বিছানায় আধশোয়া হয়ে পড়ে আছেন যিনি, তার শ্বাস নিতে যে যথেষ্ট কষ্ট হচ্ছে, তা দেখেই বোঝা যায়। তার দুটি শীর্ণ হাত চাদরের পাশ থেকে বেরিয়ে আছে। পঞ্চাশোর্ধ শীর্ণাকায় মহিলা, চোঁখ দুটি প্রায় কোটরের মধ্যে ঢুকে গেছে। সারা মুখে ক্লান্তির ছাপ, মাথার কাঁচা-পাকা চুল অযত্নে রুক্ষ হয়ে আছে। বিকেলের তেরছা লালচে রোদ এসে পড়েছে তার বিছানায়। তিনি চোঁখ বন্ধ করে আছেন। আজ সকালেই তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন।
ঘরে ঢুকলো একটি মেয়ে, তার আঁচল ধরে তার সাথে ঢুকলো তার বছর পাঁচেকের কন্যা। মেয়েটি এসে বৃদ্ধার বিছানায় বসলো। তারপর তার শীর্ণ হাতটি ধরে বললো, ‘এহন কেমন আছ, মা?’
বৃদ্ধা ক্লান্ত চোঁখ মেললেন। বললেন, ‘এট্টু ভালো। ময়না, তোর বাবা আইছে?’
‘না, এখনও আসে নাই। মা, তোমার ওষুধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। ক্যাপসুলটা খেয়ে নাও’ এই বলে বালিশের পাশে রাখা ঔষধের প্যাকেট থেকে একটা ক্যাপসুল বের করে পাশে রাখা গ্লাসের জলটা এগিয়ে দিল’
বৃদ্ধা আস্তে আস্তে উঠে বসলেন। বা হাতে জলের গ্লাস নিয়ে জল মুখে দিয়ে ক্যাপসুলটা খেয়ে নিলেন। তারপর আবার শুয়ে পড়লেন। তাকালেন পশ্চিমের খোলা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে। ময়না মায়ের কাছে বিছানায় বসলো। ময়নার মেয়েটি মেঝেতে বসে তার হাতের পুতুল নিয়ে খেলতে লাগলো।
শীত চলে যাচ্ছে। দক্ষিন মুখো বাড়ী। বাড়ীটা প্রায় মাঠের মধ্যে। দক্ষিনে কিছুটা গিয়ে রাস্তা। উত্তরে এবং পূবে মাঠ, সেখানে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চাষ হয়। পশ্চিমে একটা ছোট পুকুর, বাড়ীর ভিত উঁচু করতে কাটা হয়েছিল। তার পর আরেকটু গর্ত করে সেই মাটি নিয়ে বাড়ি থেকে বড়ো রাস্তায় ওঠার রাস্তা বানানো হয়েছে। পুকুরের পরে আবার মাঠ। অনেক ফাঁকা বড়ো মাঠ। এখন সেখানে সর্ষে প্রায় পেকে এসেছে। কিছুদিন আগেও এই মাঠ ছিল হলুদ সর্ষে ফুলে ঢাকা, এখন তা ধুসর হয়ে এসেছে। কিছুদিন পরে কালচে আকার নিয়ে নেবে। মাঝে মাঝে দু’একটি ক্ষেতে অবশ্য ধনে লাগানো, সেই ক্ষেত গুলোতে সাদা ফুল ফুটে আছে। সাদা চাদরের মতো। বাইরে তাকিয়ে থাকতে বেশ ভালো লাগছে বৃদ্ধার।
‘ময়না, পবন কোথায়?’
‘সে এহনো দোকান থেকে ফেরে নাই।‘
‘সন্ধ্যে হয়ে গেল, তাও ফেরে নাই?’
‘না। দোকানের মাল আনতি গেছে। দুপুরে বাড়ী ফেরে নাই। একেবার রাতে ফিরবে কয়ে গেছে’
‘ছেলেটার দিকি একটু খেয়াল রাখিস। আমি তো এহন কিছুই পারিনা।‘
‘তুমি অত ভাববা না তো। সবাই ঠিক আছে’
‘তোর বাবা?’
‘বাবাও ঠিক আছে।‘
‘নারে, ঠিক নাই। লোকটা খাটতি খাটতি গেল। বড় চাপা স্বভাবের মানুষ। কাউরে কিছু কয়না। কষ্ট হলিও না। তোরাতো তোদের বাবারে অত চিনিস না!’
এবার ধমকে উঠলো ময়না। ‘মা, তুমি থামো তো। অনেক হইছে। নিজে খাটতি খাটতিআর শরীরের অজত্ন করতি করতি অসুখ বাধাইছ। এহন নিজের চিন্তা করো দিন! সবার চিন্তা অনেক করিছ, আর করতি হবে না। এখন তুমি সুস্থ হলিই সবাই ভালো থাকবে’
বৃদ্ধা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার পর ধীরে ধীরে বললেন, ‘আমি মনেহয় আর ঠিক হবো না রে ময়না! ছেলেটার বিয়েটা দিয়ে যাতি পারলি শান্তি হত’
ময়না শাসনের সুরে বললো, ‘একদম ওই সব আজে বাজে কথা বলবানা, মা। আর ভাববাও না। তুমি এহন অনেক ভালো আছো। আর ডাক্তারও কইছে সপ্তাখানেকের মধ্যি পুরোপুরি ঠিক হয়ে যবা’
কথাটা ঠিক বিশ্বাস হলোনা যেন। তিনি ম্লান স্বরে বললেন, ‘কি জানি…’ একটু থেমে আবার বললেন, ‘জানিস ময়না, আমার মনে পড়ে জ্বর হলি মা আমারেবারান্দায় শুইয়ে কলাপাতা মাথার নীচে পেতে মাথায় জল দিত। মাথাটা বারান্দা থেকে নীচেয় ঝোলানো থাকতো, জল কলাপাতা বাইয়ে নীচে পড়ে জমা হতো বালতিতে। তারপর মাথা মুছায় বারান্দায় পাটি বিছায় শুইয়ে দিত, আমি শুয়ে শুয়ে চিনি আর মুড়ি খাতাম আর উঠোনে সবার কাজ করা দেখতাম’।
ময়না জানে, মা তার ছোটবেলার গল্প বলতে খুব ভালোবাসে। শ্যাওড়া গাছের পেত্নীর গল্প, ভুতের গল্প, দেশভাগের গল্প, যুদ্ধের গল্প। পুকুরের মাছের গল্প, নদীর গল্প। সেই ছোটবেলা থেকেই অনেকবার গল্পগুলো শুনেছে ময়না এবং পবন। তবুও মা যখন বলে, মনে হয় এই প্রথম বলছে। দেশের গল্প বলাতে মায়ের কোন ক্লান্তি নেই। বলতে বলতে মাও সেই ছোট বেলায় চলে যায়। ছোট্ট খুকিটি হয়ে যায়। মার মন ভালো হয়ে যায়। শুধু জয়বাংলার যুদ্ধের গল্প বলার সময় মা’র মন খারাপ হয়ে যায়। কোন কোন দিন মা বলতে বলতে কেঁদেছেও।
কিন্তু এখন তার শরীর খারাপ, এখন কথা কম বলে বিশ্রাম নিলে ভালো হয়।
ময়না পাশে রাখা কমলা লেবু ছাড়াতে ছাড়াতে বললো, ‘মা তোমার শরীল আজ খারাপ, কাল গল্প শুনবো। এখন দুটো লেবু খাও তো’ বলে একটা লেবুর কোয়া মায়ের মুখে দিল।
‘এট্টু নুন্ দে, টক টক লাগে’
ময়না নুন এনে লেবুতে মাখিয়ে একটা একটা করে মায়ের মুখে দিতে থাকল।
‘মা তোমার জন্যি ভাত করবো? পবন কৈ মাছ নিয়া আইছে। কি দিয়ে খাবা?’
‘অত দামী মাছ আনছে ক্যান্? পবনরে বারন করিস তো।‘
‘ওসব নিয়ে তুমার ভাবার দরকার নাই। ওর দোকান এহন ভালোই চলতিছে। তুমি তাড়াতাড়ি ভালো হও তো। কি দিয়ে রান্না করবো কও”
‘জিরে বাটা দিয়ে আর আলু দিয়ে ঝোল কর, মুহি যদি এট্টু রুচি ফেরে’
লেবু খাওয়ানো হয়ে গেলে ময়না রান্না করতে চলে এলো। বাইরেটা অন্ধকার হয়ে এসেছে। জানলা খোলা থাকলে এখন পোকা-মাকড় আর মশা ঢুকবে। তাই জানলাটা বন্ধ করে দিল। মায়ের ঘরের আলোটা জ্বেলে দিল। এমনিই কম পাওয়ারের বাল্ব, আজ আবার ভোল্টেজ কম মনে হচ্ছে। তাই আলো কম।
এই বাড়ীটা নতুন করেছে নিরাপদ। নিরাপদ ময়নার বাবা। এর আগে আরেক জনের দান করা একটু খানি জমিতে ঘর বেঁধে থাকতো নিরাপদ। সেখানেই বিয়ের পরে তার সংসার । তারও আগে রেল লাইনের পাশের তাবুতেসংসার পেতেছিল। তারপর বাজারের দোকানটা হবার পর আয়ও একটু বাড়ে। পবনও এখন দোকানে গিয়ে বসে। মাঠের মধ্যে এই জমিটা কিনে কয়েক বছর আগে নতুন ঘর করে। বড়ো রাস্তা থেকে কাচা রাস্তায় একটু আসতে হয়। তবুতো নিজেদের বাড়ি। আশেপাশেও বেশ কিছু নতুন বাড়ি হচ্ছে। সবাই ওদেরই মতো। দেশ ছাড়া, ভিটে ছাড়া উদ্বাস্তু বাংলাদেশের লোক সব।
বেরিয়ে যাচ্ছিলো ময়না। মা আবার ডাকলো। ‘তোর বাবা কোথায় গেছে রে?’
‘বাবা দক্ষিনপাড়ায় গেছে হরিসভায়। তোমার নামে মানত ছেল। তুমি বাড়ি এলে পুজো দেবে হরিঠাকুরের কাছে। সেই পূজো দিতে গেছে।’
‘আজ কি বুধবার?’
‘হ্যা। বাবা তাড়াতাড়ি আসবে কয়ে গেছে। তুমি এহন এট্টু চুপ করে বিশ্রাম নেও। দরকার হলি আমারে ডেকো, আমি দরজা ভেজায় দিচ্ছি, না হলি কুকুর ঢুকতি পারে’ বলে ময়না বেরিয়ে আসে। তার মেয়েটি অগেই খেলনা নিয়ে কোথায় বেরয়ে গেছে। হয়তো ঊঠোনের পাশে কিংবা বারান্দায় বসে খেলছে।
*
কিছুক্ষন ক্লান্তিময় তন্দ্রায় চোঁখ বুঁজে আসে পদ্মর। তন্দ্রার মাঝেই কোন দুঃস্বপ্ন দেখে ধড়ফড় করে পর পদ্ম চোঁখ খোলে। দেখে নিরাপদ তার বিছানার পাশে বসে আসে।
‘কি পদ্ম, সরীলটা এহন কেমন? এট্টু ভাল্লাগে?’
পদ্ম ক্লান্ত চোঁখে তাকায়। বলে, ‘তুমি কতক্ষন আইছ?’
‘এই তো, একটু আগে’
‘কোন যাগায় গিছিলে’
‘তোর নামে একটা মানত করছিলাম, তুই যেদিন বাড়ী ফিরবি, সেইদিন ঠাকুরের পূজো দেব। তাই সেই মানতের পুজো দিয়ে এলাম। নে, এট্টু প্রসাদ খা।‘
নিরাপদ একটা কাগজের ঠোঙা থেকে বাতাসা আর একটা সন্দেশ নিয়ে পদ্মর কাছে আসে। বলে, ‘হা কর’
পদ্ম বলে, ‘জল খাবো’ । নিরাপদ জল এগিয়ে দেয়। জল খেয়ে পদ্ম হা করে। নিরাপদ তার মুখে প্রসাদ দেয়। বলে, ‘এইবার ভালো হয়ে যাবি পদ্ম’ বলে জলের গ্লাস মুখের কাছে ধরে।
পদ্ম কাপড়ের আঁচল দিয়ে জল মোছে। ম্লান সুরে বলে,’আর ভালো…’ বলে কিছুক্ষন চুপ থাকে। একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তারপরে বলে-
‘তুমি এট্টু আমার কাছে বসো’
এদিয়ে আসে নিরাপদ। বসে পদ্মর তক্তপোষের পাশে। পদ্মর কপালে হাত দিয়ে বলে, ‘না। জ্বর তো নাই। আইজ তো ভালোই আছিস। ডাক্তার বাবুও কইছে, দিন সাতেক লাগবে সারতে। তারপরে সব ঠিক হইয়ে যাবে’
নিরাপদর কথায় পদ্ম তেমন কোন ভরসা পায় না। বলে, ‘ডাক্তার যাই কউক, আমি তো বুঝি… আমার শরীল কয় আর বেশী দিন নাই গো…’
‘খালি আজে বাজে চিন্তা করিস। আমরা সবাই আছি না, দরকার হলে তোরে আরো বড় যাগায় নিয়া চিকিৎসে করাবো। বলে পদ্মর মাথায় হাত বোলাতে থাকে।‘
আরামে বা ক্লান্তিতে পদ্মর চোঁখ বুঁজে আসে। কিছুক্ষন সে চুপ করে থাকে। তারপর আস্তে আস্তে চোঁখ খোলে। নিরাপদর হাতটি তার শীর্ণ হাত দুটি দিয়ে জড়িয়ে ধরে থাকে কিছুক্ষন। নিরাপদও চুপ করে থাকে।
একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ভিতর থেকে উঠে আসে পদ্মর। তারপর আরো জোরে নিরাপদর হাতটি চেপে ধরে বলে, ‘তোমারে এট্টা কথা কবো। এই কথা যদি না কই, আমি মরেও শান্তি পাবোনা’।
অবাক হয় নিরাপদ। কি এমন কথা পদ্মর?
পদ্মর শ্বাসের গতি বাড়তে থাকে। তবুও একটু চুপ থেকে আবার বলে, ‘কথাটা তুমি মন দিয়ে শুনবা। শোনার পর যদি মনে করো, আমারে ঘরে রাখবা না, তবে রাস্তার পাশে ফেলায় দিও, নয়তো হাসপাতালে আবার রাইখে এসো। কিন্তুক কথাটা না কইয়ে মরে গেলে যে আমার মহা পাপ হবে গো!নরকেও ঠাঁই হবে না। এতদিন কই নাই, ভয় পাইছি। তুমি যদি আমারে তাড়ায় দেও, আমার কি হবে সেই ভয়ে…’
নিরাপদ অবাক হতে থাকে। চারদিকে সন্ধ্যের অন্ধকার নেমে এসেছে। একটু আগেই ঘরের সব জানালা বন্ধ করে দেওয়া হয়ে গেছে। ময়না রান্নাঘরে বসে রান্না করছে। ছেলেটা আসবে আরো রাতে, একেবারে দোকান বন্ধ করে। ময়নার মেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
ঘরে জ্বলছে একটা অল্প পাওয়ারের হলুদ বাল্ব। সেই অল্প আলোয় পদ্মর মুখ আরো করুন দেখাচ্ছে। কি এমন কথা পদ্ম বলতে চায়? পদ্মর সব কিছুইতো নিরাপদ জানে।
অল্প বয়সে মা হারা হয়, জয় বাংলার যুদ্ধে তার বাবা মারা যায়। মামার কাছে থাকতো। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরেও অবস্থার বদল হয়নি। মামা পদ্মকে নিয়ে চলে আসে ভারতে। এসে কোন ক্রমে লাইনের পাশে একটা ফাঁকা যায়গা পায়। সেখানে তাদের গ্রামের আরো কয়েক জনে ঘর বানিয়ে ছিল। সেখানেই টিনের ঘর বানিয়ে থাকতো সবাইকে নিয়ে।
নিরাপদও ওই বস্তিতে ওর কাকার কাছে থাকতো। ঘটনা প্রায় একই। জয়বাংলার যুদ্ধের সময় নিরাপদ তার মা বাবা দুজনকেই হারায়। তারপরে শরনার্থী হয়ে চলে আসে কাকার সাথে। স্থান হয় ওই বস্তিতে। এক বস্তিতে থাকার সুবাদে কিছুটা পরিচয় ছিল, কিন্তু পদ্মর মামা আর নিরাপদর কাকা মিলে বিয়েটা ঠিক করে। সেই থেকে দু’জনে সুখে দুঃখে এক সাথে আছে। আজ এমন কি কথা পদ্ম বলতে চাইছে, যা না বললে তার মরেও শান্তি হবে না? নিরাপদ বুঝে মায় না।
পদ্মর নিশ্বাস পড়ছে জোরে জোরে। ‘পদ্ম আমি তো তোর সব জানি, তুই আবার কি কইবি? থাক, এহন শরীল খারাপ, পরে কোস’
‘না গো। পরে যদি আর সময় না পাই। তোমার শুনতি হবে…’ আরো জোরে নিরাপদর হাত আকড়ে ধরে পদ্ম।
নিরাপদ হাত ছাড়িয়ে নেয় না। পদ্ম যদি তার হাত ধরে থেকে শান্তনা পায় তো পাক্।
পদ্ম নিরাপদর হাত ধরে রেখেই মাথাটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে। নিরাপদ পদ্মর চিবুকে হাত দিয়ে মাথা ঘোরায়। পদ্মর কোটরস্থ দু’চোঁখে জলের ধারা। কাধে ঝোলানো গামছার কোন দিয়ে পদ্মর চোঁখের জল মোছাতে মোছাতে বলে, ‘পদ্ম, কি হয়েছে তোর?’
একটু জোরে কেঁদে ওঠে পদ্ম। আবার সামলে নেয়, পাছে সে কান্না ময়নার কানে যায়। তারপর ধীরে ধীরে বলে, ‘আমি অপবিত্র, আমি আসতী গো…, বলে মুখে আচঁল চাপা দিয়ে ডুকরে কাঁদতে থাকে।
নিরাপদ কিছু ভেবে পায়না। হতভম্ভের মত বুঝতে পারেনা, পদ্ম তাকে কি বলছে। তিরিশ বছর সংসার করার পর এ কি কথা? না নিরাপদ তো তেমন কিছু দেখেনি! অন্য কারো সাথে ভাব ছিল, তাও মনে হয় নি। বিয়ের পর টাকাকড়ি না থাক, তাদের ভালোবাসার তো কোন অভাব অছে বলে মনে হয়নি। দুজনেই গায় খেটে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে এই সংসারটাকে দাঁড় করাতে পেরেছে। কিন্তু এখন এতদিন পরে রোগ শয্যায় শুয়ে পদ্ম এ কি বলছে?
ভেবে পায়না নিরাপদ, এখন তার কি বলা উচিৎ, কি করা উচিৎ। পদ্মর মুখের দিকে তাকিয়ে তার খুব কষ্ট হতে থাকে। পদ্মর মাথায় নীরবে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘এ কি কথা কোস পদ্ম?
পদ্ম যেন নিরাপদর কথা শুনতে পায়নি, বলে, ‘সে সময়ায় বাংলাদেশের যুদ্ধ শুরু হইছে। চারদিকি খালি মিলিটারি আর মিলিটারি। আমাগে গ্রামে যেদিন আগুন দিতি আলো, আমরা আগে সময় মতো খবর পাইনাই। সবাই পলাতেও পারিনাই। আমাগে কয়জনরে ধরে নিয়ে গেল…’ আর কথা বলতে পারেনা পদ্ম। চাদরে মুখ ঢেকে ফোপাতে থাকে। কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে তার সারা শরীর।
নিরাপদর মুখে কোন কথা আসেনা। চুপচাপ বসে থাকে পদ্মর বিছানার পাশে। আনমনে তার হাত পদ্মর মাথায় ওঠা নামা করে। ধীরে ডাকে, ‘পদ্ম…’
‘দুইদিন পরে আমি কোন ভাবে পালায়ে আসি রাতের বেলায়। গুলি চালায়ছিল, কিন্তুক গায় লাগেনাই… শয়তানরা আমারে …’ আর বলতে পারেনা। তার কোটরস্থ চোঁখে আগুন জ্বলে ওঠে, সেই সাথে জলের ধারা নামতে থাকে প্রবল ভাবে। তীব্র আক্রোশ এবং কষ্টে বুক ওঠা নামা করে।
আমি তোমারে আগেই কইতে চেয়েছি, কিন্তুক মামা মামী বারন করেছে। তাগে মরার পরও কইনাই। মনে হইছে সব শুনে তুমি যদি আমারে তাড়ায় দেও, আমি কোথায় যাবো? আমি তোমারে ঠকাইছি… আমারে তুমি হাসপাতালে রেকে আসো…’ ধীরে ধীরে নিশ্চুপ হয়ে যায় পদ্ম। তার রুগ্ন মুখে ক্লান্তি এবং দুঃখ। অল্প আলোয় তাকে আরো করুন দেখায়। নিরাপদ চুপ করে থাকে। পদ্ম তার মাথাটা অন্য দিকে ঘুরিয়া নেয়, যেন দোষ স্বীকারের পরে শাস্তির জন্যে নিশ্চিন্তে অপেক্ষা করে।
নিরাপদর মুখের ভাব ক্ষনে ক্ষনে বদলাতে থাকে। রাগ, ক্রধ, করুনা মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। সে আস্তে আস্তে তার হাত আবার পদ্মর কপালে রাখে। বলে, ‘পদ্ম। তুই অপবিত্র নারে, তুই স্বাধীনতা সংগ্রামী। তোরে আমি অপবিত্র মনে করতিছিনা। তুই আমারে চিনিস নাই পদ্ম। এতদিন তুই এই বেথা লুকায় রাখলি ক্যান্? তোর বুকে এই পাথর চাপায় রাখলি ক্যান? তুই যদি আমারে আগে কতিস, আমি তোরে আর বেশী বেশী ভালো বাসতাম রে…, তোর সব দুঃখু আমি ভুলায় দিতাম’
পদ্মর চোঁখের তারা চিক চিক করে ওঠে। চোঁখ বড় করে অবাক হয়ে নিরাপদর মুখের দিকে তাকায়। এই মানুষ্টারে সে যেন নতুন করে দেখছে। সত্যি কথা, এতদিনেও সে নিরাপদকে চিনতে পারেনাই।
‘এট্টা দ্যাশ স্বাধীন করতি গেলি মেলা কিছু দিতি হয় রে পদ্ম! যারা শুধু মুক্তি বাহিনীতি যুদ্ধ করিছে, তারাই কি শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামী? না রে? যারা মরিছে, তারা তাগের জীবন দেছে, তাগে দান সবচাইতে বেশী। আমার বাপ-মা মরিছে, তোর বাপ মরিছে, সে তো দ্যাশকে স্বাধীন করতি যায়ে। আর তোর মতো কতোজন তো হারায় গেছে রে পদ্ম! তুই তো তাও বাঁচে ফিরিছিস! তোর যা গেছে তাওতো দ্যাশের জন্যি, তুই ও তো স্বাধীনতা সংগ্রামী…’
আবেগে কথাগুলো বলতে থাকে নিরাপদ। পদ্ম এই লোকটির দিকে তাকায়…, এ কেমন ধারা লোক? কেমন ধারা বিচার এর? নিরাপদকে নিয়ে গর্বে, ভক্তিতে ভালোবাসায় তার ভিতরটা উথলে ওঠে। তার আবার নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে করে।
তবুও নিরাপদর দিকে কাতর কন্ঠে বলে, ‘তবে তুমি আমারে ক্ষমা করিছো, কও?’
‘তুই কি পাপ করিছিস? যে আমি ক্ষমা করবো? নারে পদ্ম, তোর পর আমার কোন রাগ নাই। তুই তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে ওঠ, তারপরে আমরা দুইজনে আর একবার যাবো ভিটেমাটি দেখতি…’
পদ্ম আরো জোরে নিরাপদর হাতটা চেপে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে। একটু থেমে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিরাপদ বলে, ‘তবে দুঃখু কি জানিস? যে দ্যাশের জন্যি এত কিছু গেল, সেই দ্যাশটাতেই থাকতি পারলাম না। এহনো চোঁখ বন্ধ করলি সেই দ্যাশটারে দেহি। যাবো, একবার যাবো তোরে নিয়ে… শ্যাষ বারের মতো জন্মভিটে দেখে আসবো…’
বলতে বলতে জড়িয়ে আসে নিরাপদর গলা। দুই জোড়া চোঁখই টল টল করে ওঠে। সেই চোঁখ দুই কিশোর ও কিশোরীর।
——
Very touching story. I have read it earlier, probably in Jatin Bala’s book.