শিক্ষা

শিক্ষার অধিকার ও অনুন্নত শ্রেনীর শিক্ষার প্রতিবন্ধকতাঃ অতীত ও বর্তমান

শিক্ষার অধিকার ও অনুন্নত শ্রেনীর শিক্ষার প্রতিবন্ধকতাঃ অতীত ও বর্তমান

অতুল কৃষ্ণ বিশ্বাস, আই.এ.এস

গ্রামীণ ছাত্রছাত্রীদের রাজ্য উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উজ্জ্বল সাফলদের কবিতাটা এককালে শোনা যেত,

“ইহাদের করো আশীর্বাদ,

ধরায় উঠিছে ফুটি ক্ষুদ্র প্রাণগুলি,  নন্দনের এনেছে সংবাদ ।

এই হাসিমুখগুলি             হাসি পাছে যায় ভুলি,

পাছে ঘেরে আঁধার প্রমাদ,

ইহাদের কাছে ডেকে       বুকে রেখে, কোলে রেখে,

তোমরা করো গো আশীর্বাদ।”

[-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]

এক বছর পূর্বে তৎপর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ বোর্ড তাদের বাড়ীর বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দিয়েছিল; কারণ পরিবার আর্থিক অনটনের কারণে বিল মেটাতে পারেনি। অভাবের সংসারে অন্ধকার সাথী অভাবিত নয়। কিন্তু অর্পিতা মণ্ডলকে অন্ধকার ভীত বা আতঙ্কিত করতে পারেনি। হয়ত তাঁর জেদ এবং প্রতিজ্ঞাকে আরো উসকে দিয়েছিল।

আজকের সংবাদপত্রে [১১ জুন ২০২২] পড়েছি, ৪৯৫ নম্বর পেয়ে বাঁকুড়ার সোনামুখীর পাথরমোড়ার হাই স্কুলের কলা বিভাগের ছাত্রী অর্পিতা মণ্ডল উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান দখল করেছে। পরিবারের অভাবের ফলে বাড়ীতে ব্যাপ্ত আঁধারের উত্তরটা পরীক্ষার খাতায় লিখে এসেছিল। অন্ধকার পেরিয়ে আলোর সামনে দাঁড়িয়েছে অর্পিতা।

মেধাবী ছাত্র সোমনাথ পাল  অভাবের সংসারে মায়ের সঙ্গে বিড়ি বাঁধা, ছাগল চরানোর ফাঁকে পড়ে এই একই পরীক্ষায় পঞ্চম স্থান দখল করেছে; সে বাঁকুড়ার গোয়েঙ্কা বিদ্যায়তনের ছাত্র।  উচ্চমাধ্যমিকে সাফল্যের নিরীখে গ্রাম বাঙলার জয়জয়কার। চতুর্থ দুনিয়ার পক্ষ থেকে অর্পিতা, সোমনাথ, আরও অন্যান্য সফলদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।

একদা গ্রামে স্কুল কলেজের নামে আমাদের সুশীল সমাজের কুশীলবগণ ভিমরি খেতেন। গ্রামীণ পরিবারের ছেলেদের খেত খামারে কাজ করা, গরু চরানো, মাথায় বোঝা বয়ে হাটে বাজারে ধান, চাল, খেতের শাক-সব্জি বেচতে নিয়ে যাওয়া মোটেই অভাবনীয় ব্যাপার নয়। ল্যাম্পের আলোয় রাত জেগে পড়া এবং পরীক্ষা পাশ গ্রাম জীবনের অনেক পরিচিত দৃশ্য। শহর এ সব খোঁজ রাখেনা তাই সংবাদের শীর্ষে উঠে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।

সফল ছাত্রছাত্রীদের আবার অভিনন্দন জানাচ্ছি।  তাদের প্রতিকুল পরিস্থিতির সামনে মাথা না নোয়ানোর সাহস এবং নির্ভীক মানসিতার অকুন্ঠ প্রশংসা তাদের প্রাপ্য।

গ্রামের মানুষের শিক্ষার প্রতি মহাপুরুষদের ঔদাসীন্য এবং অবজ্ঞার ইতিহাস কেবল লম্বা নয়; ভয়ঙ্কর বেদনাদায়ক এবং অতি নিকৃষ্ট। তাই শিক্ষার ইতিহাস আমরা যা পড়ি কেবল অসম্পূর্ণ নয়, মেকি, ভেজাল সমৃদ্ধ। 

কবি এবং ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নবীন চন্দ্র সেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্নেহভাজন ছিলেন। বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়েরও তিনি ঘনিষ্ঠ মিত্রবৎ ছিলেন। সে কালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রটের চাকরি পাওয়ার পশ্চাতে সুপারিশ শালসার কাজ করতো। অন্য উপাদান ফিকে পড়ে যেত। বিদ্যাসাগর স্বয়ং সেই সকল গলিঘুচির রাস্তা নবীন চন্দ্রকে বুঝিয়েসুঝিয়ে দিয়েছিলেন। এমনটি তিনি পূর্বেও অনেকের জন্য করেছিলেন। সদ্য বিএ পাশ সেই পথ পরিক্রমা করে নবীন চাকরি—তাও ডেপুটির চাকরি— পেয়ে গেলেন।

নবীন চন্দ্র সেনকে একবার গ্রামের স্কুল সম্পর্কে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর কি বলেছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট স্মৃতিচারণে লিখে গেছেন।

“এই পোড়া শিক্ষা এই দেশ হইতে উঠিয়া গেলেই ভাল হয়। আমি আমার গ্রামে একটি স্কুল খুলিয়াছি। আর তাহার ফলে আমি দেশত্যাগী হইয়াছি। চাষাভূষার ছেলেরা পর্যন্ত যেই দু’পাতা ইংরাজি পড়িতে আরম্ভ করিল, আর তার পৈতৃক ব্যবসা ছাড়িল। তাহাদের ভাল কাপড় চাহি, জুতা চাহি, মোজা চাহি, মাথায় টেরিটি পর্যন্ত চাহি। এখন আমার বাড়ি যাইবার জো নাই। গেলেই কেহ বলে, “দাদাঠাকুর! তুমি কি করিলে? ছেলেটা খেতের দিকে ফিরিয়াও চাহেনা। আমার আধা বিঘা জমির চাষ হইল না। খাইব কি? ইহার বাবুয়ানার খরচই কোথা হইতে যোগাইব? “কেহ বলে—-‘আমার গরুগুলি মারা গেল। ছেলেটি তাহাদের কাছে একবারও যায় না। চরান দূরে থাকুক। আমার উপায় কি হইবে?’ আমি যেমন পাপ করিয়াছি, আমার তেমন প্রায়শ্চিত্ত হইতেছে। আমি আর পাড়াগাঁয়ে স্কুলের নাম মাত্র করিব না। এ দেশ তেমন নহে যে, লেখা পড়া শিখিয়া আপন ভাল করিয়া  ব্যবসা করিবে। এ লক্ষ্মীছাড়া ছেলেগুলা দু পাতা ইংরাজি পড়িলেই আপনার পৈতৃক ব্যবসা ছাড়িয়া দেয়; আপনার পিতামাতাকে পর্যন্ত ঘৃণা করে।” [1]

কিছুদিন পূর্বেই  বিদ্যাসাগরের দ্বি-শত জন্ম জন্ম জয়ন্তী পালনের রেশ এখনো কাটেনি। এইঅমৃততুল্য কথাগুলি কেউ কি জনসমক্ষে তুলে ধরেছেন যে, “আমি আমার গ্রামে একটি স্কুল খুলিয়াছি। আর তাহার ফলে আমি দেশত্যাগী হইয়াছি।” বঙ্গীয় শিক্ষার উজ্জ্বলতম দীপশিখাএই মহাপুরুষ কেন গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে দেশত্যাগ করেছিলেন? সে স্বেচ্ছায়, না কোন তাড়নায়? উনবিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে এক ইংরেজ স্কুল ইন্সপেক্টরের রিপোর্ট পড়ছি। তিনি বীরসিংহ গ্রামের স্কুলের দীনতার ছাপ দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। বিদ্যালয়টি বিদ্যাসাগর কর্ত্তৃক প্রতিষ্ঠিত এ কথা শ্রদ্ধা বশে তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন।

কেন বিদ্যাসাগর দেশত্যাগ করেছিলেন, বিদ্যাসাগরের মুখে শোনা যাক। নবীন চন্দ্রকে তিনিবলেছিলেন,

আমি যেমন পাপ করিয়াছি, আমার তেমন প্রায়শ্চিত্ত হইতেছে। আমি আর পাড়াগাঁয়ে স্কুলের নাম মাত্র করিব না।”

যিনি বিদ্যাসাগর, তিনি কিনা বলেন, তিনি পাপী, কারণ তিনি নিজের গ্রাম বীরসিংহে স্কুল খুলেছেন। স্কুল প্রতিষ্ঠা কি পাপ?  অনেকের মনে পড়বে, আমরা তো অনেকে শিশু বয়স থেকে শুনে এসেছি,  “অন্ধজনে দেহো, আলো, মৃতজনেদেহো প্রাণ।” এটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রথম কলি। অন্ধজন অর্থে এখানে নিরক্ষর, শিক্ষাহীন মানুষকে বোঝানো হচ্ছে। 

স্কুল প্রতিষ্ঠা করে কেন পাপ করেছেন, বিদ্যাসাগর অকপটে বলেছেন, “আমি যেমন পাপ করিয়াছি, আমার তেমন প্রায়শ্চিত্ত হইতেছে। আমি আর পাড়াগাঁয়ে স্কুলের নাম মাত্র করিব না।”পায়গাঁয়ে স্কুল স্থাপন তাঁর পাপ।

মনুস্মৃতি মনে পড়ছেঃ শূদ্র এবং স্ত্রীকে যে শিক্ষা দান করে সে নরকগামী হবে। বিদগ্ধ সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত, বিদ্যাসাগর মনু সংহিতা সম্পর্কে পূর্ণ রূপে অবহিত ছিলেন। তাই কি তিনি গ্রামীণ শিক্ষা সম্পর্কে এত অনীহা পোষন করতেন?  

এবার আত্মকথায় সংযোগ করে নবীন সেন লিখেছিলেনঃ –

“কথাগুলি শুনিয়াছি আজ কত বৎসর। কিন্তু এখনও সে কন্ঠস্বর আমার কানে বাজিতেছে। তিনি এই শিক্ষাবিভ্রাটের আরম্ভে যাহা দিব্যচক্ষে দেখিয়াছিলেন, আজ তাহা অক্ষরে ফলিয়াছে। আজ চাষা, ধোপা, নাপিত, জেলে, হাড়ি, সকলের ছেলেই লেখাপড়া শিখিতেছে। লক্ষ্য—-পেয়াদাগিরি ও কনস্টেবলি। এই শিক্ষার পরিনাম কি, ভগবানই জানেন।”[2]

বিদ্যাসাগরের বীরসিংহ গ্রামের স্কুলে কারা শিক্ষা লাভের সুযোগ পেয়েছিল? নবীন চন্দ্রের ভাষায়, চাষা, ধোপা, নাপিত, জেলে, হাড়ি গ্রামের বাসিন্দা। সেখানে স্কুল শিক্ষা তারাই পেয়েছিল। সকলে শিক্ষার দ্বারপ্রান্ত তারা ছিল প্রথম প্রজন্ম। তাদের শিক্ষা লাভের প্রতি বিদ্যাসাগরের তীব্র, অপরিমেয় বিতৃষ্ণা, বিবমিষা!!

তাঁর পরের মন্তব্যে কোন সারবস্তু নেই। কৃষি পরিবারের আমরা যারা গ্রামগঞ্জে থেকে শিক্ষা লাভ করেছি, তারা দেখেছি এবং জানি, উচুজাতের মানুষ পারিবারিক পেশার কারণে তাদের ঘৃণা এবং নিন্দা করে।  বাঙলায় যারাই হাতে কাজ ও কায়িকশ্রমের দ্বারা জীবিকা অর্জন করে, গ্রীসের মত স্বদেশবাসীর কাছে তারা অপাঙতেয়, ব্রাত্য।  গ্রীসে ব্যাপক ভাবে কৃতদাস প্রথা চালু ছিল। তাই তাঁরা হাতে কাজ করা অপমানজনক ভাবতো। সাহিত্য, কলা, দর্শন, সঙ্গীত, যাতে হাত নোংরা ময়লা করতে হয়না গ্রীসের উচু সমাজের অতিপ্রিয় ছিল। বাঙালী সমাজে যেন গ্রীসের গভীর ছায়া ও ছাপ পড়েছিল। শ্রমজীবীদের বাঙালী সমাজের যারা যত বেশী ঘৃণা করে, সেটাই তাঁদের অভিজাত্যের ব্যারোমিটার। 

বাঙলার শিক্ষার ইতিহাস অতি কদর্য এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন। এই কলঙ্কিত দিকটা আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়না। ইংরেজ শাসন কালে গ্রাম বাঙলায় শিক্ষা বিস্তারের সব চেষ্টা সব পরিকল্পনা  উচুজাতের মানুষ ব্যর্থ করে দিয়েছে। যারা যত বেশী দুর্ভেদ্য এবং দুর্লঙ্ঘ বাঁধা সৃষ্টি করেছে হিন্দুদের কাছে তাঁরা দেবতুল্য বা অবতার রূপে পূজিত। বিদ্যাসাগর, স্যার সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বাল গঙ্গাধর তিলক, গোপালকৃষ্ণ গোখলে, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী হিন্দুর উচু সমাজে অবতার ঠিক এই কারণে।

বাঙলার ছোটলাট জন পিটার গ্রান্টকে ২৯ সেপ্টেম্বর ১৮৫৯ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লিখিত পত্রের একাংশে লিখেছিলেন,

“As the best, if not the only practicable means of promoting education in Bengal, the government should, in my humble opinion, confine itself to the education of the higher classes on a comprehensive scale.”  [3]

বিদ্যাসাগর বলছেন, বাঙলায় শিক্ষা বিস্তারের এক মাত্র উপায় উচুজাতের মধ্যেই শিক্ষা সীমিত রাখা। এটাকে তাঁর বিনীত অভিমত বলে ছোটলাটের তিনি উল্লেখ করেছিলেন। ১৮৫৭ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে এক আইন পাশ করা হয়েছিল। সেই আইনের ধারায় দেখেছি, জন পিটার গ্রান্ট এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে ‘Fellow’নিযুক্ত করা হয়েছিল।

ইংরেজ অনুসৃত শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বোম্বে প্রেসিডেন্সির পুণাবাসী বাল গঙ্গাধর তিলকের ঘোর প্রতিবাদ শোনা গেছে। বিদেশী শাসনের উদার শিক্ষা বা ‘liberal education”তাঁর নজরে ঘোর অবাঞ্ছনীয় দিক ছিল দুইটি—প্রথম ত্রুটি ‘English education encouraged the people to defy the caste restrictions’ এবং দ্বিতীয় ‘the spread of English education among the natives will bring down their caste system.’

১৮৯৬ সালে বোম্বে প্রেসিডেন্সির বাণিজ্য শহর বোম্বে এবং পুণা শহর প্লেগ আক্রান্ত হয়। সেখান থেকে প্লেগ সমগ্র ভারত উপমহাদেশ প্লেগ কবলিত হয়েছিল। এক হিসাবে দেখেছি ১৯২০ সাল পর্যন্ত ভারতের এক কোটি মানুষ প্লেগে মারা যায়।পাঞ্জাব, (বর্তমানের) উত্তর প্রদেশ বিহার সব চেয়ে বেশী মৃত্যুর সাক্ষী।পুণার প্লেগ কমিশনার চার্লস র‍্যাণ্ডের উদ্যোগ এবং আবেদনে পুণা সহরে হিন্দু, পার্সি এবং মুসলমান প্লেগ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে হিন্দু প্লেগ হাসপাতালে ভর্তির নিয়ম বৈশিষ্ট্য পূর্ণ ছিল;   

“Rules of Poona Hindu Plague Hospital mandated that the hospital was “opened to all Hindus except members of the low castes.” [4]

পুণা প্লেগ প্রথম এবং একমাত্র সরকারি রিপোর্ট চার্লস র‍্যান্ড লিখেছিলেন। রিপোর্টে তিনি জানিয়ে গেছেন, প্লেগাক্রান্ত হলেও ছোটজাতের কেউ হিন্দু প্লেগ হাসপাতালে ভর্তি হতে পারবেনা। বাল গঙ্গাধর তিলক এই হাসপাতাল স্থানপনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।  

পুণার পার্সি প্লেগ হাসপাতাল এবং মুসলমান প্লেগ হাসপাতালের ভর্তির নিয়মে হিন্দু হাসপাতালের অনুরূপ কোন শর্ত দেখিনি।  কার মত প্রতিভাবানের অভাবে এমন ঘটেছে, জানিনা।

 নারী শিক্ষায় তিলকের আপত্তির কারণ, শিক্ষিতা মেয়েরা “immoral”অর্থাৎ ব্যাভিচারিণী।[5] সম্ভবততিলকের পক্ষেই এমন বানী উচ্চারিত হতে পারতো। 

এবার স্যার সুরেন্দ্রনাথকে কথা স্মরণ করি। তিনি সর্বজনীন বাধ্যতামূলক  প্রাথমিক শিক্ষারঅন্ধ বিদ্বেষী ছিলেন। ১৯১১ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে গোপালকৃষ্ণ গোখলে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বিল পেশ করেছিলেন। এই বিলের প্রতিকুলে সুরেন্দ্রনাথ অক্লান্ত প্রচার করে বিলের অন্তর্ঘাতের পটভূমি সৃষ্টি করেন। ১০১২ সালে আইন সভা গোখলের বিল বাতিল করে দেয়। গোখলের জীবনীকার বি আর নন্দা লিখেছেন সুরেন্দ্রনাথ রিপন করে স্থাপনা করেছিলেন বলে তাঁর ভয় ছিল, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন পাশ হলে সরকার প্রাথমিক শিক্ষা খাতে বেশী অর্থ বরাদ্দ করবেন, উচ্চশিক্ষা খাতে টাকা ব্যয় হ্রাস পাবে। তাই আদা-নুন খেয়ে সুরেন্দ্রনাথ এই আইনের প্রতিবাদে অবতীর্ণ হন; সফল্য পেয়েছিলেন। গণ শিক্ষার উদ্যোগকে রাষ্ট্রগুরু গলাটিপে হত্যা করলেন।  

হতাশ হয়ে গোপালকৃষ্ণ গোখলে ১৯১৫ সালে মারা যান। ১৯৩৭ সালে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ভবানীপুরের এক স্কুলে বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, কেন্দ্রিয় আইন সভা কর্তৃক গোখলের প্রাথমিক শিক্ষা আইন বিল ইংরেজের বিরোধিতায় বাতিল হয়েছিল বললে সত্যের অপলাপ হবে। তিনি আরো বলেছিলেন যে, এদেশের শিক্ষিত মানুষের বিরোধে তাঁর বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইনের বিল কেন্দ্রিয় আইন সভা বাতিল করে ছিল। কারা সেই শিক্ষিত মানুষ? সুরেন্দ্রনাথ এবং গোপালকৃষ্ণ গোখলে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। পেছন থেকে এই বন্ধুই আততায়ীর মত গোখলেকে ছুরি মেরে ছিলেন। অসময়ে গোখলের মৃত্যুর এই ইতিহাস। এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী প্রচার করেছেন গোঁয়ার ইংরেজ আমলাগণ চায় নি, এদেশের মানুষ শিক্ষিত হোক।

হায় রে হায়!!

প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের মন্ত্রী স্যার সুরেন্দ্রের প্রাথমিক শিক্ষা যখন চক্ষুশূল, সেই বিভাগ প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারে উদ্যোগ নেবে এমন ভাবনার কথায় আকাশ বিদীর্ণ করে গাধাও হাসবে। বঙ্গীয় আইন সভা ১৯১৯ সালে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন পাশ করলেও সেই আইনের প্রয়োগের কোন চেষ্টাই করা হয় নি।

১৯২৬ সালে বিশ্ব বিখ্যাত দৈনিক ইংরেজি সংবাদপত্র লন্ডন টাইমস প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত এক ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছিল; সেখানেলেখা হয়েছিল,

“The Bengal Legislature passed an Act introducing the principle of compulsory primary education in May 1919.; but it does not appear that a single local authority in the province has availed itself of the option which the Act provides.”[6]

 স্পষ্ট করা দরকার, সুরেন্দ্রনাথ ১৯২৫ সালে পরলোক গমন করেন। আইনটা পঙ্গু করে রাখার পুরো দায় রাষ্ট্রগুরুর। দি টাইমস পত্রিকার ক্রোড়পত্র প্রকাশের পূর্বেই তিনি ধরাছোঁয়ার অনেক দূরে চলে গিয়ে ছিলেন।

আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনেস্কো [United Nantions Educational, Scientific and Cultural Organization] ভারতে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে এক সমীক্ষা করে১৯৫২ সালে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।

“The results (of compulsory education) obtained … vary from area to area and there is a world of difference between a State like Bengal where compulsion exists only on paper and a State of Baroda where some remarkable results were obtained.” [7]

ভারতের সমীক্ষায় শ্রদ্ধেয় আন্তর্জাতিক সংস্থা জানিয়েছিল যে, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার ফল নানা প্রদেশে ভিন্ন ভিন্ন হয়েছিল। বাঙলায় আইনটা কাগজে সীমিত ছিল। তবে বরোদায় এই আইন অনেক বরণীয় কীর্তি এবং সুফলেরসাক্ষী।

ভারতে শিক্ষার শত্রু অনেক। আশ্চর্যজনক হলেও, বলা উচিত যারা শিক্ষার বিরুদ্ধে শত্রুতাকরেন তাঁরা এদেশে মহামানব হিসাবে পূজিত। একটু পিছনে ফিরে তাকালে দেখতে পাই, ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে ভারতের গভর্ণর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকায় একটা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সংকল্প ঘোষণা করেছিলেন। এই সংকল্প ঘোষিত হতেই বাঙলার স্বারস্বত সমাজের মহান সন্তানগণ বিষাক্ত নাগিনীর মত ফোঁস করে উঠেছিলেন।

স্মৃতিচারণ করে  ১৯৬১ সালে ‘যুগপরিক্রমা’য় নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত লিখেছেন, “বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লর্ড হার্ডিঞ্জ প্রস্তাব করেন যে ঢাকায় একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। তখনি সুরেন্দ্রনাথ, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ইত্যাদি সম্মিলিত ভাবে প্রস্তাবের প্রতিবাদ করেন।” উল্লেখনীয়, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নরেশচন্দ্র ল বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি লিখেছেন, “কিছুদিন পর আমি ঢাকা ল কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপ্যাল পদ নিয়ে কলিকাতা পরিত্যাগ করি।”

বোঝা যাচ্ছে প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পেশী আস্ফালন শুরু হয়েছিল। পেশী আস্ফালনে কারা সেদিন মাতামাতি করেছিলেন তাদের নাম আমাদের জানা উচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে হিন্দুশ্রেষ্ঠদের বিবেকহীন এবং ন্যাক্কারজনক কারসাজী এবং গলাবাজী ইতিহাসের এক স্থায়ী এবং রসালো সম্পদ হয়ে আছে। সমকালের উজ্জ্বল নক্ষত্রদের মধ্যে স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী এবং স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়দের কথা আগেই বলেছি। স্যার প্রভাস চন্দ্র মিত্র, বিপিন চন্দ্র পাল, অম্বিকা চরণ  মজুমদার, সুরেন্দ্রনাথ সমাজপতি, ব্যারিস্টার ব্যোমকেশ চক্রবর্তী, প্যারী মোহন মুখোপাধ্যায় পেশী আস্ফালনে নেমেছিলেন। ঢাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী আইনজীবী ও ঢাকা পৌরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান আনন্দচন্দ্র রায়, বাবু ত্রৈলোক্যনাথ বসুদের নামও এই কূকীর্তির জন্য ইতিহাসে খোদিত হয়ে আছে। কংগ্রেসপন্থী ব্যারিস্টার আবদুর রসুল, মাওলানা আকরমখাঁ, মৌলবি আবুল কাসেম, বিহারের মৌলবি লিয়াকত হোসেন নেতাগণও বিরোধীদের দলে ছিলেন।[8] কিছু মানুষের ধারণা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায়  বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে ক্ষুব্ধ ছিলেন। এমন প্রমাণ এখনও পর্যন্ত আমি পাইনি। তাই প্রমাণ ছাড়া বিশ্বাস করতে চাই না। 

গ্রীক দার্শনিক প্লেটো প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে লিখেছিলেনঃ

“We can easily forgive a child who is afraid of the dark; the real tragedy of life is when men are afraid of the light.”

আমার সাদা ভাষায় প্লেটোর উক্তির অর্থঃআলো দেখে শিশুর ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বুড়ো খোকারা যদি আলো দেখে আতঙ্কিত হন, সে এক মহা বিপর্যয়ের সঙ্কেত।কি আশ্চর্য প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে প্লেটো বাঙালীর মহান বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা ভাবনার অবিকল ভবিষ্যৎ বানীকরে গেছেন, তিনি আমাদের প্রণম্য। যারা আলো দেখে ভয় পায়, তাঁরা অন্যের আলোক প্রাপ্তির কেবল মহাশত্রু নন; দেশের মহাশত্রু। সমাজের যত উঁচু  আসন দখল করে থাকুন না কেন, তাঁরা সভ্যতার শত্রু; মানবতার অভিশাপ।  এ কথা কি জোর গলায় বলা অপরাধ?

কুকুরের লেজ আন্দোলিত করা স্বাবাভিক; কিন্তু লেজ কুকুরকে আন্দোলিত করলে সে অনাগত অভিশপ্ত দিনের পূর্বাভাষ। আমার ব্যক্তিগত ধারণা ১০১২ সালে প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়ে উপরোক্ত ব্যক্তিগণ যা করেছিলেন, সে ১৯৪৭ সালের বাংলা বিভাজনের প্রথম মহড়া বা রিহার্সেল ছিল।

      


[1]নবীন চন্দ্র রচনাবলী, আমার জীবন,প্রথমখণ্ড বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলিকাতা, ২৫শে বৈশাখ, ১৩৬৬।

[2] উপরোক্ত নবীন চন্দ্ররচনাবলী,  আমার জীবন প্রথমখণ্ড পৃষ্ঠা ২৮২-২৮৩।

[3]A. K. Biswas, A nation of slow learners, The Telegraph, Calcutta, December 23, 1993.

[4]A. K. Biswas, Coronavirus from Wuhan in 2019 Reminds catastrophe plague from Manchuria in 1896 wrought in India: Lessons of history.

[5]Occasional Paper, ‘Educating Women and Non-Brahmins as Loss of Nationality’  Bal Gangadhar Tilak and the  Nationalist Agenda in Maharashtra by Parimala V. Rao.

[6]Katherine Mayo, Mother India, New York, March 1931, p. 189.

[7]UNESCO, Compulsory Education in India, Paris, 1952, pp. 80-81.

[8][8]ইতিহাসের আলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিচিন্তা, রাশেদ রাহম ঢাকা, ৭ মে, ২০১৮, সংখ্যা ৫৯,  পৃষ্ঠা ২।

[প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ও মতামত লেখকের নিজস্ব]

লেখক ডঃ অতুলকৃষ্ণ বিশ্বাস, অবসর প্রাপ্ত আই এ এস এবং প্রাক্তন ভাইসচ্যান্সেলর, বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর বিহার বিশ্ববিদ্যালয়, মুজফরপুর, বিহার।

আপনার কেমন লাগলো?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.

2 Comments

  1. দেখুন আমি মনে করি আমি ও এক পাপী
    কারন আমার পূর্ব পূর্ব পুরুষেরা শুদ্র,দলিত, অন্তজ,অস্পৃশ্য নামক শ্রেণী বানায়। আর ব্রাহ্মণ্য বাদে এই তিন শ্রেণীর পরে যত রকম
    অন্যায়,অত্যাচার পেরেছে করেছে। যোগী পুরুষের রাজ্যে দলিত মেয়েরা ধর্ষিতা হন,দলিত ছেলেদের চোর,গুন্ডা অপবাদ দিয়ে শাস্তি দেয়া হয়। কারা দেয়? দেয় তথা কথিত ঘৃণ্য উচু জাতের লোক। আমি যত দিন যাচ্ছে ততই দেখছি বর্ণ হিন্দুদের ভন্ডামি। আজ বঙ্কিম থেকে শরৎ সবার গল্লের চরিত্র সব বর্ণ হিন্দু। এই লেখক মহাশয় কে আন্তরিক ধন্যবাদ কারন উনি সবার মুখোশ খুলে দিয়েছেন। আমি এই খানে লিখতে পারি বা না পারি আমি আপনাদের সাথে থাকব।

  2. “১০১২ সালে আইন সভা গোখলের বিল বাতিল করে দেয়।”
    টাইপিং মিসটেক, সালটা ১৯১২ হবে মনে হয়,
    নীচের দিকে আার একবার এটা রিপিট হয়েছে।
    আর প্লেটোর উক্তির বাংলা করতে dark এর জন্য আলো লেখা হয়েছে।
    আমি যেটা বুঝেছি- অন্ধকারকে শিশুরা ভয় পায়, এটা স্বাভাবিক, এর পেছনে কোন বিপদ সংকেত নেই। কিন্তু বড়রা যদি আলো দেখে ভয় পায় সেটা এক বিপদ সংকেত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *