হর্ষবর্দ্ধন চৌধুরীর নাটকঃ চুটকি(একটি নাটিকা)

সময় সকাল। ভক্ত রাস্তার পাশে চায়ের দোকান সাজাচ্ছে।  তার মেয়ে চুটকি বাবাকে সাহায্য করছে। এমন সময় মোটর সাইকেল থামার শব্দ। তিনজন  বিক্রম, শম্ভু , বজরঙ্গ ২০/২২ বছর বয়সের ছেলে, মাথায় গেরুয়া পট্টি , সিগারেট টানছে। টানতে দোকানের সামনে রাখা বেঞ্চে বসে পড়ে, তিন গ্লাস চায়ের অর্ডার দেয়-

শম্ভু- কড়া করে তিনটে চা দেতো।

ভক্ত: এই দি বাবু, জলটা গরম হোক।

বিক্রম: জোরে হাওয়া কর। নাম কি তোর?

ভক্ত: বাবু, ভক্ত।

বজরঙ্গ: ভক্ত, কার ভক্ত?

ভক্ত: আজ্ঞে, আমি সবাইকেই ভক্তি করি।

শম্ভু: না, সবার ভক্ত হওয়া যাবে না। শুধু রামের ভক্ত হতে হবে।

ভক্ত: আমিতো রামকেও ভক্তি করি।

বিক্রম: রামকেও না, শুধু রামের ভক্ত হতে হবে।

ভক্ত: তাই হবে।(কথার মধ্যে চুটকি এক থালায় তিন গ্লাস চা নিয়ে আসে।)

চুটকি : বিস্কূট দেব? (তিন জনে ভালো করে চুটকি কে দেখে।)

বিক্রম: দে দে তুই যা দিবি তাই খাব।

শম্ভু: (বিক্রমকে) কিরে মনে ধরে গেল নাকি?

চুটকি: চিনি ঠিক আছে, না আর একটু দেব?

বজরঙ্গ: তুই হাতে করে যা দিবি তাই মিষ্টি হয়ে যাবে। নাম কি তোর?

চুটকি: মঙ্গলা

বজরঙ্গ: বাহ, কার কার মঙ্গল করলি? আয়না আমার একটু মঙ্গল কর।(বলে হাত ধরে টানে।)

চুটকি: অসভ্যতা করবেন না।

শম্ভু: আরে হাত ধরলে অসভ্যতা হয় নাকি? কোন স্কুলে এসব পড়িস?

বিক্রম: চা ওয়ালার মেয়ে, স্কুলে পড়বে কি?

চুটকি: আমি মেট্রিক পাশ।

বজরঙ্গ: তা মেট্রিক পাশ করেছিস বলে কি মাথায় চড়বি?

শম্ভু: মেয়েরা কি পুরুষের মাথায় বসে? কোলে বসতে হয়। আয় আমার কোলে আয়।

চুটকি: বাড়িতে বোন নেই। তাকে কোলে নিয়ে আদর কর।

বিক্রম : আরে এ দেখি একদম নাগিন। ফোঁস ফোঁস করছে। তোর বিষদাঁত ভেঙে তোকে নিয়ে খেলা দেখাবো।

চুটকি: মা ফোট, চা খাওয়া হয়েছে, পয়সা দে নিজের কাজে যা।

বিক্রম: এই শম্ভু মেয়েটা পয়সা চাইছে।

শম্ভু: এই শোন সব দোকানদার আমাদের পয়সা দিয়ে দোকান চালায়। এ কী মগের মুলুক পেয়েছিস, বিক্রমদাকে পয়সা না দিয়ে দোকান চালাচ্ছিস?

চুটকি: কোথাকার মাতব্বর তোমরা, সরকারের জমিতে দোকান দিয়েছি।

বজরঙ্গ: আমরা কে জানিস না? আমরা সরকারের দল। তুই জানিস না, মাফ করে দিলাম। আর যখন খুশি চা চাইব , খাওয়াবি। পয়সা চাইতে পারবি না।

চুটকি: আর না দিলে কি করবি?

বিক্রম: তোকে নিয়ে পিকনিক করবো।( বলে তিনজন অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়ে। হাসতে হাসতে মোটর সাইকেল স্টার্ট দিয়ে চলে যায়। ওরা চলে যেতে মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি প্রবেশ করে।)

ব্যক্তি: ভক্ত, এদের চেনো নাকি?

ভক্ত: না, তবে ছেলে গুলো ভালো না।

ব্যক্তি: শুধু ভালো নয় , বিপজ্জনক। রাজনীতি করে।  আর রাজনীতিতে এখন গুন্ডাদের কদর বেশি। এরা পড়াশুনা তেমন করে নি। তোলাবাজি করে। মেয়েদের ইজ্জত নিয়ে খেলা করে। তাই কি বলছিল তোমাকে?

ভক্ত: বলল , যখন আসবে, ফ্রীতে চা খাওয়াতে হবে, মাসে থোক টাকা দিতে হবে।

ব্যক্তি: তা তোমরা রাজি হয়ে গেলা?

ভক্ত: না, চুটকি শুনিয়ে দিয়েছে-

ব্যক্তি: ভালো করেনি। তা কি বললো ওরা?

ভক্ত: বললো, টাকা না দিলে মেয়ে টারে  পিকনিক করতে নিয়ে যাবে।

ব্যক্তি: সেকি? পিকনিক মানে বোঝো? গণধর্ষণ। ভক্ত তোমার ‌মেয়ে ওদের ক্ষেপিয়ে ভালো করেনি।

চুটকি: বারে যে যা খুশি বলবে আমরা মুখ বুজে সহ্য করব? দেশে কি আইন কানুন কিছু নাই?

ব্যক্তি:  নাই। কেউ অপরাধ করলে পুলিশ তাঁদের ধরে। আর অপরাধীরা যদি মন্ত্রী হয় তবে আইন কানুন বলে কি আর কিছু থাকে না।

ভক্ত: তুমিতো আমারে ভয় ধরায়া দিলে। কি করব, দোকান তুলে অন্য কোথাও চলে যাব? মেয়েটার কিছু হলি আমি যে আর বাঁচব না।

ব্যক্তি: দোকান তুলে দিলে না খেয়ে মরবা। তোমার চিন্তা তো মেয়ে নিয়া। আমি বলি কি মেয়েরে কোথাও রেখে আসো। সব ঠিক হয়ে গেলে আবার নিয়ে এসো।

ভক্ত: তবে তাই করি।

(আলো নিভে যায় আবার জ্বলে, সাথে আবহ একমাস পর। ভক্ত চা বানাচ্ছে, এমন সময় মোটর সাইকেল থামার শব্দ। প্রবেশ করে শম্ভু, বজরঙ্গ ও বিক্রম।)

শম্ভু : কোথায় গেলি রে চুটকি?  তাড়াতাড়ি তিন গ্লাস চা নিয়ে আয়।

বজরঙ্গ : কিরে চুটকিকে দেখছি না।

বিক্রম: টাকা জোগাড় করেছিস?

ভক্ত: বিক্রি বাটা নাই , কোত্থেকে টাকা দেব।

শম্ভু: টাকা নাই, তার মেয়েটাকে বিক্রি কর। বল কত টাকা নিবি?

ভক্ত: এসব কি বলছেন?

বিক্রম: চুপ, টাকা দে, নয় মেয়েটাকে আমাদের হাতে তুলে দে। আমরাই তোকে টাকা দেব।

ভক্ত: মেয়েতো নাই, পালিয়ে গেছে।

বিক্রম: পালিয়েছে? থানায় ডাইরি করেছিস?

ভক্ত: থানা পুলিশ করে কি করব। মেয়ে যদি কারো সাথে গিয়ে ভালো থাকে , থাকুক।

শম্ভু: দাদা, এ শালা, ছোট জাতের লোক, নিজেই নিজের মেয়েকে বিক্রি করে দিয়েছে।

বিক্রম: কোন ঠিক নাই। বল, কার কাছে বিক্রি করেছিস?

ভক্ত : আমি মেয়ে বিক্রি করি নাই।

বিক্রম: ওকে ধরে নিয়ে আয়। ভালো করে বানা।

(শম্ভু আর বজরঙ্গ ভক্তকে ধরে মারা শুরু করে। ভক্ত চেঁচাতে থাকে- আমি মেয়ে বিক্রি করি নাই।( তবু শম্ভু মারতেই থাকে।  মার খেয়ে ভক্ত নিস্তেজ হয়ে এলিয়ে পড়ে।) মার , মার,  মেরে ফেল। আমি মরে মেয়েকে বাঁচিয়ে যাব। আর আমাকে খুনের দায়ে তোদের ফাঁসি হবে। মার মেরে ফেল আমাকে।

বজরঙ্গ: পাগল না কি? মরতে ভয় পায় না।

ভক্ত: ভয় পাই বলেই তোরা ভয় দেখাস। যেদিন পাবলিক ভয় ভুলে তোদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে সেদিন কোন নেতা, কোন পুলিশ তোদের বাঁচাতে পারবে না।

বিক্রম:( হাসি) জনতা হামলা করবে আমার উপর। আরে আমাকে দেখলে পালাবার পথ পায় না।  চিল্লা, জিৎনা জোরসে পারিস চিল্লা। দেখি কে তোর বাঁকে সাড়া দেয়।

ভক্ত: আরে জনতার না আসুক, আমি মরে ভুত হয়ে তোর পিছনে পিছনে ঘুরব। তোর জীবন হারাম করে দেব।

বিক্রম: আরে আমাকে ভুতের ভয় দেখাচ্ছে। আরে কি করছিস, এখনও আওয়াজ বেরোচ্ছে। আওয়াজ বন্ধ করে দে।

ভক্ত: মার মার

দূর থেকে জনতার চিৎকার ভেসে আসে। তিনজন  পালাবার চেষ্টা করে জনতা ঘিরে ধরে।)

ভক্ত: ছেড়ো না। মানুষের জীবন হারাম করে তুলেছে। জনতাই এর বিচার করবে। চুটকি আমি মরলাম সে দুঃখ নেই, তুই তো বাচলি। জানি না আগে কি হবে। (হেঁচকি ওঠে)

 

(এই সময় দৈনিক পত্রিকা ০৯.০৯.২০ তে প্রকাশিত, মেয়ে বিক্রির সন্দেহে পিটিয়ে দলিত খুন। উত্তর প্রদেশের মৈনপুরির ঘটনা)

আপনার কেমন লাগলো?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *