ্ধব বালা রেস্তোরাঁতে যাওয়ার জন্য রওনা হয়েছে। টোটো ধরার জন্য সড়ক সংলগ্ন সদনের সামনে সপরিবারে অপেক্ষা করতে থাকে উদ্ধব। কয়েক মিনিট পর আধো আলো আঁধারে দেখা গেল স্টেশনের দিক থেকে একটা টোটো আসছে। একজন লোক বসেও আছে। শারীরিক ভাষায় মনে হল লোকটা যেন এখনই নামবে। হ্যাঁ, লোকটা নীচে থেকে একটা ব্যাগ তুলল। টোটো এসে থামল তাদের বাড়ির সামনেই। উদ্ধব অবাক, কিছুটা অপ্রস্তুতও। যাত্রীটি তারই বাবা, উপেন বালা; বাম হাতে কাপড়ের দোকান থেকে পাওয়া বহু পুরোনো একটা ব্যাগ, ডান হাতে বেশ বড় এক ছড়া পাকা বিচে কলা।

টোটো থেকে নেমেই এক গাল হেসে উষ্ণীষের দিকে বিচে কলার ছড়াটি বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “দাদা, আমাদের বাড়ির গাছের কলা; একেবারে গাছপাকা। ভাবলাম, কয়টা নিয়ে যাই, সবাই মিলে ভাগ করে খাই।“ বিরক্তির চোখে শ্রীময়ী তাকালো উদ্ধবের দিকে। অপ্রস্তুত, উৎকণ্ঠিত উদ্ধব উদ্ভুত উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করল, “অত দূর থেকে এই সব বয়ে আনার কী দরকার ছিল, বাবা? তাছাড়া জানোই তো এই সব কলা আমরা…। চল, ভিতরে চল।

“ রেস্তোরাঁতে যাওয়া স্থগিত রইল। শ্রীময়ীর মুখমণ্ডলের শশীকলার শ্রী যেন বিচে কলাসমেত উপেনের উপস্থিতিতে উবে উধাও হয়ে গেল। সহসা মনে পড়ল, স্কুলের অনেক খাতা দেখা বাকি। পাশের ঘরে প্রবেশ পূর্বক প্রকৃষ্টরূপে পরীক্ষকের কাজে পরিপূর্ণ মনোনিবেশ করল।

উদ্ধব ও শ্রীময়ী দু’জনেই একটি হাইস্কুলে পড়ায়। সম্পূর্ণ নিজেদের ক্ষমতায় জেলা শহর কৃ্ষ্ণনগরে দুই কাঠা জমির উপরে একতলা বাড়ি করেছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্রও বসিয়েছে। ভোগবাদের যুগে যা কিছু ক্ষমতায় কুলোয় তার প্রায় কোন কিছু বাকি রাখেনি উদ্ধব ও শ্রীময়ী। শুধু একটি গাড়ি কেনাই বাকি। বাড়ির লোন শোধ হয়ে গেলে তাও কিনবে। উদ্ধবের মতে, জীবন তো একটাই, ক’টা দিনই বা তার মেয়াদ; একটু ভোগ করে যাওয়াই ভালো। তাছাড়া শ্বশুরবাড়ি বড়লোক। তাঁরা মাঝে মাঝে আসেন। তাঁদের তো একটা সম্মান আছে। সপ্তাহে প্রায় প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় উদ্ধব সপরিবারে নামি-দামি রেস্তোরাঁতে যায়। শনিবার রাতে বাড়িতে রান্না বন্ধ।

ফেরার সময় একটি হাফ পাউন্ড পাউরুটি ও দুই হালি মর্তমান কলাও নিয়ে আসতে হবে; কয়েকটা কাগজের থালাও। কেননা, রবিবারে মেথর পাড়ার পঞ্চা টয়লেট পরিষ্কার করতে আসে। আগের দিনের বাসি খাবার ওকে দিয়ে দেওয়া হয়। মেথর মানুষ, ওকে তো নিজেদের থালায় বা ডাইনিং রুমে খেতে দেওয়া যায়না। রবিবার সকালে ব্রেকফাস্ট হয় পাউরুটি, মাখন আর কলা দিয়ে। অন্যদিন ব্রেকফাস্টের প্রশ্ন ওঠেনা, কারণ তিনজনকেই সকাল সকাল ভাত খেয়ে স্কুলে ছুটতে হয়। উষ্ণীষ মর্তমান কলা ছাড়া খায়না। উদ্ধবও অন্য কোনও কলা কোনদিন কেনেনা। কারণ চিরাচরিত দেশি কলা দেখতে বড় হলেও, বা এক ছড়াতে সংখ্যায় অনেক বেশি হলেও তার মধ্যে অনেক বীজ থাকে; ফলে খাদ্যগুনযুক্ত পদার্থ তাতে কম। তাছাড়া ঐ রকম অর্ধচন্দ্রকলাকৃতি কদাকার কদলী কিনে হাতে করে আনাটাই হাস্যকর, সম্মানহানির ব্যাপারও বটে। বড় জোর মোচা কিনে আনা যায়, কেননা মোচা তার কদাকার জাতের বৈশিষ্ট্য বহন করেনা।

বাবুদের বিচারে বিচে কলা প্রজাতিটা অনেকটা ভারতবর্ষের নিম্নবর্গের মানুষের মতন— সংখ্যায় বা কলেবরে বড়, কিন্তু তাতে কৌলীন্য বা কার্যকারিতা কম। বিচে কলার গাছগুলিও তেমনি। বনে-বাদাড়ে, আনাচে-কানাচে এমনিতেই জন্মায়, সার-ওষুধ লাগেনা, পরিচর্যার জন্য মালীরও দরকার নেই।

তবুও এর বংশ ধ্বংস হতে চায় না। অবশ্য ভালো উঁচু, উর্বর জমিতে এদেরকে সচরাচর জন্মাতে দেখা যায় না। দেখা দিলেই সমূলে বিনাশ করা হয়, অন্য ভালো জাতের গাছগুলিকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য। ফলে উন্নত জায়গা দখল করার সাহসটাই যেন নেই এই প্রজাতির। দুই একটা কলা গাছকে অবশ্য বড়লোক বাবুদের বারান্দায় বনসাইরূপে শ্রীবৃদ্ধি করতে দেখা যায়। তাদের বেশি বাড় বাড়ন্ত বা বংশ বৃদ্ধি বারণ। কতটা বড় হতে হবে, কোন দিকে পাতা, পল্লব প্রসারিত হবে, তা প্রভুদের পছন্দ অনুযায়ী

2

পরিচালিত হয়। স্বজাতির সাথে সম্পর্ক সারা জীবনের মতন ছিন্ন। এই ভাবে কলার বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে বেশ কিছু বিভাজন আছে। স্বাধীন বিচে কলা গাছ বাবু-বিবিদের চোখের বালি হলেও এর মোচা বেশ প্রিয়। ছোট বেলা থেকে কলেজ জীবন পর্যন্ত কোনদিন ভালো খাবার মুখে স্পর্শ করতে পারেনি উদ্ধব। তার বাবা উপেন নিজের মা ও ভাইকে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে আসে, পরিবারের গুরুদেবের সাথে। নগদ টাকাপয়সা ও সামান্য সোনা-রুপো যা ছিল তা গুরুদেবের পরামর্শে তারই ঝোলার নিরাপদ প্রকোষ্ঠে রাখা হয়; তাহলে কেউ তা নিয়ে নিতে পারবে না। গুরুদেবের গুরুত্বপূর্ণ গুরুবাক্য গুরুতরভাবে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। তা সত্যিই কেউ নিতে পারেনি, উপেন বা তার পরিবারের কেউও না। যে আশ্রমে গিয়ে সময়মত সেগুলি সংগ্রহ করে আনার কথা, সেখানে গিয়ে জানা গেল, গুরুদেব নাকি সন্যাস নিয়েছেন। শিষ্যদেরকে পার্থিব প্রলোভন পরিত্যাগের পাঠক্রমের প্রাক্টিক্যাল প্রশিক্ষণ প্রদান পূর্বক মায়ার সংসারের সাথে সমস্ত সংস্রব স্বয়ং সম্পূর্ণ সমাপ্ত করেছেন গুরুদেব।

তার পরের কয় বছরের বিস্তারিত বৃত্তান্ত নিতান্তই নিষ্প্রয়োজন। গুরুর কাছে ত্যাগের গুরুতর গুঢ় শিক্ষা হাতে কলমে, হাড়ে হাড়ে লাভ করে উপেন ও তার ভাই এখন পরের বাড়ির বা ক্ষেতের দিনমজুর। মানসম্মান, লজ্জা-ঘৃণা, ব্যথাবেদনা— সব ত্যাগ করেছে। আর একটি জিনিস ত্যাগ করেছে উপেন, তার ধর্মবিশ্বাস, আস্তিকতা, যে পরিচয়ের জন্য তার পরিবারকে পূর্ব পাকিস্তান পরিত্যাগ করে ভারতে আসতে হয়। উদয়স্ত ঘাম ঝরিয়ে নিজের আয়ের সিংহভাগ ব্যয় করেছে পুত্র উদ্ধবের জন্য। সেই সিংহভাগের বহর এমনই যে উদ্ধবকে কোনদিন প্রাইভেট ট্যুইশন দিতে পারেনি, বড়লোকদের মতন ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াতে পারেনি, নতুন বইও কিনে দিতে পারেনি, পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে বই কিনতে হয়েছে, বা উপরের ক্লাশের কারও কাছ থেকে চেয়ে নিতে হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমি সংস্কারের পর দেড় বিঘা জমি পেয়ে যেন হাতে চাঁদ পেল উপেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে কয়দিন ধরে সারাদিন খেটে বেনাবন নির্মূল করে চাষযোগ্য জমি বানিয়ে ফেলল উপেন। সেখানে সব্জী চাষ করতে লাগল। স্থানীয় বাজারে সব্জী বিক্রি না করে শিয়ালদহ কোলে মার্কেটে নিয়ে যায় উপেন। যেদিন সব্জী কম হয় সেদিন অন্য চাষিদের কাছ থেকে কিনে ঝুড়ি ভর্তি করে। ভেন্ডার কম্পার্ট্মেন্টে ঝুড়ি তুলে দিয়ে যাতায়াতের সময়টাতে ট্রেনে বাদাম বিক্রি করে। আর্থিক অবস্থার সামান্য উন্নতি ঘটল। কিন্তু তবুও ছাত্রজীবনে উদ্ধবেরও কোনদিন কোন বিশেষ বিলাসিতার বাতুলতা দেখা যায়নি। মন দিয়ে পড়াশোনাই করে গেছে শুধু।

বি.এ. পাশ করে স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় সফল হয়ে স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পায় উদ্ধব। শ্রীময়ীও প্রায় একই সাথে যোগদান করে ঐ স্কুলেই। একদিন স্কুলের সহকর্মী সায়ন্তন সেন শর্মার সাথে শ্রীময়ীর সামান্য মতভেদ হওয়ায় ওবিসি কোটায় চাকরি পেয়েছে বলে শ্রীময়ীকে মিসরির ছুরির মতন বিশ্রী কথা শুনিয়ে দেন সায়ন্তন। সেদিন একমাত্র উদ্ধবই শ্রীময়ীর পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিল। অন্য তপশিলি বা ওবিসি শিক্ষকরা সেই মুহূর্তে মিলিতভাবে ম্রিয়মাণ হয়ে মৌনব্রত পালন করেছিলেন। এই ঘটনার পর থেকে উদ্ধব ও শ্রীময়ীর বেশ ঘনিষ্ঠতা হতে থাকে। তার ফলে তাদেরকে এক সাথে দেখলেই কিছু সহকর্মীর মাঝে মাঝেই চোখ ঠারাঠারি হতে শুরু করল।

শ্রীময়ী শান্তিপুরের বর্ধিষ্ণু বস্ত্রব্যবসায়ী বসাক বাড়ির কন্যা। আর গেঁয়ো নমশূদ্র পরিবারের ছেলে উদ্ধব। তাদের একে অপরকে ভালো লাগলেও শ্রীময়ীর বাড়িতে বেশ আপত্তি উঠেছিল, তন্তুবায়ী পরিবারের সাথে নিচু নমশূদ্রের পরিবারের বিয়ে! কিন্তু তাদের নিজেদের ঘনিষ্ঠতার ফলে বিয়ের আলোচনার সময় জাতের প্রসঙ্গ খুব বেশি গুরুত্ব পেলনা। তাছাড়া এক আত্মীয় বলেছিল যে আজকাল আর এসব কেউ দেখেনা। ছেলেটা ভালো— এটাই যথেষ্ট। আর ও তো বেথুয়াডহরির গণ্ডগ্রামে মা-বাবার সাথে থাকতে যাচ্ছে না। ফলে শুভ কর্মটি সুষ্ঠুভাবে সমাপ্ত হয়ে গেল।

3

বিয়ের পর শ্রীময়ী বা তার বাবার বাড়ির লোকজন কদাচিৎ উদ্ধবের বেথুয়াডহরির বাড়িতে বেড়াতে গেছে। কিন্তু মাঝে মাঝেই শহরের বাড়িতে উপেনের উটকো উপস্থিতি শ্রীময়ীর শ্রীমুখে শ্রীহীন বিরক্তির চিহ্নের উদ্রেক করে। উদ্ধব ভালো ছেলে, তাকে নিয়ে সংসার করা যায়। তাই বলে ঐ গেঁয়ো বাবা-মাকে…! কী করে সইবে, বুঝতে পারেনা শ্রীময়ী। লোকটা বসে বসে বিড়ি খায়, গায়ের জামা কোনদিন ধোপার বাড়ি যায়নি, ফুটি-ফাটা পায়ের জুতোর চামড়ার দিকে তাকালে রাস্তার কুকুরেরও অজীর্ণ রোগ হয়। উদ্ধব যে এক সেট জামা-প্যান্ট, জুতো কিনে দিয়েছে সেগুলিকে উপেন যক্ষের ধনের মতন মান্ধাতার আমলের মরচেধরা তোরঙ্গতে তুলে রেখে দিয়েছে। কোন জন্মে পরবে, কে জানে। আর উদ্ধবের মা! সে এক বিশেষ বিরল বিদঘুটে প্রজাতির প্রদর্শনযোগ্য প্রাণী। মাথায় তাঁত কলের পরিত্যক্ত তন্তুর মতন এক বোঝা যে পদার্থ পাকানো আছে সেটাকে এক সময় কেশরাশি বলা যেত বটে। তেল, সাবান, স্যাম্পুর অভাবে সেই অলকদামের এখন এমন দশা, যেন এঁদো পুকুরের বড় বড় কচুরিপানার দামের গুচ্ছমূল দিয়ে তৈরি পানকৌড়ির পুরোন পরিত্যক্ত বাসা; উকুনেরও উষ্মার উদ্রেক করে। শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে থাকার ধরণ দেখলে মনে হয় যেন শুকনো পাতাবেষ্টিত একটি বিচে কলা গাছ বাংলা ‘য’ ফলার আকার ধারণ করে দন্ডায়মান। মেচেতাযুক্ত মলিন মুখমণ্ডলে মায়ানমারের মানচিত্রের মতন মুদ্রাঙ্কন।

যাত্রাদলের অতিপ্রাকৃ্তিক পালায় পেত্নীর পাটে অভিনয় করতে দিলে মেক আপ ছাড়াই মানাত খুব। সে নাকি একজন হাইস্কুল-শিক্ষিকার শাশুড়ি! ভাবতে পারেনা শ্রীময়ী। সন্ধ্যা বেলায় একটি ঘরে শ্রীময়ীর শ্রীমুখের উপদেশ উপেক্ষা করে উষ্ণীষ উপেনের সাথে গল্পে মশগুল। কৌতূহলী উষ্ণীষের প্রশ্ন, “দাদাই, তুমি বিচে কলা আনতে গেলে কেন? বাড়িতে ভালো কলার গাছ লাগাতে পারনা? আর যদি বিচে কলার গাছ হয় তবে মোচা কেটে নিলেই হয়।”

সহসা উত্তর দিতে পারলনা উপেন। মনটা ফিরে গেল প্রায় চল্লিশ বছর পূর্বে। রেশন দোকান থেকে পাওয়া বিকট গন্ধযুক্ত রেপসিডের তেল দিয়ে মাখা পেঁপে সিদ্ধ দিয়ে রেশনের চালের ফেনা ভাত আধপেটা খেয়ে ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে সেদিন সকাল বেলা লালগোলা প্যাসেঞ্জার ধরে কৃষ্ণনগর পৌঁছোয় উপেন আর তার গ্রামের আরও তিনজন। গ্রামে কাজ নেই। তাই শহরে কাজ করতে যায়। স্টেশন থেকে বেশ কিছুটা হেঁটে লেভেল ক্রসিং-এর কাছাকাছি রাস্তার ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। সেখানে অনেক শ্রমিক জড় হয় সকালে। যাদের কাজের লোক দরকার তারা সেখানে এসে দরাদরি করে শ্রমিক নিয়ে যায়। সেদিন উপেনের পৌঁছাতে বেশ দেরি হয়। ফলে কোন বাবুকে পাওয়া গেলনা। ফিরে আসবে আসবে করছে, এমন সময় একজন বাবুকে দেখা গেল। উদ্গ্রীব হয়ে তাকিয়ে রইল উপেন ও তার সঙ্গীরা। বাবু যেন নেহাত দয়া করছেন, এমন ভাবে কথা শুরু করলেন। ঠিক হল, বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত মাটি কাটতে হবে। মজুরি মাথাপিছু পঁচিশ পয়সা আর পঞ্চাশ গ্রাম মুড়ি। তাতেই রাজি ওরা। পঁচিশ পয়সায় দুটো পাউরুটি বা এক পোয়া আটার দাম তো অন্তত হবে।

সারাদিন কাজ করে মজুরি নিয়ে আবার স্টেশনে এসে প্ল্যাটফর্মে বসে রইল চারজন। খিদেয় নাড়িভুড়িও যেন গলে জল হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ দেখা গেল, অদূরে একজন হকার বেশ বড় বড় বিচে কলা নিয়ে বসে আছে। একটার দাম দশ পয়সা। চারটে নিলে একটা ফ্রী। ওরা চারজন দশ পয়সা করে দিয়ে চল্লিশ পয়সায় পাঁচটি বিচে কলা কিনে ভাগ করে খেয়ে নিল। আহ্, বাঁচা গেল। বেথুয়াডহরি নেমে বাকি পনের পয়সা দিয়ে চেনাশোনা দোকান থেকে এক পোয়া করে আটা নিয়ে যাবে। অনুরোধ করলে দোকানদার দয়া দেখিয়ে হয়ত পনর পয়সা নগদ নিয়ে দশ পয়সা বাকি রাখতে রাজি হবে। মোটামুটি প্রফুল্ল মেজাজেই আছে চারজন। এমন সময় উপস্থিত প্লাটফর্মের ভ্রাম্যমান টি.টি.ই. সাহেব, “টিকিট?”

ওরা চারজন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলো। টি.টি.ই. সাহেবের গম্ভীর গলা আবার শ্রুত হল, “টিকিট দেখি।“ চারজনের মধ্যে উপেন একটু বলিয়ে-কইয়ে মানুষ। সারাদিনের ঘটনা সংক্ষেপে বর্ণনা করল।

তাদের প্রত্যেকের কাছে পনর পয়সা করে আছে, সেটাও প্রকাশ করল। টি.টি.ই. সাহেব ঐ পনর পয়সা পকেটস্থ করে পরিতুষ্ট হয়ে পরিত্রাণ দিলেন প্রাপ্তি স্বীকারপত্র না দিয়েই।

4

তারপর থেকে উপেন বাড়ির আশেপাশে অযাচিতভাবে উদ্ভূত কলার গাছ কোনদিন কেটে ফেলেনি। যে গাছের ফল তার মতন গরিব মানুষকে বাঁচায় তাকে উপেন কাটবে কী করে? ভালো জাতের কলা আর মন্দ জাতের কলার মধ্যে কোন ইতর বিশেষ করেনি উপেন।

উষ্ণীষের কথার সদুত্তর দেওয়ার মতন শহুরে ভাষা উপেনের জানা নেই। অনেক কথায় যা বলার চেষ্টা করল, তার সারমর্ম এই যে, শুধু মোচাটাকে ভালবাসলেই হবেনা, তাকে স্বাধীনভাবে বাড়তে দিতে হবে, আর গাছটাকেও অবহেলা করা ঠিক নয়।

উষ্ণীষের আবার প্রশ্ন, “দাদাই তুমি ভালো জামা কাপড় পরতে পার না? মা যে বলে…।”

এর উত্তর উপেনের জানা। কিন্তু বারো বছরের বালককে বোঝানোর মতন নয়। উপেন যাদের সাথে সকাল থেকে সায়াহ্ন পর্যন্ত হাড় ভাঙ্গা খাটুনি খেটেছে, যাদের সাথে বসে মাইলো-ভুট্টা বা রুটি- ভেলি গুড় বা কলা ভাগ করে খেয়েছে, বাবুদের গালাগালিও এক সাথে হজম করেছে, তারা প্রায় সবাই এখনও দিনমজুর। গ্রামে তাদের সাথেই উপেনের এখনও ওঠা বসা। নিজেকে কী করে তাদের থেকে আলাদা করে বাবু সাজবে উপেন? উষ্ণীষের প্রশ্নের উত্তরে শুধু বলল, “দাদা, তুমি বড় হয়ে কিনে দিও। আমি তখন পরব।“রাত্রে উপেন স্বপ্ন দেখছে। উপেন একটি মর্তমান কলার গাছ লাগিয়েছিল। রাসায়নিক সার কেনার ক্ষমতা উপেনের নেই; তাই বাড়িতে তৈরি জৈব সার দিয়ে অনেক যত্ন করে বড় করেছে। কিন্তু যখন কলাগুলি প্রায় পেকে উঠেছে তখন একদিন সকাল বেলা দেখতে পেল, পুরো কাঁদিটিই চুরি হয়ে গেছে।

দূরের কোন এক অচেনা বাবুদের বাড়ির ডাইনিং টেবিলে রঙ্গিন আলোর নীচে শোভা পাচ্ছে কলাগুলি, যেখানে উপেনের প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু এক একবার মনে হচ্ছে কলাগুলি যেন দেশি রং ত্যাগ করে বিদেশি কলার রং ধারণ করেছে।

ভোর বেলা উপেন বেরিয়ে গেল। উদ্ধব পিতাকে বেরিয়ে যেতে দেখে মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে ঘরের ভিতরে চলে গেল। পঞ্চা টয়লেট পরিষ্কার করে বাড়ির সামনের ফাঁকা মাঠে গাছতলায় বসে একটা পলিথিনের ব্যাগ থেকে মিইয়ে যাওয়া মুড়ি খাচ্ছে আর তার পাশে ঘাসের উপর পড়ে রয়েছে গতকাল উপেনের আনা বিচে কলার পুরো ছড়াটি। উষ্ণীষ পড়ার ঘরে পড়ছে। পরদিন ক্লাশে একটি রচনা লিখে দেখাতে হবে; বিষয়ঃ ‘বাংলার ফলমূল’। শ্রীময়ী ডাইনিং রুমে পোষা কুকুর লাইল্যাককে ব্রেকফাস্ট খাওয়াচ্ছে। অন্য কুকুরের সাথে তাকে মেলামেশা করতে দেওয়া হয়না। জানলা দিয়ে অন্য কুকুর দেখে লাইল্যাক সেদিকে ছুটে গিয়ে ঘেউ ঘেউ করে উঠল। তাকে মৃদু ভর্ৎসনা করে শাসন করা হল। এত ভালো ঘরে থেকে ও এত ভালো ভালো খাবার খেয়েও লাইল্যাকের কেন যে অন্য কুকুরদের প্রতি এত টান, শ্রীময়ী বুঝতে পারেনা। ডাইনিং রুম থেকে এসে শ্রীময়ী উষ্ণীষের পাশে বসে বিভিন্ন ফলের ফলনের সময়, স্থান ও উপকারিতা বুঝিয়ে দিচ্ছে। উষ্ণীষের মুখস্থ হয়ে গেল। তারপর একটি কবিতা, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘মেথর’। উষ্ণীষ বেশ ঢুলে ঢুলে তালে তালে সুর করে পড়ছে, “কে বলে তোমারে বন্ধু, অস্পৃশ্য অশুচি? শুচিতা ফিরিছে সদা তোমার পিছনে…।“ প্রায় মুখস্থ হয়ে এসেছে। শ্রীময়ী কবিতাটির মর্মার্থ সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিল। পড়া শেষ করে ওঠার আগে উষ্ণীষ হঠাৎ প্রশ্ন করল, “মা, দুটো জিনিস আমি বুঝতে পারলাম না।”

“কী?”

“মানুষ ফলকে এত ভালোবাসে, কিন্তু গাছকে ভালোবাসেনা কেন? আর আমরা বইয়ে পড়ি যে নিচু জাতকে ঘৃণা করা উচিৎ নয়, কিন্তু পঞ্চাকে আমরা বাড়ির বাইরে খেতে দিই কেন?”

নব্যযুগের নবীনা নারী নিমেষে নিস্প্রভ, নতমস্তক, নিরুত্তর।

জানালা দিয়ে উদ্ধব দেখতে পেল, বাইরে পঞ্চা মিইয়ে যাওয়া মুড়ি খেয়েই চলেছে, তার পাশে একটি উচ্ছ্বিষ্টলোভী কুকুর বসে। আর উদ্ধবের উৎস উপেন উজান গাঙের নৌকার মতন অতি ক্লেশে ধীরে ধীরে গ্রামের দিকে চলেছে, পথ যেন শেষ হতে চাইছে না।

5

ভিতরে শ্রীময়ী-উদ্ধবের উত্তরপুরুষ উষ্ণীষ উন্মূখ হয়ে উত্তরের আশায় যেন এক দৃষ্টে তাকিয়েই

রইল।

আপনার কেমন লাগলো?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 4

No votes so far! Be the first to rate this post.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *