ইতিহাসের আলোকে ১৮৯৬-১৯২০ সালে ভারতে প্লেগের ধ্বংসলীলা
ডঃ অতুলকৃষ্ণ বিশ্বাস
মহামারীর বিভীষিকা
চীনের মাঞ্চুরিয়া থেকে ১৮৯৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের বাণিজ্য শহর বোম্বে সর্বপ্রথম প্লেগ আক্রন্ত হয়; কিন্তু অল্পসময়ের মধ্যে সারা ভারত মারণ রোগের তাণ্ডবে ধরাশায়ী হয়েছিল। ১২৪ বছর পরে চীনের উহানের করোনাভাইরাস আজ বিশ্বত্রাস। আক্রান্ত ভারতে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক। শতবর্ষের অতীতে প্লেগ ভারতের কী মহাবিপর্যয় ঘটিয়েছিল এই প্রবন্ধ তার এক সংক্ষিপ্ত আলেখ্য তুলে ধরছে।
বোম্বে থেকে ১৮৯৮ সালে সেপ্টেম্বর মাসে কলিকাতা প্লেগে উপদ্রুত হয়। কলিকাতায় মহাব্যাধি এত ত্রাস সৃষ্টি করে যে, আতঙ্ক ও প্রাণ ভয়ে যে-যেমন পেরেছিলেন, ব্রিটিশসাম্রাজ্যের রাজধানী ছেড়ে দূরদূরান্তে মানুষ নিজ নিজ গ্রামের বাড়ীতে চলে যেতে আরম্ভ করেন। যারা পালিয়ে যান, অজ্ঞাতে প্লেগের বীজাণু বহন করে অনেকেই তাদের গন্তব্যস্থানে ব্যাধিটির দ্রুত ব্যাপক বিস্তারে সহায়ক হয়েছিলেন। ১৯২০ সালের সরকারি হিসাবে ততদিনে ভারতের এক কোটির বেশী মানুষ প্লেগে মারা যান।[1]
প্লেগের মহাসঙ্কট
বরিশালের গ্রামে ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট ও ঢাকার কমিশনার কর্তৃক শব দাহ-সৎকার
১৮৯৮ সালে ডিসেম্বর মাসে বঙ্গীয় আইন পরিষদে এক সরকারি বিবৃতি পূর্ববাঙলায় প্লেগ দমনের এক উজ্জ্বল অধ্যায় উপেক্ষিত সরকারি দস্তাবেজে মুখ লুকিয়ে আছে। জেলা বরিশালের সিদ্ধাকাটি গ্রামের [থানা নলছিটি] জমিদার গিরিজাপ্রসন্ন রায় কলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী; প্লেগের আতঙ্কে ৩০ আগস্ট (১৮৯৮) সপরিবারে গৃহভৃত্য সহ কলিকাতা ছেড়ে গ্রামে প্রস্থান করেন। ভাগ্যের পরিহাসে, পরের দিন বাড়ী পৌঁছেই সপরিবারে প্লেগের কোপে পড়েন। সিদ্ধকাটির পাশের অভয়নীল গ্রামেও প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। আইন পরিষদের বিবৃতি মতে, তিন সপ্তাহের মধ্যে উকিলের সমগ্র পরিবার ও ভৃত্য সহ দুই গ্রামের ১১ জন প্লেগে মারা গেছেন।
গ্রামের আতঙ্কিত মানুষ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কাঁচা বাঁশ, হোগলা, খড়ের ঘর পুড়িয়ে দেন। আক্রান্ত পরিবারের সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি করে গ্রামবাসী প্লেগের সংক্রমণে সফল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন; স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতার জন্য প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়ে কালান্তক ব্যাধি দমনে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েন।
সরকারি বিবৃতি অনুসারে, ভীত-ত্রস্ত আত্মীয় স্বজন প্রতিবেশী গ্রামত্যাগ করে চলে যাওয়ায় রোগাক্রান্ত মানুষের অন্তিমমুহুর্তেও পাশে দাঁড়াবার কেউ ছিলেন না। এমন সংকটকালে বরিশালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বিটসন-বেল এবং ঢাকা বিভাগের কমিশনার এইচ শ্যাভেজ সাহসিকতা, তৎপরতা, এবং সদবুদ্ধি প্রণোদিত হয়ে ত্রাণ ও সহায়তার জন্য সিদ্ধাকাটি-অভয়নীল গ্রামের বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ান। মানবিকতাবোধে উদ্বুদ্ধ উচ্চপদস্থ অফিসারদ্বয় দুই গ্রামের মৃত মানুষের শব দাহ-সৎকারে সাহায্য করেন। এক কথায়, এই দুই বিদেশী উচ্চপদস্থ অফিসার একান্ত নিকট বন্ধু ও আত্মীয়ের মত বিপদগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ান।
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় আইন পরিষদে প্রশ্ন তুলে উপর্যুক্ত কাজের জন্য সরকারকে বরিশালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং ঢাকা বিভাগের কমিশনারের উপযুক্ত স্বীকৃতির দাবী জানান। সিদ্ধকাটি এবং অভয়নীল গ্রামে দুই অফিসারের ভূমিকা, তাঁর ভাষা্য়, ‘self-denying labours.’ অর্থাৎ নিজের জীবন তুচ্ছ করে গ্রামবাসীর সেবায় তাঁরা নেমে পড়েছিলেন। [2]
পুণা প্লেগ কমিশনার আই সি এস অফিসার চার্লস র্যান্ডের হত্যা
পিতামাতার মুখাগ্নি ক’রেমৃতদেহের দাহ-সৎকার হিন্দু পুত্রেরশাস্ত্র নির্দেশিত কর্তব্য। রাজকর্মচারীদ্বয় সেদিনস্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বরিশালে সেইকর্তব্য করেছিলেন। শাস্ত্রের দোহাই, ধর্ম আর কালচারের ঝাণ্ডা তুলে হিতৈষী বিদেশীদের সাথে, আনন্দের কথা, বাঙলায় সেদিন পাঞ্জা লড়তে কেউ অবতীর্ণ হননি। ততদিনে মহারাষ্ট্রের পুনা শহরে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গিয়েছিল।
প্লেগ প্রতিরোধ এবং দমনে নিযুক্তপ্লেগ কমিশনার তরুণ আই সি এস অফিসার ওয়াল্টার চার্লস র্যান্ডকে ১৮৯৭ সালের ২২ জুন পুণায় আততায়ীরা গুলি করেছিল। তাঁর সহকর্মী, সঙ্গী লেফটেন্যান্ট আয়ার্স্ট গুপ্তঘাতকের গুলিতে ঘটনাস্থলে নিহত হন। গুরুতর আহত চার্লস র্যান্ড ১১ দিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে ৩ জুলাই মারা যান। প্লেগ দমনে সরকারের গৃহীত বিধিবিধান, নিষেধাজ্ঞা কিছু কুসংস্কারাচ্ছন্ন পুণাবাসীর কাছে ঘোর অবাঞ্ছিত অত্যাচার মনে হয়েছিল বলে দুই আততায়ী চিতপাবন ব্রাহ্মণ যুবক, দামোদর বালকৃষ্ণ এবং বাসুদেব চাপেকর প্লেগ কমিশনার ও তার সহযোগীর উপরে গুলি চালিয়েছিল। [3]
পুণায় প্লেগ দমনে তল্লাসিতে নিযুক্ত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ভাবে জনরোষ ক্ষেপিয়ে তুলতে কিছু সনাতনপন্থী ভিত্তিহীন কুৎসা প্রচারে নেমেছিলেন। পরিনাম হল বিয়োগান্তক — পদে যোগদানের চার মাসের মধ্যেই তরুণ আই সি এস অফিসারকে জীবন দিতে হল। ‘মারাঠা’ ও ‘কেশরী’ সাপ্তাহিক পত্রিকার মাধ্যমে প্লেগ নিবারনে সরকার বিরোধী উত্তেজনামূলক প্রচার করে বাল গঙ্গাধর তিলক উস্কানিদাতাদের অন্যতম ভূমিকা নিয়েছিলেন। স্বসম্পাদিত পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেনঃ
“The tyranny of the Plague Committee and its chosen instruments is yet too brutal to allow respectable people to breathe at ease.”[4]
প্লেগ কমিটি এবং প্লেগ দমনে নিযুক্ত লোকজন এতই বর্বর যে, পুণায় ভদ্রজন শ্বাস নিতেও অপারগ । প্লেগদমনকারীদের চেয়ে প্লেগ-ই বরং বেশী মমতাময়–‘merciful.’ ‘মার্সিফুল’ শব্দ লোকমান্য তিলক প্রয়োগ করেছেন। ভদ্রজন বলতে তিনি প্রধানতঃ ব্রাহ্মণের ইঙ্গিত করেছেন। অথচ প্লেগ দমন ও নিরাময়ে চার্লস র্যান্ডের পরামর্শে হিন্দু, পার্শী এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ চাঁদা তুলে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। হিন্দু হাসপাতাল স্থাপনে বালগঙ্গাধর তিলক পথিকৃতের ভূমিকা নিয়েছিলেন; প্লেগ কমিশনারের প্রথম রিপোর্টে বলা হয়েছে, হিন্দু প্লেগ হাপাতালের পরিচালনা সমিতির সকল সদস্য ছিলেন ব্রাহ্মণ, “managed by a committee of Brahmins.” ভর্তির নিয়ম মতে হিন্দু ব্যাতীত নিচু জাতহিন্দু হাসপাতালে অবাঞ্ছিত—(“opened to all Hindus except members of the low castes.”[5]
সেকালে বাঙলার নিচুজাতের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল কত উদার ছিল? বাঙালী বিদ্বান বুদ্ধিজীবীগণের গগনভেদী প্রচারে আমাদের বোঝানো হয় যে জাতপাতের কালোছায়া কোন কালে বাঙলায় দেখা দেয় নি। আসল সত্যটা নিতান্তই অপ্রিয়। জাতপাতের নিকৃষ্ট সাধনায় পুণার এক ধাপ আগে ছিল বাঙলা।
১৯২৯ সালে জানুয়ারি মাসে সাইমন কমিশনের কলিকাতায় আগমনে উচুজাতের হিন্দু নেতাগণ জাতীয়তাবাদের বৈপ্লবিক ধ্বনি “সাইমন মুর্দাবাদ, সাইমন নিপাত যাক, ফিরে যাও” দিয়ে কলিকাতা আলোড়িত করেন। তাঁরা সাইমন কমিশনের প্রতিবাদ করেন, কারণ সকলেই শ্বেতাঙ্গ, পার্লামেন্টের মেম্বার ঐ কমিশনের সদস্য ছিলেন। তাঁদের আবদার কমিশনে ভারতীয় সদস্য চাই। কমিশন তদন্ত করতে এসেছিল, ১৯১৯ সালের আইন অনুসারে দশ বছরে ভারতের শাসন ব্যবস্থা দেশকে কতখানি এগিয়ে নিতে পেরেছে; এবং ভবিষ্যতের জন্য আরো কী কী পরিবর্তন দরকার। জনমত যাচাই করতে তাঁরা এদেশের নানা শ্রেণী, জাত, ধর্মের মানুষের সঙ্গে সোজাসুজি কথা বলেন। সাইমন কমিশনকে কংগ্রেস দল বয়কট করেছিল। শুধু উচুজাতের নেতাদের কথায় তাঁরা সীমিত থাকেন নি।
তাঁদের সামনে কথা বলার সুযোগ পেলেন ভারতের অস্পৃশ্য মানুষ । অল বেঙ্গল নমঃশূদ্র এ্যাসোসিয়েশন এবং অল বেঙ্গল ডিপ্রেসড ক্লাস এ্যাসোসিয়েশন যুগ্মভাবে স্মারক লিপি পেশ করে ২১শে জানুয়ারি নয় জন সদস্য সাইমন কমিশনের বেঙ্গল কমিটির কাছে কলিকাতায় সাক্ষ্য দিলেন। কমিশনের সদস্যগণ দুই অস্পৃশ্য জাতের সংগঠনের প্রতিনিধিদের কাছে ২২৬টি প্রশ্ন করে বাঙলার সমাজজীবনের খুঁটিনাটি জেনে নেন।
কমিশনের ১৮৩ নম্বর প্রশ্ন ছিলঃ কলিকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটা অংশ একজন অস্পৃশ্য ধনী দাতার অর্থে নির্মিত হয়েছে; কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা শুনেছি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্পৃশ্য রোগীদের নাকি চিকিৎসার সুযোগ নেই? প্রতিনিধি মণ্ডলীর নেতা মুকুন্দবিহারী মল্লিক বলেন, “হ্যাঁ, আমরাও এই কথাই শুনেছি।“[6]কলিকাতার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একাংশ নির্মাণ করতে অস্পৃশ্যজাতের এক ধনী টাকা দান করেন; কিন্তু ছুৎমার্গী, কুসংকারাচ্ছন্ন ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র সেখানে অস্পৃশ্য রোগীর চিকিৎসার সুযোগ দিত দেয় না। পুণার ব্রাহ্মণগণ হিন্দুদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে হাসপাতাল বানিয়ে ছিলেন বলে অতি দুর্দিনেও অস্পৃশ্যদের সেখানে চিকিৎসার অধিকার ছিল না। কিন্তু কলিকাতায়তো অবস্থা ঘোরতর নিন্দনীয়। অস্পৃশ্য দাতার টাকায় নির্মিত হলেও হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য তাদেরই ভর্তি করা হত না।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানীতেই তাঁরা মুমুর্ষু মানুষের জাত দেখে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করতেন। অস্পৃশ্য মানুষের টাকায় নির্মিত হলেও হাসপাতালে অস্পৃশ্য রোগী অবাঞ্ছিত। আমরা বুঝতে পারি, কেন উচ্চবর্ণ নেতাদের গালভরা প্রগল্ভতায় বিদেশী শাসকগণের আস্থাছিল না।
**** ****
পুনার প্লেগের কথা ফিরে যাই। চার্লসর্যান্ড এবং লেফটেন্যান্ট আয়াস্টের হত্যাকারীগণ ফাঁসি এবং কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিল। [7]তিলকের পত্রিকা ‘কেশরী’ এবং ‘মারহাট্টা’ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচার করে তিনি রাজরোষে পড়েন। তিলক কারাবাসে দণ্ডিত হন। মাক্স মুলার, উইলিয়াম হান্টার, দাদাভাই নওরোজী, আই সি এস রমেশচন্দ্র দত্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সাম্রাজ্ঞীকে সম্বধিত এক যুগ্ম আবেদনপত্রে তিলকের কারামুক্তির অনুরোধ করেন। তাদের যুক্তি ছিল দণ্ডিতের প্রতি clemency বা ক্ষমাপ্রদর্শন জনমানসে কল্যাণকারী প্রলেপ পড়বে [“a beneficial effect on the public mind.”][8]
উচ্চপদস্থ অফিসারের হত্যায় সমগ্র দেশে আমলাতন্ত্র স্তব্ধ, আতঙ্কিত, প্লেগদমন ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রানহীন, দিশাহারা হয়ে পড়েছিল; স্বাভাবিক ভাবে কাজের প্রতি তাঁরা উৎসাহ এবং মনোবল হারিয়ে ফেলেছিলেন। ১৮৯৬ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে ভারতে এককোটি মানুষের প্লেগে মৃত্যুর কারণ এই নয় ত?
হত্যাকারী ও তাঁদের উস্কানিদাতাদের পরিচিতি গোপন রাখতেই কিছু লোক তাঁদের স্বাধীনতা সংগ্রামীর মর্যাদা দিয়েছে এবং আর এককোটি ভারতীয়ের মৃত্যুর খবরটুকু পর্যন্ত ইতিহাস লেখে না? দামোদর চপেকারের স্মৃতিতে ভারত সরকার কিছুদিন পূর্বে স্মারক ডাকটিকিট বাজারে ছেড়েছিল।
পাঞ্জাব কেশরী লালা লাজপত রায় ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ (১৯১৬) গ্রন্থে লিখেছেন যে, ১৮৯৬ থেকে ১৯১৩ সালের মধ্যে প্লেগে ৭২,৫১,২৫৭ মানুষ মারা গেছেন।[9] ১৮৯৬ সালের পরবর্তী অন্ততঃ তিন দশক ধরে আসমুদ্রহিমাচল ভারত মহামারীর অব্যাহত মৃত্যু মিছিল দেখেছিল। ১৮৯৬ থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে প্লেগ বোম্বে প্রেসিডেন্সির ২২,৫৭,৬৮২ জন এবং উত্তরপ্রদেশের ২২,০১,৮১১ মানুষকে কেড়ে নেয়। [10] সুদূরের পাঞ্জাব সব চেয়ে বেশী মূল্য দিয়েছিল। ১৯১১ সালের জনগণনা অনুসারে, পাঞ্জাবের ২,৪১,৮৭,৭৫০ জনসংখ্যার ২২,৬৪,০৭৭ প্লেগে নিহত হন। এক দশকে প্লেগ পাঞ্জাবের ১১.৮% মানুষ ছিনিয়ে নেয়— অন্য কোন প্রদেশের এত বড় বিপর্যয় ছিলনা । পাঞ্জাবে নারীর প্রতি প্লেগ ছিল অতি নির্মম ।“The abnormal excess in the female mortality from plague…”[11]
মহামারীর মহাবিস্ময়— বাঙলায় প্লেগ মৃত্যু নগণ্য
বাঙলায় ১৮৯৬ থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে ৬২,৮৯৮ মানুষ জন মারা যান।[12]ক্ষয়ক্ষতির নগণ্য মাসুল দিয়ে বাঙলা সেই মহাসঙ্কট পেরিয়েছিল। স্বাস্থ্য বিভাগ এবং সরকারের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের এ নিয়ে বিষ্ময়ের সীমা ছিলনা। কলিকাতায় অনেক প্লেগমৃত্যু সত্ত্বেও সরকারি ঘোষণা মতে,
“epidemics of plague have been conspicuous by their absence in nearly all parts of Bengal”[13]
বৃহৎ বঙ্গকে কোন গুপ্ত রহস্য প্লেগমুক্ত রেখেছিল? বাঙলা ব্রটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী বলে সারা ভারতের মানুষের গন্তব্য ছিল কলিকাতা। ভারতের প্লেগ কবলিত প্রদেশে থেকে বাঙলার খেতে-খামারে, কল-কারখানায়, রেলে, বন্দরে কাজের খোঁজে শ্রমিক-মজুর নিরন্তর বাঙলায় এলেও সেদিনের প্রায় প্লেগহীন বাঙলা তো এক প্রহেলিকা।
আসলে প্রকৃতিই বাঙলাকে আপন বুকে জড়িয়ে ধরে প্লেগমুক্ত রেখেছিল। শুধু প্লেগ কেন, প্রকৃতির আশীর্বাদে পূর্ববঙ্গ কুষ্ঠমুক্তও ছিল । জনগণনা কর্তৃপক্ষের মতে,“There is a definite geographical distribution of leprosy. The lower delta, included in Central and East Bengal, which has a humid climate and a soil composed mainly of recent alluvium, is most immune.” আদ্র জলবায়ু, পলিযুক্ত মাটি নিম্ন গাঙ্গেয় উপত্যকার মধ্য এবং পূর্ববঙ্গের মানুষকে কুষ্ঠমুক্ত রেখেছে।[14]
কেনপ্লেগ মহামারীর প্রতি ভারত উদাসীন ছিল?
নাৎসি শাসনে ষাট লক্ষ ইহুদি নারীপুরুষ শিশুবৃদ্ধকে নির্বিশেষে গ্যাস চেম্বারে পুরে, গুলি করে ও বর্বর নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল।[15] ঐতিহাসিকদের দাবী, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে ১৩ লক্ষ বাঙলার থেকে ত্রিশ লক্ষ মানুষ অনাহারে মারা যান। [16] বুদ্ধিজীবী, ঐতিহাসিক, মানবাধিকারের প্রচারক ও প্রবক্তা, আইনজীবী বিশ্বময় তীব্রকন্ঠে হিটলারের নিন্দা করেন। হিটলারের জার্মানী এবং বাঙলার দুর্ভিক্ষে মৃত মোট নব্বই লক্ষ মানুষের চেয়ে ভারতে প্লেগমৃতের সংখ্যার দশলক্ষের বেশী হওয়া সত্ত্বেও এই মহাবিপর্যয়ের প্রতি এক শতাব্দীর বেশী সময় ভারতীয়বুদ্ধিজীবী এবং দেশপ্রেমিকগণ মৌন কেন? আগেই দেখেছি, লালা লাজপত রায়ের মতে, ১৯১৫ সাল পর্যন্ত ৭২,৫১,২৫৭ প্লেগাক্রান্ত ভারতীয়প্রাণ হারিয়েছেন; কিন্তু ফুটনোটে তাঁর নিরুত্তাপ মন্তব্য অপার বিষ্ময়ের কারণঃ –
“We do not…say that British Rule in India is responsible for the plague….” [17]
আমরা বলছি না যে, বৃটিশ শাসনই ভারতে প্লেগের কারণ। বরাদ্দ অর্থের পরিকল্পিত ভাবে খরচ করে উৎকৃষ্টতর পরিচ্ছন্ন ও সুস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করলে প্লেগ প্রতিরোধ এবং রোগ নির্মূল করা সম্ভব হত। বোম্বে প্রেসিডেন্সির সরকারের প্লেগ নীতি এবং নিরাময় ও দমনের উদ্যোগ সম্পর্কে প্রথম বছরের প্রতিবেদন দেখলে স্পষ্ট হবে পরিচ্ছন্নতা সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছিল।
প্লেগ প্রতিরোধ, দমন এবং উচ্ছেদে আক্রান্তকে হাসপাতালে পাঠানো, তাঁকে সুস্থদের থেকে আলাদা করে রাখা, রোগাক্রান্তদের বাড়ীঘর ধোঁয়া দিয়ে, চুনকাম করে জীবাণুমুক্ত রাখা প্রধান কাজ ছিল। কিছু শিক্ষিত গোঁড়া এবং রক্ষণশীলদের সঙ্গে আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার এখানে মুখোমুখি সংঘর্ষ বেঁধেছিল। আধুনিক চিকিৎসা ও বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থার যাঁরা প্রতিকুলে, ইতিহাসে জাতীয়তাবাদী বলে তাঁরা চিহ্নিত।
পরাধীন ভারতের রাজনীতিতে গোপালকৃষ্ণ গোখলে নরম বা মধ্যপন্থী নেতা গণ্য হন। বোম্বে এবং পুণায় প্লেগ আক্রমণের প্রাক্কালে তিনি ছিলেন লন্ডনে। প্লেগ প্রতিরোধ এবং দমনের প্রয়োজনে পুণায় সেনাবাহিনী নামানো হয়েছিল। প্লেগ কমিশনারকে সাহাযার্থে প্লেগ বিশেষজ্ঞ সার্জন-ক্যাপ্টেন বেভেরিজ (Surgeon-Captain Beveridge) কে পুণায় নিযুক্ত করা হয়। ১৮৯৪ সাল থেকে ডঃ বেভেরিজ হংকং শহরে প্লেগ-দুর্গত মানুষের নিরাময়ে নিযুক্ত ছিলেন। অভিজ্ঞ ও প্লেগ বিশেষজ্ঞ বেভেরিজকে ভারতে প্লেগ উচ্ছেদের মিশনে আনা হয়েছিল। পুণা শহর অনেকগুলি খণ্ডে ভাগ করে সেনাবাহিনীর এক-একটা দলের তদারকিতে Fumigation, Lime washing, Segregation করা হত। প্লেগ উপদ্রুত মহল্লায় বাড়ী তল্লাশি করার সময় মহিলাদের সম্ভ্রম এবং মর্যাদার প্রতি সৌজন্য বশে তল্লাশিতে নিযুক্ত প্রতিটি দলের সঙ্গে একজন করে স্থানীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি এবং একজন মহিলা উপস্থিত থাকতেন। প্লেগের কাজে বাড়ীসার্চ, রোগাক্রান্তদের হাসপাতালে পাঠানো, সেনার ব্যবহার পুণার কিছু প্রথম সারির নেতা ও সংবাদপত্রের সম্পাদকের মনঃপূত ছিলনা। গোপালকৃষ্ণ গোখলের নিজস্ব পত্রিকা ‘সুধারক’ কী লিখেছিল শুনুনঃ
“Till now they were committing thefts, but now they are laying hands on your women! In spite of this your blood is not boiling? What a shame!” [18]
বাড়ীতে বাড়ীতে তল্লাশির সময় ব্রিটিশ সেনাপুলিশ এত দিন চুরি করেছে; এখন মেয়েদের গায়ে হাত দিচ্ছে। ছি! ছি!! কী লজ্জার কথা!। তবু কারও রক্ত টগবগ করে ফুটছেনা? তাঁর জীবনীকার লিখেছেন, সেনাপুলিশ পূজার ঘরে গিয়ে দেবদেবী মুর্তির ফুল তুলে নিয়ে আতঙ্কিত কুমারী ব্রাহ্মণ মেয়েদের গায়ে ছুঁড়ে চটুল রঙ্গরসিকতা করেছে। “mild pleasantry” by “lifting a flower from the idol and throwing it at a trembling Brahman maiden.”[19]উত্তেজনা ছড়ানোরনগ্ন চেষ্টা, উস্কানি।
গোপালকৃষ্ণ গোখলেকে লন্ডনে বিশ্বস্ত বন্ধুগণ নিয়মিত চিঠি-টেলিগ্রাম পাঠিয়ে পুণায় প্লেগের সর্বশেষ খবর পরিবেশন করতেন। লন্ডনের ‘দি ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান’ খবরের কাগজে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বললেন যে, পুণাবাসীর বাড়ীতে তল্লাসির সময় ঘরের মধ্যে অন্ধকারের অজুহাত দেখিয়ে রাস্তায় নামিয়ে দুজন মেয়েকে উলঙ্গকরে সেনাপুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে; তাদেরই একজন অপমান ও নিগৃহ সয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে আত্মহত্যা করে গ্লানি মুক্ত হয়েছেন।
বোম্বে প্রেসিডেন্সির গভর্ণর তদন্ত করে পরশ্রীকাতর, বিদ্বেষপরায়ণ মানুষের অপপ্রচার ‘malevolent invention’ বলে সেই কথা লন্ডনে ব্রিটিশ সরকারকে জানান। [20]ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সেই ভিত্তিতে প্রদত্তসরকারি বিবৃতি গোখলের মুখে চুনকালি লেপে দিয়েছিল। দেশে ফিরে তিনি মাঞ্চেষ্টার গার্ডিয়ান পত্রিকায় পুণা প্লেগ দমনের বিরুদ্ধে লন্ডনে অপপ্রচারের দায়িত্ব স্বীকার করে বোম্বের গভর্ণরের কাছে ১ আগস্ট ১৮৯৭ সালে এক দীর্ঘপত্র লিখে নিঃশর্ত ক্ষমা চান।[21] বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা টাইমস অফ ইন্ডিয়া গোখলের সেই পত্র ছেপে তাঁর বক্তব্য ভারতবাসীকে অবগত করেছিল।
আমরা এক প্রবাদ শুনেছিঃ “যে গাই দুধ দেয়, তার লাথি সহ্য করতে হয়।“ দুইজন অফিসারকে হত্যার বদলে ভারত কি এককোটির বেশী প্রাণ দিয়ে মূল্য চুকিয়ে ছিল? দেশপ্রেমের নামে এক কোটির বেশী মানুষের মৃত্যু সত্ত্বেও আমাদের কেউই কোন দিন প্রশ্ন তোলেনি যে, “এত মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ীকারা?” প্লেগ মৃত্যু স্মরণ করে কেউ কি কোন দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন? কখনও কেউ কি শোক প্রকাশ করেছেন? এককোটির বেশী মানুষের মৃত্যুর দায় কাদের—দেশপ্রেমের খ্যাতিতে উজ্জ্বলদের না প্লেগ দমনকারী ব্রিটিশের?
সুবক্তা সাংসদ ডঃ শশী থারুর কিছুকাল পূর্বে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বিতর্কসভায় দাবী করেছিলেন ভারতে লুটতরাজ চালিয়ে ইংরেজ কোটি কোটি টাকা নিয়ে দেশকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি ইংল্যান্ডের কাছে অতীত লুঠের জন্য ভারতের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দাবী করেন । এই দাবীর সমর্থনে জনমত নির্বিশেষে অগণিত মানুষ ডঃ থারুরের উচ্চকন্ঠ প্রশংসা করেছেন।
কিন্তু প্লেগ মৃত্যু নিয়ে এদেশে দুর্ভাগ্যজনক বৌদ্ধিক ও মৃন্ময় নীরবতা কেন? কাদের আড়াল করতে ভারতীয়রা এত নীরব? ব্রিটিশ শাসকদের আড়াল করতে নিশ্চয়ই তাঁরা মুক নন? উত্তরটা কারা দেবেনঃ –এককোটির বেশী প্লেগমৃত্যুর জন্য ভারতবাসী কার কাছে ক্ষতিপূরণ দাবী করবেন? রাজনীতিতে চরমপন্থী বলে পরিচিত লালা লাজপৎ রায়ের কোমল প্রতিক্রিয়া আগেই উল্লেখ করেছি। তিলক প্লেগের মধ্যেই ‘mercy’ দেখেছিলেন কিন্তু তিনি ক্রুদ্ধ এবং সরব ছিলেন প্লেগ দমন, নিরাময় এবং প্রতিরোধে কর্মরতদের বিরুদ্ধে। অন্য দিকে প্লেগের জন্য লাজপৎ রায় ইংরেজ শাসনকে ত দায়ী-ই করেন নি।
ফলটা কী দাড়িয়েছিল? ১৯২১ সালের জনগণনায় ভারতের প্রতিবেদিত মোট জনসংখ্যা ৩১,৫৯,৪৩,৪৫০ জন। (Census of India, 1921, Vol. I, India-Tables II by J. T. Marten, ICS, Calcutta, Superintendent Government Printing, India, p. 3.) দেখা যাচ্ছে, ১৯২০ পর্যন্ত প্লেগ ভারতের ৩.১৬% ভাগের বেশী মানুষ কেড়ে নিয়েছিল। ভারতমাতা তাঁর এত সন্তান হারালেও এদেশের নেতাগণ ভাই বলে মনে করতেন বলে তো হয় না; তাদের দিকে নেতাদের মনোযোগ যায়নি বলেই এমন অপ্রিয় কথা বাধ্য হয়ে বলছি।
আমাদের দেশের দিকে তাকিয়েই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট চার্লিস ডে গল Charles, de Gaulle (নভেম্বর ১৮৯০-নভেম্বর ১৯৭০) যেন দেশভক্তি এবং জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা নিরূপণ করেছিলেন। তাঁর ভাষায়ঃ –
“Patriotism is when love of your own people comes first; nationalism, when hate for people other than your own comes first.”
স্বজনপ্রীতিতে উদ্বেলিত হয়ে উঠলে নেতা একজন দেশভক্ত; কিন্তু আপনজন বাদে মনে অন্যের প্রতি ঘৃণা থকথক করলে নেতা সাচ্চা জাতীয়তাবাদী।
এককোটি মানুষের বেশী দেশবাসীর শাশ্মনভূমিতে দাঁড়িয়ে বুদ্ধিজীবী এবং ইতিহাসবিদগণ কাদের আড়াল করতে জাতীয়তাবাদ আর স্বদেশপ্রেমের অখণ্ড কীর্তন শুনিয়ে থাকেন?
—০—
সূত্রঃ
[1] The Statesman’s Year Book, 1923, Macmillan and Limited, London, 1923, p. 136.
[2]Bengal Legislative Debates, 1898, pp. 340-341.
[3]Dr. Atulkrishna Biswas,Coronavirus from Wuhan in 2019 Reminds catastrophe plague from Manchuria in 1896 wrought in India: Lessons of history,Mainstream, VOL LVIII No 24, New Delhi, Saturday 30 May 2020.
[4]Dhananjay Keer, Lokmanya Tilak, Father of Indian Freedom Struggle, Popular Prakashan, Bombay, September 1959, p. 120.
[5]The Plague in India, 1896, 1897,compiled by R. Nathan, ICS, Chap. VIII., Government of India, Home Department, 1898, Simla, p. 207.
[6]Dr. A. K. Biswas, The Namasudras of Bengal, Profile of a persecuted people, Blumoon Books, New Delhi, 14 April, 2000, p. 96.
[7]10 https://en.wikipedia.org/wiki/Chapekar_brothers.
[8]N. G. Jog, Bal Gangadhar Tilak, Publications Division, Ministry of Information & Broadcasting, Government of India, 2015, p. 70.
[9]Lala Lajpat Rai, Young India, Huebsch, New York, 1916, p. 249.
[10]Census of India, 1911, Vol. XIV, Part I Report, Punjab, p. 41.
[11]Census of India, 1911, Vol. XIV, Part I Report, Punjab, p. 229.
[12]Dr. Robert BruceLow,The progress and diffusion of plague, cholera and yellow fever throughout the world, 1914-1917, Ministry of Health, London, His Majesty’s Stationery Office, 1920, p., 37.
[13]Census of India, 1911, Vol. V, Bengal, Bihar & Orissa and Sikkim, Part I Report by L. S. S. O’Malley, ICS, p. 73.
[14]Census of India, 1911, Vol. V, Bengal, Bihar & Orissa & Sikkim, Part I Report by L. S. S. O’Malley, ICS, 422.
[15]Haaretz, Holocaust Facts: Where Does the Figure of 6 Million Victims Come From?January26, 2020.
[16]Soutik Biswas, BBC How Churchill ‘starved’ India, , How Churchill ‘starved’ India, Thursday, 28 October 2010.
[17]Lala Lajpat Rai, op. cit.
[18]T. R. Deogirikar, Gopal Krishna Gokhale, Publications Division, Ministry of Information and Broadcasting, Government of India, 4th edition, 1992, p. 68.
[19] Ibid.
[20]B. R. Nanda, Gokhale, The Indian Moderates & The Raj, Delhi, Oxford University Press, London, 1977, p.104.
[21]উপরোক্ত গ্রন্থ, পৃষ্ঠা ১১০