Raju Das

রাজু দাসের নাটকঃ ভাইরাস

ভাইরাস 

রেডিওতে মৃদুশব্দে রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজছে। কলিংবেল একবার বাজার পরে নেপথ্যে শোনা যায় – খবরের কাগজ । সাইকেলের ঘন্টার শব্দ বিলীন হয়।

রমা :  কইগো গরমজলটা হলো ?
রাজেন : জল ফুটছে , হলেই দিচ্ছি ।
রমা : জল গরম করতে কতক্ষণ লাগে।
রাজেন :  এই হলো বলে ।
রমা : তুমি তো ভালো করেই জানো সকালে ঘুম থেকে উঠে একগ্লাস গরমজল না খেলে আমার পেট পরিষ্কার হয় না। কোমরব্যাথাটাও কমে না।
রাজেন : জানি তো। হেই ও (কোথ )
রমা : একি তুমি গরমজল বসিয়ে হেইয়ো হেইয়ো শব্দ করছো কেন ?
রাজেন : কোথের সাথে সাথে তলপেটে জোরে চাপ না দিলে যে বেরোচ্ছে না।
রমা : তার মানে গ্যাসে গরমজল চাপিয়ে তুমি কমোটে পটি করতে বসেছো ?
রাজেন : হ্যাঁ। আমার দুর্গন্ধময় গ্যাসটা যাতে তোমার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ না করে, সেই চেষ্টা করছি।
রমা : তাহলে আজ আর আমার গরমজল খাওয়া হবে না। তুমি ফিরে গিয়ে  দেখবে সব জল বাস্প হয়ে উড়ে গেছে।
রাজেন : না না উড়বে না। আমি গ্যাসের জোর কমিয়ে এসেছি। তুমি ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়ামগুলো করতে থাকো। আমি  এক্ষুনি ক্লিয়ার করে আসছি ।
রমা : ওঁ:  ওঁ :।  প্রত্যেকদিন পেটপুরে যে খাচ্ছো  ওঁ:  ওঁ: সেগুলো রাখো কোথায় ?
রাজেন : আমিও তাই ভাবি। নাও এসে গেছি। তোমার ঘরের টিউব লাইটটা জ্বালিয়ে গরমজল নিয়ে আসছি। টিং টং –
রমা : এ কি ফ্লাস না করে চলে এলে কেন ?
রাজেন : হাগু হলোনা যে –
রমা : চুপ করো। কতদিন বলেছি গাইয়াদের মতো হাগামোতা শব্দগুলো বলবে না।
রাজেন : আমি তো গায়েরই ছেলে। গ্রাম্যভাষাতে আমরা সবাই এখনো কথা বলতে ভালোবাসি।
রমা : সে তুমি তোমার আত্মীয় স্বজনদের সাথে গাইয়া ভাষায় কথা বলো তাতে আমি কখনো আপত্তি করিনি। কিন্তু তুমি মুম্বাইতে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে গিয়েও ঐ শব্দটি ব্যবহার করেছ । তা শুনে বিয়ান বলেছেন  – ঐ ন্যাষ্টিশব্দ বস্তিবাসীরা ব্যবহার করে।
রাজেন : তুমি তাকে বললে না কেন ভারতের পচাত্তুর ভাগ মানুষের বসবাস এখনো গ্রামে, বস্তিতে। ওরাই ভারতীয় সভ্যতার পিলসুজ ।
রমা :   তা তোমার পটি না হলেও হিসুতো হয়েছে। যাও ফ্লাস করে ভালো করে হাতে পায়ে একমিনিট সাবান ঘসে জলে ধুয়ে গরমজলটা নিয়ে এসো।
রাজেন : সেই বাইশে ফেব্রুয়ারি থেকে একঘন্টা পরপর হাতে মুখে সাবান মাখাতে ঘরে  আর একটাও সাবান নেই । চাল ডাল তেল সবজিও শেষ হতে চলল।
রমা : শেষ  হওয়াটা তো স্বাভাবিক। হঠাৎ লকডাউন হতেই অর্থবানরা দু তিন মাসের খাদ্যদ্রব্য কিনে ঘরে মজুত করেছে। তোমাকেও তো বলেছিলাম মজুত করতে । তুমি বললে দেশের সত্তুরভাগ নিম্নবিত্ত্ব মানুষকে বঞ্চিত করে মজুত করবে না । এবার পেটে গামছা বেধে মুখে মাস্ক লাগিয়ে ঘরে বসে থাকো ।
রাজেন : রমা তুমি তো টি ভিতে দেখেছো লক্ষাধিক পরিযায়ী শ্রমিক, শ্রমিক মায়েরা খেতে না পেয়ে তাদের সন্তানদের কোলে কাধে নিয়ে পায়ে হেটে দুইহাজার মাইল রাস্তা পেরিয়ে নিজের রাজ্যের গ্রামের বাড়িতে ফিরতে গিয়ে কতজন পথেই মারা গেলেন। কতজনকে স্টেশনে আটকে রেখে দিল সরকার। এই সকল কষ্টজীবী লোকজনের কথা ভেবে আমার গলা ছেড়ে গাইতে ইচ্ছে করে। ( গান ) সকলই তোমার ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি -( ফ্লাশের শব্দ ) এই নাও তোমার জল।
রমা : গরমজলে অর্দ্ধেক লেবুর রস দিয়েছো?
রাজেন : হঠাৎ গরমজলে লেবুররস?
রমা : তুমি তো আর টিভি দেখো না। সব সময় রেডিওতে কলকাতা ক শোন।
রাজেন : কেন শুনি কারনটা আবারও বলছি – কয়েকটি মেকআপ নেওয়া রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের মুখ দেখতে  আর ভুলভাল উচ্চারণ শুনতে চাই না। তা লেবুর রসের দাওয়াইটা কে দিলেন?
রমা : মমতাময়ীদেবি বলেছেন – এই ভয়ানক সময়ে ডাক্তার সহ প্রত্যেকের ঘনঘন উস্ম গরম লেবু জল পান করা উচিৎ।
রাজেন : এতো দেখছি গরুর চোনাপানের পরিশোভিত শব্দ প্রয়োগ। তা এতে কি মমতাময়ীর  অনুপ্ররেণায় করোনাময়ীর ছোবল থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে ?
রমা : তোমার সবকিছুই নেগেটিভ চিন্তা ভাবনা। এতোবছরে যতগুলো নাটক লিখে অভিনয় করিয়েছো সবই বিপরীত ধারার। দর্শকরা গ্রহণ করলো কি করলো না, তা নিয়ে তোমার মাথা ব্যাথা নেই।
রাজেন : না নেই। তাই যদি থাকতো তাহলে এতোদিনে আমি সুশীল সমাজের বিশিষ্ঠজন হয়ে উঠতাম।
রমা : তুলসীপাতা দিয়ে চা বসিয়েছো?
রাজেন : হ্যাঁ এক্ষুণি নিয়ে আসছি। টিং টং – এই নিন। চা হাজির ম্যাডাম।
রমা : থ্যাংকস। শোন চা খেয়ে থালা বাসন ধুয়ে , ঘর তিনটে ঝাড়ু দিয়ে ফিনাইল জলে বেশ ভালো করে মুছবে। আমাকে যেন হাত লাগাতে না হয়।
রাজেন : সেকথা আমি জানি। এতো বছরে পাঁচ পাঁচটি ঠিকাঝির কাজকর্ম তুমি খুটিয়ে দেখে ঠিক খুত বের করতে। সেখানে আমি তো সবে  লকডাউনের পরে সংসারের কাজগুলো করতে শুরু করেছি।
রমা : শোন দুটো খাটের নিচে উপুড় হয়ে শুয়ে ভালো করে ন্যাতা দিয়ে মুছবে। পায়খানা বাথরুম রোজ ঘসবে।
রাজেন : যথাজ্ঞা।
রমা : আচ্ছা বলতো দাসবাবু, এই লকডাউনে ঘরের কাজ করতে গিয়ে নতুন কি কি শিখলে ?
রাজেন : একটি বিষয় শিখেছি, ঘর ঝাড় দেবার সময়  সামনের দিকে এগুতে হয় । আর ঘর মোছার সময় সর্বদা পিছিয়ে আসতে হয় ।
রমা : ও ভালো কথা। গতকাল দুপুরে কাজের বৌ মানে ফতিমা ওরফে নুপুর  পাঁচকিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে মাসমায়না নিতে এসে খুব কান্নাকাটি করলো। বাংলাদেশে ওর মেয়েটা এবার দশক্লাসের আর ছেলেটা নয় ক্লাসের পরীক্ষা দেবে। জমিহীণ স্বামীটার রিকশা বন্ধ। কি করে যে সংসার চলছে আল্লাই জানেন। তার উপর মোদি সরকার নাকি সব মুছলমানদের এদেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে?
রাজেন : তুমি ওকে পুরোমাসের টাকাটা দিয়ে দিয়েছ তো ?
রমা : হ্যাঁ দিয়েছি। ফতিমা ( নুপুর ) জিঞ্জাসা করছিল আমরা ওকে সর্বক্ষণের জন্য রাখবো কি না। ও রান্না বান্না সবকাজ করবে।
রাজেন : বেশ তো রেখে দাও। আমি অন্তত ওর সাথে বাঙালভাষায় কথা বলতে পারবো।
রমা : রাখতাম যদি না তোমাকে হাড়ে হাড়ে চিনতাম। এই শোন ঘরমোছা হয়ে গেলে –
রাজেন :  আটা মাখবো সবজী কাটব দুধ জ্বালাব। দুপুরের বরাদ্দ চাল জলে ভিজিয়ে রাখব।
রমা :  বাকি কাজ আমি  করে নেবো। ও ভালোকথা দুটো বেডকভার ও অন্যান্য জামাকাপড় গামলায় রাখা আছে স্নানের আগে ওগুলো কাচবে।
রাজেন : সবকটি কাজ আমি কমপ্লিট করে রেখেছি ম্যাডাম।
রমা : কি ব্যাপার বলোত লকডাউন হবার পর থেকে তুমি আমাকে ম্যাডাম বলে সম্বোধন করছো কেন?
রাজেন : ভয়ে বলবো না কি নির্ভয়ে বলবো ?
রমা : এমন ভাব করছো যেন এতোগুলো বছর তুমি আমকে ভয় করে কাটিয়েছো ?
রাজিন : না তা কাটাইনি। তবে সকাল ন’টায় নাকে-মুখে দুটি ভাত গুজে বাদুরঝোলা হয়ে এগারোটায় অপিসে গিয়ে টপবস ম্যাডামের ফাইফরমাশ মতো ছ’টা পযর্ন্ত  কাজ করে রাত আটটায় বাড়িতে ফিরতাম। একমাত্র শনি রবিবার বিকেলটা নাটকের মহলাতে নিজেকে মনে হতো সর্মাট।
রমা : জানি জানি, অপিসে ফাইল পত্র নাড়াচাড়া আর সহকর্মীদের সাথে গুলতানি মারাই ছিল তোমাদের প্রধান কাজ। আর আমি ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের সামলে, বাজারহাট করে সংসারের জোয়ালটা কতকষ্টে এত বছর টেনে ওদেরকে মানুষ করেছি
তা একমাত্র আমিই জানি ।
রাজেন : আমার মা তোমার মা, সকলের মায়েরাই সংসারের জোয়াল টানেন।
রমা : তোমার আমার মা কোনদিন হাটে বাজারে যাননি।
রাজেন : তাদের যাবার প্রয়োজন হয় নি। স্বামীরা যা সবজী মাছ ফল ফলাদি কিনে এনে দিতেন। তাই দিয়ে সুন্দর করে রান্না করতেন।
রমা : তারা বুঝে শুনে ভালো ভালোটাই কিনে আনতেন। তোমার মতো পচাধ
চা আনতেন না।
রমা : তোমাকে তো বলেছি বাজার করতে আমার ভালো লাগে না।
রমা : কি করে লাগবে ! আমার সঙ্গে বাজারে গিয়ে বন্ধুদের সাথে চায়ের দোকানে আড্ডা মারবে, চা খাবে, গণশক্তি পড়বে। আসার সময় আমার হাত থেকে দুটি ব্যাগ বয়ে আনবে। তাও শনি রবিবার। এদিক দিয়ে পাশের বাড়ির ব্যাংক ম্যানেজার মুখার্জীবাবু খুব ভালো। ভোরে ঘুম থেকে উঠে বৌকে বেডটি দেওয়া থেকে বাসন মেজে রান্নাবান্না কাপড় কেচে অপিসে যান।
রাজেন : শশুরের টাকায় বাড়ি গাড়ি করলে এটুকু তো করতে হবেই।
রমা : তার মানে আমার বাবা তোমাকে পন বা যৌতুক দিতে পারেনি বলে আমাকে খোটা দিলে ?
রাজেন : যা: বাবা এতে খোটার কি দেখলে। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, আমি পনপ্রথার ঘোর বিরোধী বলেই তোমার বাবা মায়ের কাছ থেকে একমাত্র তোমাকে চেয়ে নিয়েছিলাম।
রমা : পন পেতে হলে নিজের যে কোয়ালিটি থাকা উচিৎ তা কি তোমার ছিল ?
রাজেন : না তা আমার ছিল না। পাঁচফুট চার ইঞ্চি উচ্চতা সম্পন্ন উচ্চমাধ্যমিক পাশ বেসরকারী সংস্থার পাতিকেরাণীর সাথে কোন বাবা মা, তাদের সুন্দরী মেয়ের বিয়ে দিতেন না তা আমি জানি। যদি তুমি আমাকে পছন্দ না করতে ।
রমা : তা হলে মুখার্জীবাবুর দোষ কোথায়  ?
রাজেন : ঘুরে ফিরে আবার মুখার্জীবাবুর প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে কেন ! আচ্ছা তুমি কি জানালা দিয়ে অথবা ছাদে গিয়ে মুখার্জীবাবুর গতিবিধি লক্ষ করো ? না কি ওনি তোমার নিটোল ফিগার পর্যবেক্ষণ করেন।
রমা : আমি তো আর তোমার মতো চরিত্রহীন নই যে পরপুরুষের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে প্রেমভিক্ষা করবো। তাও ছাপ্পান্ন বছরে এসে।
রাজেন : প্রেম কখনো বয়সের হিসাব করে আসে না। এবং আসে না বলেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন – প্রেমের ফাঁদ পাতা  ভুবনে, কে কোথায় ধরা পড়ে কে জানে।
রমা : আমার শরীরের জরা বার্ধক্যে প্রেমের অনুভুতিগুলো শুকিয়ে গেছে। তোমার আছে তুমি পুরো দমে তাই এখনো চালিয়ে যাচ্ছো।
রাজেন : তা ঠিক আমার প্রেম অন্তজ মানুষের প্রতি, আমার প্রেম নাটকের প্রতি। আমার প্রেম তোমার প্রতি এখনো অমলিন।
রমা : নাটকের সস্তা ডায়লগে তুমি আর আমাকে ভোলাতে পারবে না।
রাজেন : আচ্ছা সত্যি করে বলো তো নাটকের প্রতি তোমার প্রেম নেই  ?
রমা : নাটকের প্রতি আমার প্রেম আছে বলেই এখনো বুকের দুপাশে দুটি  পেসমেকার, বি পি, সুগার, নার্ভের অসুখের পরোয়া না করেই মঞ্চে অভিনয় করি। কিন্তু আর কোনদিন তোমার সাথে  অভিনয় করবো না।
রাজেন :  কেন আমার অপরাধ ?
রমা : তুমি একটি হিপোক্রাপ্ট। ব্যাভিচারী চরিত্রহীন লোক তাই ।
রাজেন : বিয়ের পর থেকে শুনে এসেছি  আমি একজন গুড ফর নাথিং। ভোদাই মার্কা লোক।  যার এতোটুকু সাংসারিক জ্ঞান নেই। আর আজ জীবনে প্রথম শুনলাম, আমি চরিত্রহীন। তাও দুবার বললে ?
রমা : আরো আগেই কথাটা বলা উচিৎ ছিল। তাহলে হয় তো তোমার দেহজ প্রেমলীলা বন্ধ হতো।
রাজেন : আজকে বেশ বুঝতে পারছি পত্নীপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে বিয়ের আগের প্রেমের পর্বগুলো তোমাকে শুনিয়ে কি মারাত্মক ভুল করেছি।
রমা : তোমার বিয়ের আগের প্রেমগাথা নিয়ে আমার এতটুকু মাথাব্যথা ছিল না বলেই তোমাকে কখনো ও বিষয়ে কোন কথা শুনিয়েছি বলো ?
রাজেন : না তা শোনাওনি। তবে  বহুদিন আমাকে কলির কেষ্ট বলেছো।
অথচ তোমার যৌবনকালে একাধিক প্রেমিক এসেছিল। আমিও তাদের নিয়ে কখনো তোমাকে আঘাত দিইনি।
রমা : আমাকে ওরা একতরফা ভালবেসেছিল। সেখানে আমার অপরাধ কোথায় ? কিন্তু তুমি এই সাতষষ্টি বছর বয়সেও আমার সামনে অন্য মহিলার সাথে ফ্লাট করবে তা আমি সহ্য করবো ?
রাজেন : না করবে না। বলো কার সাথে আমাকে প্রেম করতে দেখেছো?
রমা : আমাদের নাটকের দলে পঞ্চাশ বছরের মেকাপি টুটুল মুখার্জীর সাথে তুমি ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনে, হোয়াটস আপে কথা বলতে না  !
রাজেন : হ্যাঁ বলতাম। টুটুল ওর সংসারের নানাবিধ অশান্তির কথা বলতো, আমি তাকে শান্তি বজায় রেখে সঙ্গীত আর অভিনয়কে বাঁচিয়ে রাখতে অ্যাডভাইস করতাম ।
রমা : মহাত্মা ভেগাই হালদার নাটকের শেষে মেকআপ রুমে টুটুলের পিঠে মাথায় হাত রেখে  আদর করোনি ?
রাজেন : ও আমাকে দাদার মতো শ্রদ্ধা করে তাই ভালো অভিনয়ের জন্য আর্শীবাদ করেছিলাম ।
রমা : এতোই যদি দাদার মতো শ্রদ্ধা করে তাহলে মঞ্চে ওঠার আগে আমরা যখন সবাই নাট্যগুরু হিসাবে তোমার  পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করলাম তখন টুটুল করলো না কেন ?
রাজেন : হয়তো ব্রাহ্মণঘরের নারী হিসাবে অন্তজ নাট্য নির্দেশকের পায়ে মাথা নোয়াতে ওর বিবেকে বেধেছিল। যাহোক তার অহমিকাকে খর্ব করার জন্য তাকে তো নাটকের দল থেকে বহিস্কার করেছো।
রমা : গতকাল চুপিচুপি তোমার পেছনে দাঁড়িয়ে ফোনের কথাকটি যদি না শুনতাম তাহলেতো জানতেই পারতাম না যে বুলবুলির সাথেও তোমার অবৈধ সম্পর্ক ছিল ।
রাজেন : ( চিৎকার ) ছি : ছি: রমা। বুলবুলি আমার খুড়তুতো ছোট বোন। পয়ত্রিশ বছর পরে কেনাডা থেকে ফোনে  অনেক দিনের জমে থাকা স্মৃতি রোমন্থন করছিল  ।
রমা : সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু  বুলবুলি কেন শুধু তোমাকে একা ওর কেনাডার বাড়িতে  আমন্ত্রণ জানলো। কেন বলল – আমি দাম্ভিক। তোমার পাশে আমাকে বেমানান লাগে। কেন বলল – আমার পাশে তোমাকে অনেক হ্যান্ডসাম লাগে ? কেন  বললো ( চিৎকার )
রাজেন : কথাটা তুমি উল্টো শুনেছো  তাছাড়া তোমার ব্যক্তিত্বকে সবাই সমীহ করে। তুমি স্বনামধন্য লেখিকা অভিনেত্রী। একাধিক ভাষায় তোমার গল্প ছাপা হয়েছে। রেডিওতে পাঠ হয়েছে। তুমি  বিভিন্ন সভায় বক্তব্য রাখো। তোমার একক প্রচেষ্টায় ছেলে মেয়েরা আজ ওয়েল এষ্টাবিলিষ্ট।এসব কথা সবাই জানে।
এমন বিদুষী মহিলা আমার বংশে আর কেউ নেই ।  তাই অনেকেই তোমার সাথে সহজভাব মিশতে সাহস পায় না।
রমা : বাজে কথা বলো না। তুমি অন্তত একজনের নাম বলো যার সাথে আমি হেসে কথা বলিনি ?
রাজেন : বুলবুলির ছেলের বিয়েতেই ওর সাথে তোমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল। সেই সঙ্গে দু চারটে কথাও –
রমা : একটা বিয়ে বাড়িতে এর চাইতে বেশি কথা বলার অবসর কোথায় ?
আমাকে বাদ দিয়ে তোমাকে একা কেউ কোনদিন নিমন্ত্রণ করেছে বলো ?
রাজেন : না  তা করেনি। সব্বাই তোমার উপস্থিতিটাই কামনা করেছে। তোমাকে অন্যদের সাথে পরিচিত করিয়ে তারা নিজেরা আত্মতুষ্টি লাভ করেছে। আর আমি তোমার হতভাগ্য গুড ফর নাথিং স্বামী গর্বের হাসি হেসেছি ।
রমা : তা হলে বুলবুলি তোমাকে একা অভিসারে ডাকলো কেন ! হোয়াই হোয়াই ( চিৎকার  )
রাজেন : ও ডাকলেই প্রমাণ হয় না আমার সাথে আদরের বোনটার অবৈধ প্রেম আছে। এবং একমাত্র এই কারনে তুমি আমাকে চরিত্রহীণ বলে চিহ্নিত করতে পারো না।
রমা : পারি পারি। ভুজের হোটেলে  মিসেস ব্যানার্জীর সাথে তুমি সহবাস করোনি ! আমারই সামনে। সেদিন ভেবেছিলে আমি পাশে ঘুমোচ্ছিলাম।
কি মনে পড়ছে মি: রাজেন?
রাজেন : হ্যাঁ সেদিন মিসেস ব্যানার্জীর  আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমি পাপ কর্মটি করেছিলাম।
রমা : আমার ইউট্রাস, ওভারি অপারেশন হবার পরে আমার আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে বহুদিন আমাকে তুমি ধর্ষন করেছো সেটা চরত্রহীনতা নয়? তবুও এতগুলো বছর ছেলে মেয়েদের মুখ চেয়ে তোমাকে ক্ষমা করেছিলাম। কিন্তু এখন আমার সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেছে।
রাজেন : সেই ক্ষণিকের অপরাধের জন্য আমি তোমার পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়েছিলাম রমা।  সেই অপরাধবোধে আমি আজও  ক্ষত বিক্ষত হয়ে রয়েছি   কিন্তু বিশ্বাস করো টুটুল অথবা বুলবুলি কারো সাথে আমার অবৈধ সম্পর্ক নেই
রমা : আমি তোমায় আর বিশ্বাস করি না । আজকেই ফোন করে বড়মেয়েকে  তোমার সব অপকির্তীর কথা বলবো ।
রাজেন : রমা প্লিজ এটি তুমি করো না।  বাবা হিসাবে  আমি ওদের কাছে খুব ছোট হয়ে যাবো। ওরা ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখবে আমায়। ভাববে এই চরিত্রহীন লোকটা যে সারাটা জীবন কষ্টজীবী মানুষের মঙ্গলের কথা ভেবে, সমতার কথা ভেবে, মানবতার স্বপক্ষে নাটক লিখে অভিনয় করতো গণচেতনার জন্য !
রমা : আমিও তোমার আদর্শে উদ্বোদিত হয়ে সারাটা জীবন তোমার লড়াইতে সামিল হয়েছিলাম। আজকে তোমার সত্য সুন্দরের সেই মুখোশটা সন্তানের সামনে উন্মোচিত করবোই  –
রাজেন : রমা রমা আমি তোমার কাছে কনফেস করছি, সত্যিই আমি একজন স্বার্থবাদী,দ্বিচারী, চরিত্রহীন মানুষ। এ পযর্ন্ত আমি  যা কিছু করেছি সব নিজের আত্মসুখের জন্য, সব নিজের প্রচারের জন্য।  আমাকে আর একবার ক্ষমা করে দাও লক্ষীটি।
রমা : না না না।
রাজেন :  রমা সন্দেহবাতিকে তুমি একদিন মানসিক রোগগ্রস্থ হয়ে পড়বে।
রমা :  কি ! তুমি আমাকে মানসিক রোগী বললে ?
রাজেন : না  আমি তা বলিনি।
রমা : আমি পাগল তাই না ! থাকবো না তোমার সাথে তোমার ঘরে। ( ফোনে ডায়াল করে ) হ্যালো রিমা?
রিমা : ( ফোনের কন্ঠ ) হ্যাঁ মা বলো। কি হয়েছে। তোমরা ভালো আছো তো ?
রমা : না ভালো নেই। তুই প্লেনের টিকিট কেটে পাঠিয়ে দে। আমি তোর কাছে চলে যাবো।
রিমা : হঠাৎ কি হলো। এর আগে কতদিন বলেছি তোমরা দুজনে আমাদের কাছে এসে থাকো। রাজী হওনি। আজ হঠাৎ  কি হলো ?
রমা : তোর বাবা এই বুড়ো বয়সেও প্রেম করছে একধিক মহিলার সাথে।
রিমি : তুমি নিজে চোখে দেখেছো?
রমা : না। ফোনাফোনি করছিল শুনেছি
কুমার : ( জামাতার কন্ঠ ) শাশুমা, আপনার তো গর্ব হওয়া উচিৎ এতো বয়সেও আপনার হ্যান্ডসাম বরকে এখনো  মহিলারা প্রেম নিবেদন করছে।
রিমা : আ: কুমার, মায়ের সাথে এখন ইয়ার্কি মেরো না। শোন মা, ভদ্রমহিলার বাড়িতে কি বাবা যাতায়াত করেন?
রমা : না। তারা তো অনেক দূরে থাকে।
রিমি : তাহলে তোমার টেনশন নেই। ওদের ফোন , হোয়াটস আপ, ফেসবুক লক করে দাও। দেখবে প্রবলেম সলভ।
রমা : ( কান্না ) তোর বাবা আমাকে মানসিক রোগী বলেছে।
রাজেন : নারে রিমি, আমি শুধু  বলেছি সন্দেহবাতিক থেকে তুমি একসময়  মানসিক রোগী হয়ে পড়তে পারো ।
রমা : না আমাকে মানসিক রোগী বলেছে।
রাজেন : না বলিনি।
রমা : বলেছো বলেছো বলেছো (চিৎকার)
রাজেন : বেশ ক্ষমা চাইছি। ভুল হয়ে গেছে। আর কোনদিন বলবো না।
রিমি  : মা এবার তো শান্ত হও। বাবা তো ক্ষমা চাইলো। মা, তোমাদের মতো আদর্শবান চরিত্রবান মা বাবা পেয়েছিলাম বলেই তো আমরা তিন বোনে  মানুষ হতে পেরেছি। জানো আমার পরিচিত জনেদের কাছে তোমরা দুজনে এখনো আদর্শ রোমান্টিক জুটি। সেই তোমরা এখন সাধারণ একটা বিষয়ে ঝগড়া করছো?
কুমার : শাশুমা  আপনি বাপিকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে গভীর ভাবে ভালোবাসেন বলেই এই সন্দেহের উদ্ভব
রমা : তুমি তোমার শশুরমশাইয়ের কাছে জেনে নিও আমি বিয়ের পরে একদিনও মুখে বলিনি, আমি তোমায় ভালোবাসি।
রাজেন : আমি তো প্রতিটা মুহূর্তে তোমার ভালোবাসার অভিব্যক্তি অনুভব করি তাই ঐ নিছক কথার কখনো প্রয়োজন হয়নি।
কুমার : কি শাশুমা।বাপি কেমন মোক্ষম ডায়লগ ঝাড়লো। আপকি পাশ হ্যাঁয় কই জবাব ?
রমা : জানিস রিমি, বিয়ের পরে আমার মা একটা কথা বলেছিলেন – আমি যেন এমন কোন অনৈতিক কাজ না করি যাতে সন্তান, স্বামীর অমঙ্গল হয়।
রিমি : আমিও সে কথা মেনে চলি মা।
শোন মা, বিখ্যাত এক মনস্তাত্বিক বলেছেন – করোনাভাইরাসের জন্য বিশ্বব্যাপি যে মাসাধিককাল লকডাউন চলছে এর ফলে বহু মানুষ মানসিক প্রতিবন্ধী হবেই। কাজেই দুজনে হাসিখুশি থেকো। আমার দেওয়া শান্তিকুঞ্জ নামটার ঐতিহ্য বজায় রেখো তোমরা ।
কুমার : শাশুমা লকডাউন উঠে গেলে শুধু আপনার জন্যে প্লেনের টিকিট পাঠাবো তো ?
রমা : না। আমাদের দুজনের জন্যেই পাঠাবে। আসলে একা তো কখনো থাকিনি  ।
রাজেন : শোন কুমারবাবা,বহুমানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনে একদিন হয়তো পৃথিবী থেকে করোনাভাইরাস নির্মূল হবেই কিন্তু মানুষের মন থেকে সন্দেহ নামক ভাইরাসটি থেকেই যাবে। কি বলো হা: হা : হা :
( নেপথ্যে রেডিওতে গান শোনা যাবে – ভালোবাসি ভালোবাসি এই সুরে কাছে দুরে জলে স্থলে ভালোবাসি ভালোবাসি )

আপনার কেমন লাগলো?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.

1 Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *